দেশের বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে চলছে পৌর নির্বাচনের তোড়জোড়। প্রার্থী চূড়ান্ত করতে কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বৈঠক করছেন দফায় দফায়। বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা বাড়তে না দিয়ে এককপ্রার্থী চূড়ান্ত করাই দুই দলেরই টার্গেট। ইতোমধ্যে দুই দলই খসড়া তালিকা চূড়ান্ত করে ফেলেছে। আজ-কালের মধ্যেই দলীয় প্রতীক পাওয়ার টিকিট তুলে দেয়া হবে চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পাওয়া প্রার্থীদের। তবে বিএনপি সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কিত এবং নির্বাচন ১৫ দিন পিছিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছে। এসব বিষয়ে আলোচনার জন্য নির্বাচন কমিশনে প্রতিনিধিদল পাঠাবে দলটি।
দুই দলের সিরিয়াস প্রস্তুতিতে আসন্ন পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে দিন দিন উত্তেজনা বাড়ছে। তৃণমূলেও শুরু হয়েছে নির্বাচনী আমেজ। নমিনেশন ফরম কেনার পাশাপাশি সম্ভাব্য প্রার্থীরা শুরু করেছেন গণসংযোগ। দলীয় নমিনেশন পেতে চলছে লবিং-তদবির। তবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে বিএনপিতে তৈরি হয়েছে শঙ্কা। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলেও, মাঠপর্যায়ে সংগঠিত হতে পারছেন না বিএনপির নেতাকর্মীরা। পুলিশি অভিযান অব্যাহত থাকায় গ্রেফতারভীতি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের। গত এক মাসে বিএনপি-জামায়াতের ১০ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর ফলে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে নির্বাচনের মাঠ।
শঙ্কার মধ্যেই বিএনপির প্রস্তুতি : নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়া নিয়ে শঙ্কা থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। দল ও জোটের শীর্ষ নেতাদের সাথে বৈঠক করে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দলের অভ্যন্তরে নির্বাচন নিয়ে চলছে নানা প্রস্তুতি। চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে গত চার দিন ধরেই দফায় দফায় বৈঠক করছেন নেতারা। প্রার্থীতালিকা চূড়ান্ত করার কাজ প্রায় শেষের দিকে। আজ অথবা কালের মধ্যেই কেন্দ্রের মনোনীত প্রার্থীরা গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে যাবেন বলে জানা গেছে।
গত রাতে গুলশান কার্যালয়ে ঢাকা বিভাগের নেতাদের নিয়ে বৈঠক হয়েছে। এ ছাড়া বৃহত্তর জেলাগুলোর সমন্বয়ে গঠিত পৃথক পৃথক কমিটি প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করার কাজে ব্যস্ত রয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা প্রার্থী চূড়ান্ত করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার কায়সার কামাল নেত্রকোনার দুর্গাপুরে তার পৌরসভার কথা উল্লেখ করে নয়া দিগন্তকে বলেছেন, তিনি উপজেলা ও পৌর বিএনপির ২১ জন নেতার গোপন ব্যালটের মাধ্যমে প্রার্থী ঠিক করেছেন। ভোটের মাধ্যমে প্রথম হয়েছেন আলহাজ জামাল উদ্দিন এবং দ্বিতীয় হয়েছেন রওশন আলী। তিনি দু’জনের নামই কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন।
জানা গেছে, জামায়াতে ইসলামীসহ ২০ দলীয় জোটের বেশ কয়েকটি শরিক দল পৃথকভাবে বিএনপির কাছে প্রার্থী তালিকা দিয়েছে। এসব দল কমপক্ষে ৫০টি পৌরসভায় নিজ নিজ প্রার্থী দেয়ার আগ্রহের কথা জানিয়েছে। বিএনপির তরফ থেকে মাঠপর্যায়ে খোঁজখবর নিয়ে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হবে।
নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হলেও নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বিএনপির। দলের মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেছেন, মাসাধিককাল থেকে বিরোধী দলের নেতাকর্মী-সমর্থকদের গণগ্রেফতারে সারা দেশ কারাগারে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থায় একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপে নির্বাচনের পরিবেশ বাস্তবে নেই। এ েেত্র নির্বাচন কমিশনের দৃশ্যমান কোনো ভূমিকা এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। তাই সুষ্ঠু, নিরপে ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের স্বার্থে অবিলম্বে গণগ্রেফতার বন্ধ, নেতাকর্মী-সমর্থকদের মুক্তিদানের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের কার্যকর ভূমিকা আমরা প্রত্যাশা করি।
গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচনের শিডিউল আরো ১৫ দিন পিছিয়ে দেয়ার দাবি তুলেছে বিএনপি। জানা গেছে, নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির দাবি নিয়ে এ সপ্তাহে নির্বাচন কমিশনে যেতে পারে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল।
