সম্ভাবনার অপমৃত্যু এবং লৌকিক সমাচার

সাহিত্য ও সাংস্কৃতি

 

 

2015_12_03_17_30_46_IrVoz9NNP1GU9R0GUGU7it6LpNcils_original

 

 

 

 

সে ছিল আমাদের বন্ধু। প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে আশ-পাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে এসে আমরা যখন হাই স্কুলে ভর্তি হই তখনই তার সাথে আমাদের প্রথম দেখা। খাটো আকৃতির দেহে যতটুকু স্বাস্থ্যের দরকার সেটা থাকা সত্ত্বেও খর্বাকৃতির কারণে তাকে আমাদের তুলনায় সবসময় ছোট মনে হতো এবং সেটা সে জানত। তবু সে ছিল গুরুত্বপূর্ণ। অন্তত স্কুলে আমরা যতদিন ছিলাম গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানটা সে বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। যদিও ততটা মেধাবী সে ছিল না; কিন্তু অধ্যাবসয়ের দরুণ সবসময়ই ভালো রেজাল্ট করত। ফলে শিক্ষক এবং সহপাঠী সকলের কাছেই একধরনের সমীহ পেত। ক্লাসের পড়াশুনায় একঘেয়ে হয়ে আমরা যখন পাশের গার্লস স্কুলের মেয়েদের সম্পর্কে রসঘন কথাবার্তা বলতাম কিংবা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে মুক্তা সিনেমা হলে ফার্স্ট শো দেখতে যাবার আলোচনা করতাম- এইসব আলোচনায় কখনই সে আমাদের সাথে অংশগ্রহণ করত না। আমাদের সকলেরই বন্ধু ছিল সে। তবু আমরা কেউ তার বন্ধু ছিলাম না। সে যখন আমাদের সাথে কথাবার্তা বলত, হাসত কিংবা খেলত একটা দূরত্ব সবসময় বজায় থাকত। খুব অন্তরঙ্গভাবে কারও সাথে মিশতে দেখা যেত না তাকে। আমাদের প্রত্যেকেরই এক কিংবা একাধিক অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। যাদের সাথে আমরা ভালোলাগা কিংবা মন্দ লাগা কিংবা পারিবারিক গল্প বলাবলি করতাম। কিংবা একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার-স্যাপার যা ঐ বয়সে প্রত্যেকেরই থাকে- ভীষণ গোপন এবং নিষিদ্ধ সে-সব আলোচনা করে আমরা সুখ বোধ করতাম এবং পরস্পরের প্রতি একধরনের নির্ভরতা তৈরি হতো এবং মনে মনে বলতাম, তুই হইলি আমার প্রাণের দোস্ত। সারাজীবনই তুই আমার দোস্ত হইয়া থাকবি। তার কোন দোস্ত ছিল না।

দূরের এক গ্রাম থেকে সে স্কুলে আসত। বর্ষা মৌসুমে কোষা নৌকায় ছুপছুপ লগি ফেলে সরকারি রাস্তা পর্যন্ত। তারপর হেঁটে-হেঁটে। পানি শুকিয়ে গেলে চকের ভেতর সরু রাস্তা ধরে তার খর্বাকৃতির দেহ নিয়ে একগাদা বই-খাতা হাতে তাকে দেখা যেত। প্রায় প্রতিদিন। স্কুলে আসতে তার ভালো লাগত। কেননা প্রত্যেক ক্লাসের পড়া তৈরি থাকত তার। শিক্ষকরা যখন পড়া জিজ্ঞেস করতেন, বেশিরভাগ ছেলেই পড়া না পেরে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকত এবং শিক্ষকদের বেত বদহজম করত। সে-টা সে উপভোগ করত।

