পৌরসভা নির্বাচনের আচরণবিধি সংশোধন করে এমপিদের প্রচারে নামার সুযোগ দেওয়ার সুযোগ দিতে চান না নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বেশিরভাগ সদস্য। তাদের মতে, তফসিলের পরে আচরণবিধি সংশোধন করে এই সুযোগ দেওয়া হলে ইসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ উঠতে পারে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেছেন, আজ কমিশন সভায় এ ব্যাপারে আলোচনার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হবে। তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় পেছানোর দাবিসহ সব ব্যাপারেই কমিশন সভায় আলোচনা হবে। তবে নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির নেতাকর্মীদের হয়রানি ও গ্রেফতারের বিষয়ে তিনি আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন।
গতকাল রোববার ইসি কার্যালয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রতিনিধি দল পৃথকভাবে সিইসির সঙ্গে বৈঠক করে নিজ নিজ দলের দাবি তুলে ধরে। এরপর কার্যালয় থেকে বের হওয়ার সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন সিইসি। সিইসির সঙ্গে বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এমপিরা প্রচারে নামার সুযোগ চেয়েছেন। জাতীয় পার্টির এমপিরা একই দাবি জানানোর পাশাপাশি মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় ১০ দিন বাড়ানোর কথা বলেছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচন ১৫ দিন পেছানো এবং দলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও হয়রানি বন্ধ করাসহ আরও কিছু দাবি উত্থাপন করা হয়। এসব দাবির বিষয়ে আজ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পর দলগুলোকে এসব বিষয়ে কমিশনের অবস্থান জানিয়ে দেওয়ার কথাও বলেন সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন।
দু’দিন আগে থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দেওয়া এসব দাবি নিয়ে কমিশনের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে আসছিলেন। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পাঁচ সদস্যের এই কমিশনে দু’জন সদস্য আচরণবিধি পরিবর্তনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তারা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত কমিশন সভায় নেওয়ার পর তা ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। তখন কেন আপত্তি করা হয়নি। এখন ক্ষমতাসীন দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিধি সংশোধন করতে গেলে কমিশনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ উঠবে। তবে আরেক সদস্য মনে করেন, এমপিদের নির্বাহী ক্ষমতা না থাকায় তাদের প্রচারে নামার সুযোগ থাকা উচিত। অন্য কমিশনার আবু হাফিজ স্বাস্থ্যগত কারণে কমিশনে আসছেন না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক বলেন, পৌরসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিধি সংশোধন হলে কমিশনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ উঠতে পারে। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) জাবেদ আলী বলেছেন, তফসিল ঘোষণার পর আর কিছু করা যাবে না- এটা ঠিক নয়। কারণ অসম্ভব বলে কিছু নেই। আইন ও বিধির মধ্য থেকে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কমিশন সভায় এ বিষয়ে আইনের নানা দিক বিশ্লেষণ করে যেটা যৌক্তিক তা-ই করা হবে।
এদিকে ইসি থেকে পৃথক চিঠিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও অর্থ বিভাগকে তফসিল ঘোষিত ২৩৬ পৌরসভা এলাকায় নতুন প্রকল্প গ্রহণ বা নির্বাচনের আগ পর্যন্ত কোনো প্রকল্পের অর্থ ছাড় বন্ধ রাখতে চিঠি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করতে তথ্য চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে ইসি।
মেয়রদের পদে থেকে নির্বাচনে বাধা নেই :পৌর নির্বাচনে বর্তমান মেয়রদের পদে থেকে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধা নেই। তবে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ অন্যদের ক্ষেত্রে পদে থেকে নির্বাচনের সুযোগ নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক বলেন, পৌর নির্বাচন আইনের ১৯ ধারার (২) উপধারায় এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।
প্রচারে এমপিদের সুযোগের দাবি আওয়ামী লীগের: পৌর নির্বাচনের প্রচারে এমপিদের সুযোগ দিতে গতকাল নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আবেদন জানিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। রোববার দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সিইসির সঙ্গে বৈঠক করে। প্রতিনিধি দলে অন্যদের মধ্যে ছিলেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ প্রমুখ। বৈঠক শেষে মাহবুবউল আলম হানিফ সাংবাদিকদের বলেন, সংসদ সদস্যদের কোনো নির্বাহী ক্ষমতা নেই। তারা সরকারি সুবিধা ব্যবহার করেন না।
দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচনে এমপিদের প্রচারে যাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। এ জন্য বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে এমপিদের সুযোগ করে দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। আচরণবিধির এই নিষেধাজ্ঞাকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে হানিফ বলেন, এমপিদের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা উচিত হবে না। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন চায় আওয়ামী লীগ। বিএনপির নির্বাচন পেছানোর দাবি সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা ইসির বিষয়। আইনের মধ্যে থেকে তারা যদি করতে পারে আওয়ামী লীগের তাতে আপত্তি নেই।
নির্বাচন পেছানোর দাবি বিএনপির: পৌর নির্বাচন অন্তত ১৫ দিন পেছানোর দাবি জানিয়েছে বিএনপি। এ জন্য প্রয়োজনে আইন পরিবর্তনের কথাও বলেছে দলটি। দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ওসমান ফারুকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ দাবি জানায়। এ সময় দলের পক্ষে শামসুজ্জামান দুদু, এস এম আবদুল হালিম, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও সুজাউদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠক শেষে ওসমান ফারুক সাংবাদিকদের বলেন, এমপিদের প্রচারে নামার সুযোগ বন্ধের বিধান বহাল রাখার পক্ষে তারা। তিনি বলেন, তাড়াহুড়া করে তফসিল ঘোষণায় অনেক ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। জানুয়ারিতে প্রায় ৫০ লাখ নতুন ভোটারকে অন্তর্ভুক্ত করে ভোট নেওয়া, দলের মহাসচিবসহ গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীদের মুক্তি, এমপিদের প্রচারে বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞা বহাল ও দলীয় প্রভাবমুক্ত নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়েছে বিএনপি।
প্রচারে এমপিদের চায় জাপাও: এমপিদের প্রচারে নামার সুযোগ চেয়েছে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। গতকাল দলের মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলুর নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধি দল সিইসির সঙ্গে বৈঠক করে এ দাবি জানায়। এছাড়া তারা মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় ৩ ডিসেম্বরের পরিবর্তে ১০ ডিসেম্বর করার দাবি জানান। প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন কাজী ফিরোজ রশীদ এমপি, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি, অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি প্রমুখ।