জানা গেছে, পৌরমেয়র পদে দলীয় প্রার্থীদের প্রত্যয়নপত্র দেয়ার জন্য দলের যুগ্ম মহাসচিব মো: শাহজাহানকে মনোনয়ন দিয়েছেন চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। দলের সহসাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম আজাদ নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, আজকের মধ্যে জেলা রিটার্নিং অফিসার অথবা সহকারী রিটার্নিং অফিসার বরাবর এ চিঠি পৌঁছে দেবেন দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা।
জয়ী হওয়ার ছক কষছে আওয়ামী লীগ : পৌর নির্বাচন সামনে রেখে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিরোধী জোটকে কোনোভাবেই ছাড় দিতে নারাজ দলটি। ইতোমধ্যে প্রার্থী নির্বাচন থেকে শুরু করে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার কৌশলের ছক তৈরির কাজটি প্রায় চূড়ান্ত করেছে দলটি। তবে প্রাথমিকভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী কিভাবে যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করা হবে, নির্বাচনে জিততে কোন মাপের প্রার্থী নির্ধারণ করতে হবে সেই কলাকৌশল সম্পর্কে তৃণমূল পর্যায়ে বার্তা পৌঁছে দিয়েছে দলটির হাইকমান্ড। এ ছাড়া নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে মন্ত্রী-এমপিরা যাতে মাঠে নামতে পারেন সে বিষয়টি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে। মন্ত্রী-এমপিরা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে যাতে প্রচারণায় মাঠে নামার সুযোগ পান তা বিবেচনার জন্য আগামীকাল রোববার এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সাথে আওয়ামী লীগ বৈঠক করবে বলে জানা গেছে।
দলীয় সূত্র জানায়, পৌরমেয়র প্রার্থী নির্বাচনের জন্য একটি মনোনয়ন বোর্ড গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। গত বৃহস্পতিবার রাতে দলটির কার্যনির্বাহী সংসদের জরুরি সভায় এ বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। দলের সংসদীয় বোর্ডের সাথে মনোনয়ন বোর্ডে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে আরো পাঁচজন সদস্য। মেয়রপ্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলটির জেলা কমিটি, উপজেলা কমিটি, শহর কমিটি/পৌর কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকগণ এবং স্থানীয় এমপির পরামর্শের ভিত্তিতে একজন প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়ে ওই প্রার্থীর জীবনবৃত্তান্তসহ কেন্দ্রীয় দফতরে আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে হাইকমান্ড। তবে প্রার্থী চূড়ান্ত করবে দল গঠিত মনোনয়ন বোর্ড। তৃণমূল থেকে পাঠানো ওই প্রার্থীর তথ্য যাচাই-বাছাই করে মনোনয়ন বোর্ড চূড়ান্ত করলে কেবলই মনোনীত প্রার্থীকে নৌকা প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হবে।
সূত্র আরো জানায়, প্রার্থী চূড়ান্ত করে একটি তালিকা প্রকাশ করা হবে এবং দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম স্বারিত দল মনোনীত চূড়ান্ত প্রার্থীর তালিকা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে দেয়া হবে। মনোনীত ওই প্রার্থীরাই নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে লড়বেন।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ইতোমধ্যে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকেরা তৃণমূল থেকে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ শুরু করেছেন। তৃণমূল নেতাদের সাথে তারা দফায় দফায় বৈঠক করছেন। স্থানীয় নির্বাচনে একাধিক প্রার্থী থাকায় প্রার্থী চূড়ান্ত করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। তবে যেসব পৌর এলাকায় দলের একাধিক শক্ত প্রার্থী রয়েছে সেখানে বিষয়টি তৃণমূল থেকে সমাধান করা না গেলে তাদের সবাইকে প্রাথমিকভাবে মনোনীত করে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হবে।
পৌর নির্বাচন প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ এমপি নয়া দিগন্তকে বলেন, তৃণমূল থেকে দলীয়ভাবে যেসব প্রার্থীর তালিকা কেন্দ্রে পাঠানো হবে তা যাচাই-বাছাই করে দল গঠিত মনোনয়ন বোর্ড চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি বলেন, পৌর নির্বাচন প্রথমবারের মতো দলীয়ভাবে হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য আওয়ামী লীগ সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। গত সাত বছরে বাংলাদেশে যে উন্নয়ন হয়েছে তা দেশের জনগণ একবাক্যে স্বীকার করে। এই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে জনগণ আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জয়ী করবেন। হাছান মাহমুদ বলেন, জানতে পারলাম বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এ জন্য বিএনপিকে ধন্যবাদ। আশা করি দলটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে সুস্থ ধারার রাজনীতিতে ফিরে আসবে।