মোটামুটি সবাই ধরে নিয়েছিল এস.এস.সি.-তে সে খুব ভাল রেজাল্ট করবে। ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ কোন জায়গায় যাবে। সেই-মাফিক সকলেই সমীহ করত তাকে। সে ছিল নিম্নমধ্যবিত্ত এক কৃষক পরিবারের সন্তান। তার পরিবার এমনকি আত্মীয়-স্বজনের ভিতরে পড়ালেখা করে নাম-কাম করেছে এমন কেউ ছিল না। আর সে-কারণেই তার ভালো ছাত্র হয়ে ওঠাটা আত্মীয়-স্বজন-পরিবারের লোকজন সকলকেই স্বপ্ন দেখতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এবং সেই-মতো তারা স্বপ্ন বুনতে থাকে এবং তার কদর তাদের কাছে বাড়তে থাকে। আর সে-ও অভ্যস্থ হয়ে পড়ে তার প্রতি সকলের এই অতিরিক্ত মনোযোগে। কোন দাওয়াত বা ছোট-খাটো অনুষ্ঠানে যখন তার চাচি বা মামী বা ফুপু অথবা খালা তার আর সকল আপন অথবা অন্যান্য ভাই-বোনদের পাত রেখে তার পাতে মাছের মাথাটা কিংবা বড় টুকরাটা কিংবা মুরগির রানটা দিতেন তখন সে অবাক হতো না। গ্রামের লোকেরা চায়ের দোকানে কিংবা জুম্মাবারে মসজিদে বসে তাকে নিয়ে যখন উৎসাহমূলক কথা-বার্তা বলতো তখন তার ভিতরে চাপা উত্তেজনা এবং গৌরব বোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠত যেটাকে সে সযত্নে লুকিয়ে রাখতো।

এস.এস.সি.-তে সত্যিই সে খুব ভাল রেজাল্ট করলো। আমরাও দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করে বেজায় খুশি হয়ে স্থানীয় মফস্বল কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম। আর সে রাজধানী শহরের এক নামকরা কলেজে ভর্তি হল। এরপর তার সাথে আমাদের দেখা হতো ঈদ কিংবা কোরবানীতে। সে আরও চুপচাপ এবং পলিশ হয়েছে। অন্তত চেহারায় এবং চর্বিতে খানিকটা ঔজ্জ্বল্য ফুটে উঠেছে। কথা-বার্তায়ও বেশ একটা কেতাদুরস্তভাব এসেছে। রাস্তায় দেখা হয়ে গেলে তার ক্ষুদে দু’টা চোখ পিট পিট করতে করতে যেন খানিকটা অবজ্ঞার স্বরে জিজ্ঞেস করতো, হ্যা, ভালো আছো! আমরা পরস্পর পরস্পরকে ‘তুই’ সম্বোধনে অভ্যস্থ ছিলাম। মনে মনে বলতাম হোগার পো! ‘তুমি’ মারাও! অবশ্য সে আমাদের আলোচনার ততোখানি বিষয়বস্তু ছিল না। আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে মফস্বলীয় রাস্তায় তখন রাজনীতি এবং সুন্দরী বালিকা দুটোই মজুদ ছিল। আর আমরা প্রায় প্রত্যেকে এরকম একেকজন সুন্দরী বালিকার বিষয়ে অনেকখানি আগ্রহী ছিলাম।

আড্ডা, রাজনীতি, মেয়েমানুষ, নেশা এবং অন্যান্য মফস্বলীয় বিষয়ে অবাধ নকলের বদৌলতে (তখন মফস্বল কলেজগুলিতে নকলের উৎসব চলত) আমরা প্রায় প্রত্যেকেই এইচ.এস.সি. পাশ করে গেলাম। কেউ কেউ বিদেশ পাড়ি জমাল কিংবা বিদেশ যাবার ধান্ধায় দালালের কাছে টাকা দিয়ে বেকার ঘুরতে থাকল, কেউ কেউ রাজধানী শহর কিংবা অন্যান্য শহরের বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ভর্তি হলো এবং কেউ কেউ যাদের বাপের গাঁটে পয়সা আছে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে নাম লেখালো এবং কেউ কেউ স্থানীয় কলেজেই থেকে গেল তাদের নিম্নমানের যোগ্যতা নিয়ে। আমাদের স্কুল ফ্রেন্ডদের ভিতরে সে ছাড়া দু’একজন যে ভালো কোথাও ভর্তি হয় নি, তা-না। তবে তার ভিতরে যে সম্ভাবনা ছিল বিশেষ কারণেই সে-কথা বয়ান করছি- এস.এস.সি.-তে ভালো রেজাল্ট করেও এবং নামকরা কলেজে ভর্তি হয়েও সে এইচ.এস.সি. পরীক্ষায় খারাপ করে বসলো।

আমরা যখন জানলাম এইচ.এস.সি. পরীক্ষায় চার বিষয়ে অংশগ্রহণ করার পর সে একদিন কোন কিছু না লিখে দুই ঘণ্টা বসে বসে কাটিয়ে সাদা খাতা জমা দিয়ে পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে এসেছে, তখন আমরা খুব একটা আহত না হলেও অবাক হয়েছি। দ্বিতীয় বছর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে আমরা হতবাক হয়েছি এবং মফস্বলে বসেই নিজেদের মত সম্ভাব্য কারণ উদঘাটন করেছি, তাইলে সে কী কোন মাইয়ার প্যাচে ফিট খায়া গেল? সে যেই বাসায় থাকে (তার মামার বাসা) তার পাশের বাসায় তার সমবয়সী এক মাইয়া আছে। সেই মাইয়া তারে জিন্স আর শর্ট গেঞ্জির ফাঁকে ত্যালত্যালা নাভী দ্যাখাইয়া বেশ কয়দিন ঘুরাইছে । সেই মাইয়া পল্টি লওয়াতেই না-কি সে ফিট খায়া গেছে! কেউ কেউ আরও খানিকটা বুদ্ধি খাটিয়ে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করল- আরে না! সে আসলে মফস্বল থিকা গিয়া কারও সাথেই খাপ খাওয়াইতে পারে নাই। আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছিল। আর এদিকে তার মাথায় ছিল চাপ। সকলেই তার দিকে তাকায়া আছে। তার অন্যান্য ভাই ব্রাদাররা যারা কেউ কেউ নিম্ন মধ্যমানের কাজ-কাম করে, কেউ কেউ বেকার ঘুইরা বেড়ায়; তাগো সকলরে রাইখা বাপে তার প্রতি সমস্ত মনোযোগ দিছে- টাকা পয়সা ইনভেস্ট করছে। এই ইনভেস্ট যেন ফুইলা ফাইপা ফিরা আসে সেই প্রত্যাশা বাপের চোখে-মুখে সবসময়ই ছিল। আর সে-ও সেইটা জানত। সব মিলায়া এই লোড মামায় লইতে পারে নাই। কয়েকটা পরীক্ষা দেওয়ার পরই তার মনে হয় নাহ্ ঠিক মতো সবকিছু আগাইতাছে না। অতএব আপাতত পরীক্ষা দেওয়া বন্ধ। আমরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে এইরকম আরও আরও ব্যাখ্যা দাড় করাতে থাকলাম এবং এক প্রকার সুখ বোধ করতে থাকলাম এবং যথারীতি এক সময় আবার মফস্বলীয় বালিকাদের নিয়ে নিজেদের একান্ত অনুভূতির আদান-প্রদান করতে থাকলাম।

মাস দুয়েক পরে তাকে আমাদের মফস্বল শহরে দেখা যেতে থাকল। নিয়মিত। এবং আগে যা কখনই আমরা দেখতাম না, সন্ধ্যার পরে রাস্তায় বা মোড়ে কিংবা কুমার নদীর পারে যেখানে আমরা আড্ডা দেই সেখানে তাকে দেখা যেতে থাকল। অবশ্য এর ভিতরে আমাদের রাস্তা-ঘাট এবং যোগাযোগ ব্যবস্থারও খানিকটা উন্নতি হয়েছে। ফলে আগে যেখানে আশ-পাশের গ্রামের লোকেদের সদাই-পাতি করতে কিংবা অন্যান্য যে-কোন প্রয়োজনে প্রায় প্রত্যেক দিন হেঁটে-হেঁটে বাজারে আসতে হতো। এখন সেখানে চার্জযুক্ত ব্যাটারি চালিত অটোরিকশায় ক্ষয়ে যাওয়া রাস্তার সুড়কি ওঠা পথে হেলে-দুলে তাদের মানে আশ-পাশের গ্রামের লোকেদের সকালে এবং সন্ধ্যায় দুইবেলা আসতে এবং যেতে দেখা যায়। তাকে দেখে আবার আমাদের মনোযোগ তার উপরে পড়ল এবং তার এভাবে ছিটকে পড়ার রহস্য উদ্ঘাটনে কৌতুহল বেড়ে গেল।

সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলাম, দোছ খুইলা ক’তো ঘটনা আসলে কী হইছিল। আমাদের প্রশ্নে তার চুপচাপ স্বভাবটা আরও খানিকটা চাগিয়ে ওঠে এবং সে এমনভাবে নাহ তেমন কিছু না। তার প্রিপারেশনটা ভালো ছিল না; বলে এড়িয়ে যায়। আমরা তার উত্তরের বিপরীতে যে তাকে জিজ্ঞেস করবো, আরে হালায়, প্রিপারেশন ভালো ছিলো না ক্যান সেইটাইতো জিগাই, তার আর উৎসাহ থাকে না। আমাদের মনে হয়, থাক তার কাঁটা ঘায়ে আর নুনের ছিটা দিয়া লাভ নাই। এরপর থেকে তাকে আমাদের আড্ডায় প্রায় নিয়মিত দেখতে পাওয়া যায়। সিগারেট ফোঁকার অভ্যাস না থাকলেও সে আমাদের সাথে আনাড়িভাবে সিগারেট ফোঁকে। একটু ধোঁয়া ছেড়েই খুক খুক করে কাশে। আমরা সেটা উপভোগ করতে থাকি এবং তার মামার পাশের বাসায় থাকা তরুণীর সাথে আসলেই তার কোন ঘটনা ছিল কিনা কিংবা আদৌ তার মামার পাশের বাসায় কোন সুন্দরী তরুণী ছিল কিনা সেই সর্ম্পকে তাকে জিজ্ঞেস করি। উত্তরে সে বলে- হ ছিল একটা মেয়ে। তবে সে আমার দুই বছরের সিনিয়র ছিল। আমরা আসলে তার এই উত্তরে খুশি হই না। আমরা  আরো পষ্ট করে জানতে চাই যে, সেই মেয়ে সবসময় জিন্স আর শর্ট গেঞ্জি পইরা ঘুইরা বেড়ায় কিনা এবং আসলেই তারে ত্যালত্যালা নাভী দ্যাখাইছিল কিনা এবং সে সত্যি সত্যি এই নাভী দেইখাই আউলাইয়া গেছে কিনা। কিন্তু এবারেও সে এমন উত্তর দেয় যাতে আমরা আরো বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। আরে না না তেমন কিছু না। বললাম না, সে আমার সিনিয়র ছিল! তবে মনে হয় সে আমার প্রতি খানিকটা উইক ছিল। না না সে ভদ্র ঘরের মেয়ে। কিন্তু এই আলোচনা আর এগোয় না। মূলত তার অনুৎসাহই এর জন্য দায়ী। সে বলে আরে বাদ দাও না এসব!

এরপর আমাদের জীবন থেকে আরও আরও দিন ফুরিয়ে যেতে থাকে। আর আমরা ঢুকে পড়ি জীবনের ভিতরে অথবা ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করি। কেউ কেউ ডিগ্রি পাশ করে ছোট-খাটো চাকরিতে ঢুকে স্ট্রাগল করে করে বেশ ভালো অবস্থায় চলে যায় কিংবা কেউ কেউ যায় না, কেউ কেউ বিয়ে-শাদী করে শ্বশুড়ের টাকায় স্থানীয় শহরে ব্যবসা-পাতি করে টাকা পয়সা কামায়- ভুড়ি বাড়ায়, কেউ কেউ দীর্ঘ দীর্ঘ দিন দালালের পেছনে ঘুরে অবশেষে স্বপ্নের ইওরোপে ঢুকে সেটেল্ড হয় কিংবা পাকিস্তান, ইরান, তুরস্ক হয়ে গ্রীসে ঢোকার পথে ধরা খেয়ে ফিরে আসে এবং এসে তার রোম হর্ষক কাহিনি বলতে থাকে। এবং আবার রওনা দেয়। কেউ কেউ সরকারি দলের লেজুরবৃত্তি করে কন্ট্রাকটরি কামের ভাগড়া পেয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পালসার কিংবা হাংকের ধোঁয়া ওড়ায় এবং নিজেকে বেশ একটা হোমরা-চোমরা ভাবতে থাকে। কেউ কেউ প্রাইভেট মেডিকেল থেকে এম.বি.বি.এস. হয়ে মফস্বল শহরে গজিয়ে ওঠা ক্লিনিকের চেম্বারে বসে ল্যাপটপে ফেইস বুক ওপেন করে বসে থাকে কিংবা কানে স্ট্রেথেসকোপ লাগিয়ে রোগির চোখ, জিহ্বা, বুক এবং পেট দেখে। কিন্তু তাকে জীবনের ভিতরে ঢোকার এই প্রক্রিয়ার ভিতরে ঢুকতে দেখা যায় না। এমনকি ঢোকার চেষ্টা করতেও দেখা যায় না। এবং ক্রমেই সে আমাদের থেকে আরও ছিটকে পড়তে থাকে। এবং একসময় আমরা শুনতে থাকি, যেহেতু মফস্বল শহরের এই গন্ডির ভিতরে আমরা বসবাস করি সেহেতু এখানে ঘটতে থাকা প্রায় সকল ঘটনা কিংবা রটনা আমরা শুনতে পাই- সে মানে অমুকের পোলাডা এক্কারে নষ্ট হয়া গেল। নেশা-ফেশা কইরা সারাদিন পইরা থাকে। কী সব কথা-বার্তা কয়। হালার নাকি আল্লার লগে কানেকশন আছে! হালার মাতাটা পুরা গ্যাছে।

এরপর আমরা সত্যি সত্যি আবিষ্কার করি যে, সত্যি সত্যি তার কথা-বার্তা খানিকটা অসংলগ্ন হয়ে পড়েছে এবং সে আগের চেয়ে মুখরা এবং আক্রমনাত্মক হয়ে উঠেছে। আমরা তাকে জিজ্ঞেস করি, কিরে কী হইছে। ঘটনা কী, খুইলা ক তো? সে বলে, বলতে বলতে ক্ষেপে যায়, তোরা কী সব অন্ধ নাকি! সবকিছুতো খোলাই আছে। কিছুই দেখস না! এইযে কুমার নদী। তার উপরে কি কেউ পর্দা দিয়া রাখছে? আমি তো ঠিকঠাক দেখতেছি। কলকল করে জল যাইতেছে। এই ঝাপসা আন্ধারেই সব আন্ধা হয়া গেলি! তার কথায় আমরা প্রায় ব্যাক্কল হয়ে পড়ি। মাথা ঝাকি দিয়ে ঠিক হবার চেষ্টা করি। আরে না না আমরা নদীর কথা জিগাই না তোর কথা জিগাই। সিগারেটের শেষ অংশ ছুড়ে ফেলে দেয়ার আগে তার আগুনে আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে সে বলে- আমি তো আমার কথাই কইতেছি। তোরা এখনও গাধাই রোইয়া গেলি। তোগো কান ধইরা খাড়া করাইয়া রাখন দরকার। নদী আর আমি আলাদা হইলাম নাকি ব্যাটা। নদীর গন্তব্য অসীমে। আমার গন্তব্যও অসীমে। নদীর জন্মের যে উৎস আমার জন্মেরও সেই একই উৎস। পানি। হঠাৎই কাউকে কোন কিছু না বলে সে হাঁটা ধরে। আমরা তাকে ডাকি, কীরে কই যাস? সে আমাদের ডাকে কোন সাড়া দেয় না। হন হন করে সন্ধ্যার অন্ধকারে নদীর পার ধরে হাঁটতে থাকে। আমরা বলাবলি করি, হালার মাতা আসলেই গ্যাছে।

তার মাথা যে আসলেই গ্যাছে দিনে দিনে আমরা তার প্রমাণ পেতে থাকি। চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে কিংবা সেলুনে চুল কাটাতে কাটাতে আমরা তার পাগলামির গল্প শুনি। ভাই হোনছেন নি! সাদা কাপড়ে আমাদের গলা অবধি আটকে কেচিটাকে বেহুদা ক্যাচক্যাচ করতে করতে উঠতি বয়সী ছেলেটা বলে, ভাই হোনছেন নি আপনেগো বন্ধুর কামকাইচ! আমরা নাপিতের চুল নাড়নের আরামে চক্ষু প্রায় মুদে অস্ফুট স্বরে বলি, ক্যান, কী হইছে। সে মানে আমাদের চুলে কাঁচি চালনারত নাপিত গল্প বলার আতিশয্যে মুখে একধনের তৃপ্তি এনে বলে, ভাই, সে এখন কলেজের সামনে গিয়া খারায়া থাকে, বুজলেন নি। কলেজের মাইয়াগো রাস্তায় খারা করাইয়া নাম জিগায়, বাড়ি কই জিগায়। কয়, তোমার তো চেহারা ছবি সুন্দর-ই আছে। ছিনামায় পাট করবা নি! আমি ডাইরেক্টর। হিরোও আমি। তোমারে চাইলে সাইট নায়িকার পাট দিতে পারি। মাইয়ারা হ্যারে দ্যাকলেই ভয়ে দৌর দ্যায়। কয়দিন আগে এক মাইয়ার চাচা এমন দৌরানি দিছে! আর হালায়ও এমন জাউরার জাউরা, দৌরায় আর কয়, অই অই আমার পিছন পিছন দৌরা। আমি এ্যাহোন ভিলেন আর তুই হিরো। তয় মনে রাখিস মূল হিরো কিন্তু আমিই। শ্যাষ ছিনে তোর লগে আবার দ্যাখা হইবো।

সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আমরা তার পাগলামির গল্প করি এবং দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়ি- আহা বেচারা! আমাদের ভিতরে কেউ একজন দীর্ঘদিন ইতালি কিংবা গ্রীস কিংবা ফ্রান্স থেকে মাস দুয়েক বা তিনেক হলো দেশে এসে বলে- বুঝলি হেইদিন করছে কি; সক্কাল ব্যালা আমারে গিয়া ডাইকা উঠাইছে। কয়, চা খামু ট্যাকে ল। কুমার ট্যাকে গিয়া চা’র অডার দিছি। কয়, আমার লাইগা দুইকাপ ক। দিলাম দুইকাপের অডার। কয়, সিগারেট দে। দিলাম সিগারেট। সিগারেট ধরায়া মুখে লইল। দুইহাতে দুইকাপ চা লইল। হটাতই কওয়া নাই বওয়া নাই দুইকাপ চা নিজের মাথায় ঢাইলা দিল। আমি তো অবাক! কইলাম, কী করলি এইডা তুই। কয়, নাটিরপো টাকার গরম দ্যাখাও! বিদেশ থিকা আইসাই কচি মাল বিয়া চোদাও। আমি তোর বড় না ছোট। একবার আমারে জিগাইছোস আমি বিয়া করছি কিনা? ক’তো ‘ও’ এইরকম হইয়া গেল ক্যামনে? এরপর আমরা নিজেরা নিজেদের মত করে তার পাগলামির ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে থাকি। কেউ বলি, অরে আসলে একটা বিয়া করাইয়া দেয়া দরকার। মামার মাল মাথায় উইঠা গ্যাছে। এর লাইগ্গাই মামায় আউলায়া গ্যাছে। কেউ বলে, ‘ও’ আসলে হেভি ফ্রাস্টেসনে ভোগে। কেউ বলে, ‘ও’ আসলে অস্তিত্বের সংকটে ভোগে। আগে বাপ-মা, ভাই-ব্রাদার, মামা-মামী, চাচা-চাচি, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই তারে গুরুত্ব দিত। এখন আর কেউ গুরুত্ব দেয় না, এমনকি পাত্তাই দেয় না ফলে ও সবসময় নিজেরে জানান দিতে চায়। ‘ও’ যে একসময় হিরো ছিল সেইটা স্মরণ করাইয়া দিতে চায়। কিন্তু সেইটা ঘটে না ফলে ‘ও’ পাগলামি করে। আমরা নিজেরা নিজেদের মত ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে করাতে রাত গভীর করি এবং এক সময় যার যার ঘরে ফিরে যার যার ব্যক্তিগত জীবনের খুনসুটির ভিতরে নিজেদের ডুবিয়ে রাখি।

আমরা একদিন চৈত্রের বাতাসভরা বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামীণ নৈঃশব্দ পান করতে থাকি এবং হাঁটতে হাঁটতে আমাদের ভিতরে কেউ একজন বলে, চল পাগলারে দেইখা আসি। অগো বাড়িতো এইদিকেই- এই প্রস্তাব আমাদের মন্দ লাগে না এবং আমরা দুইধারে কচি ধানের সবুজ দোলা দেখতে দেখতে তাদের বাড়ি যেতে থাকি। নতুন উঠতে থাকা বিল্ডিংয়ের চাপে ছোট হতে হতে গোল বৃত্তে পরিণত হওয়া উঠোনের এক কোনায় তাদের পুরনো বেঁকে যাওয়া টিনের ঘরের লাগোয়া আম গাছের সাথে শিকল দিয়ে পা বাঁধা অবস্থায় তাকে বসে থাকতে দেখে সত্যি কথা বলতে কি আমাদের কারও কারও বেজায় খারাপ লাগে। আমরা তার কাছে গিয়ে কী বলব ঠিক ঠাহর করতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি কিংবা একজন আরেকজনের দিকে আড় চোখে চাওয়া-চায়ী করি। সে সম্ভবত আমাদের জড়তা বুঝতে পারে অথবা কোন কিছু না-বুঝেই আমাদের জড়তা কাটিয়ে দেয়। হ, তোরা আছস ক্যামন? না না কওয়া লাগবে না। জানি ভালো আছস। তাতো থাকবিই। ভালো থাকনের কায়দা-কানুনতো ভালোই রপ্ত করছস!

আমাদের পেয়ে তাকে কথা বলার আরামে পেয়ে বসে, আমাদের কোন কিছু বলতে না দিয়ে একাই কথা বলতে থাকে সে- আর আমরাও তাতে একপ্রকার স্বস্তি বোধ করি। সে বলে- তয় কে যে ভালো আছে ঈশ্বরই ভালো জানেন। দ্যাখ আমারে এরা বাইধাঁ রাখছে, মনে করছে আটকাইয়া রাখবে। এরা কী জানে আমি কইর কইর থিকা ঘুইরা আইলাম! তার এই দার্শনিক মার্কা কথা-বার্তায় এবার আর আমরা বিভ্রান্ত হই না। আমাদের আওয়াজ পেয়ে তার মা ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন এবং এসেই আমাদের দেখে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দেন। তখন আমাদের মনে হয় এদিকে আসাটা আমাদের বোধহয় বোকামিই হয়ে গ্যাছে। তার মা আমাদের অবস্থাকে মোটেই পাত্তা না দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন- আমার সোনার পোলাডা এমন কইরা পাগল অইয়া গেল। ও বাপধন তুই এমন করছ ক্যান? ও বাপধন। এবার আমরা সত্যি সত্যি অস্বস্তিতে পড়ে যাই এবং তখন আমাদের ভিতর থেকে কেউ একজন তার মায়ের কাছে গিয়ে যথাসম্ভব মুখে মলিনতা ফুটিয়ে তুলে অথবা হতে পারে উদ্ভূত পরিস্থিতিই তার মুখ মলিন করে দেয়, সান্ত¦না দেয়ার চেষ্টা করে বলে, কাকি কান্না-কাটি কইরেন না। আল্লার উপরে ভরসা রাখেন। সব ঠিক হইয়া যাবে। তবে অরে ভালো ডাক্তারের কাছে নিয়া যাওয়া দরকার।

আমাদের সান্তনা বাণী তার মাকে খানিকটা প্রশান্তি দেয়। তিনি তার ধূসর এবং মলিন শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে উঠে গিয়ে আমাদের জন্য মুড়ি-চানাচুর নিয়ে আসেন। আমরা খেতে খেতে আরও কিছু সান্তনামূলক কথা-বার্তা বলে তার কাছ থেকে বিদায় নেই। এরপর তাকে বলি, আজ তাইলে আমরা যাই। ভালো থাকিস। সে বলে, যাবি গা? হ, যা। সবারইতো যাইতে হবে। আমরা হাঁটা ধরলে সে আমাদের ডাক দেয়, শোন। আমরা তার কাছে গেলে সে দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ থাকে তারপর ধীর এবং চাপা স্বরে যেমনভাবে সে আগে কথা বলত, বলে, তোরা সবাই মিল্লা আমারে পাগল বানায়া দিলি? তার এই কথায় আমরা প্রায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। একপ্রকার তাড়াহুড়া করেই আমরা তার কাছ থেকে বিদায় নেই। যেন আমাদের ভীষণ জরুরী কাজ আছে এবং সে এইমাত্র যা বলেছে আমরা তার সে-কথা কেউ শুনতে পাইনি। আমরা বলি হ্যা, যাইরে। আবার দেখা হবে। ফিরতি পথে হাঁটতে হাঁটতে আমরা পূব আকাশে উঠতে থাকা কচি চাঁদের মুখোমুখি হই এবং অকারণেই বিষন্ন হয়ে পড়ি।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *