কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে রাজনীতি। জামায়াত এখন ইতিহাসের বিষয়। বিএনপি দৌড়ে! আত্মসমালোচনার মুখোমুখি। মাঠে শুধু আওয়ামী লীগ। একে একে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিটি ইচ্ছাই পূরণ হয়েছে। চ্যালেঞ্জ উতরানোর পথ এতোটা সহজ হবে তা হয়তো কেউ ভাবতেও পারেননি।
ছকটা কাটা হয়েছিল আগেই। ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বরের নির্বাচনের পূর্বেই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছিল। দলের ভেতরে কার কি ভূমিকা তাও আদ্যোপান্ত জেনে নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের পর গতি পায় পূর্ব-পরিকল্পনা। একটি প্রধান অধ্যায় ছিল- বিচার। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল যুদ্ধাপরাধের দায়ে হেভিওয়েট বিরোধী নেতাদের বিচারের মুখোমুখি করা। দেশি-বিদেশি চাপ উপেক্ষা করে অটল থাকেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কাদের মোল্লার বিচারকে কেন্দ্র করে বিরোধীদের কোণঠাসা করে ফেলেন তিনি। গণজাগরণ মঞ্চের উত্থানে খাদে পড়ে যায় বিরোধী রাজনীতি। পাল্টা আক্রমণ আসে হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করা হয় তাদের। শুরুতে শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে হটানো হয় শাপলা চত্বর থেকে। পরে অবশ্য পর্দার আড়ালে সমঝোতাও হয়। হেফাজত এখন চুপচাপ। একে একে ফাঁসি কার্যকর হয় কাদের মোল্লা ও কামারুজ্জামানের। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি হবে তা হয়তো অনেকেরই বিশ্বাস হয়নি। শেষ পর্যন্ত তাই হলো। ঢাকার পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, তার ফাঁসি কার্যকর এবং ঠেকানো নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ পরস্পরবিরোধী তৎপরতা চালায়। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে ফাঁসি কার্যকর হয়েছে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে খুব সম্ভবত, এই দুইজনই সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন। তাদের ফাঁসি অন্য অভিযুক্তদের জন্যও বার্তা নিশ্চিত করেছে।
অন্য বিচারগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারও এরইমধ্যে সমাপ্ত হয়েছে। নিম্ন আদালতে রায় হয়েছে বিডিআর বিদ্রোহ মামলার। ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার চলছে নিম্ন আদালতে। ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় নিম্ন আদালত রায় ঘোষণা করেছে। দুর্নীতি আর নাশকতার মামলায় বিএনপির একাধিক নেতার বিরুদ্ধে এরইমধ্যে সাজার রায় ঘোষিত হয়েছে। প্রায় সব বিরোধী নেতার বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মামলার রায় পেতেও বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না।
বাতিল আর উচ্ছেদ পর্বও ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম প্রধান এজেন্ডা। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে উচ্ছেদ করা হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে। যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর অনুরোধ উপেক্ষা করা হয়েছে শক্তভাবে। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে ছিলেন অনেক সরকারি নীতিনির্ধারক। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তা বাতিলের পক্ষে। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর সংবিধান থেকে মুছে ফেলা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের মইনুল রোডের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। সংসদ ভবন এলাকা থেকে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কবর উচ্ছেদের বিষয়টি এখন প্রধান আলোচ্য বিষয়। এই একটি প্রধান এজেন্ডাই এখন বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনরা কার্ড খেলেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একক এবং প্রধান ভূমিকা শেখ হাসিনার। ভারতের সঙ্গে গভীর ও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়েছে। বাংলাদেশে ভারতের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের’ কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে হস্তান্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশের সহযোগিতার মনোভাব আরও স্পষ্ট হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা প্রভাবশালী দেশগুলো বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাইলেও তার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয় ভারত। ঢাকার তখনকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা ৫ই জানুয়ারি নির্বাচনের আগে ভারতকে বুঝানোর জন্য দেশটিতে ছুটে গিয়েছিলেন। কিন্তু দিল্লি তার আহ্বানে সাড়া দেয়নি। উল্টো ভারতের তখনকার পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকায় এসে প্রকাশ্যে একদলীয় নির্বাচনের পক্ষে বক্তব্য রাখেন। ভারতের নির্বাচনে কংগ্রেসের পরাজয়ের পর ঢাকায় বিএনপি শিবিরে এক ধরনের উল্লাস দেখা দেয়। তবে নরেন্দ্র মোদির সরকার গঠনের পরও ভারতের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের সম্পর্কে তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। এটা ঠিক, কংগ্রেসের সঙ্গে বিএনপির কোন ধরনের যোগাযোগই ছিল না। বিজেপির সঙ্গে বিএনপির এক ধরনের যোগাযোগ রয়েছে। তবে সাউথ ব্লক, মোদির নীতিনির্ধারকদের এটা বুঝাতে সবসময়ই তৎপর যে, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারই হচ্ছে ভারতের জন্য সবচেয়ে লাভজনক। যদিও পাশের দেশ নেপাল এবং মালদ্বীপে ভারতের প্রভাব অনেকটাই কমে এসেছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, পশ্চিমা দুনিয়া বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচন চাইলেও শেখ হাসিনার শক্ত পররাষ্ট্রনীতি এবং ভারতের সমর্থনের কারণে পশ্চিমাদের চাওয়া মূল্য পাচ্ছে না। বাংলাদেশে আইএসের তৎপরতা প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়েছিল সরকার। সেসময়ও রাশিয়াসহ কয়েকটি দেশের সমর্থন পায় সরকার।
দেশের ভেতরে রাজনীতিকে কঠিন করে তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার চালের কোন জবাবই খুঁজে পাচ্ছে না প্রতিপক্ষ। তিনি কতদূর যাবেন এ ব্যাপারেও হয়তো ধারণা নেই অনেকের। যুদ্ধাপরাধের কার্ড ব্যবহার করে জামায়াতকে কোণঠাসা করা হয়েছে বহু আগেই। কারাগার অথবা পলাতক- এর বাইরে অবস্থান নেই দলটির নেতাকর্মীদের। দলের সেক্রেটারি জেনারেলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর দল হিসেবে জামায়াতের অস্তিত্ব নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ইসলামপন্থি বলে পরিচিত কোন রাজনৈতিক দলেরই কোন তৎপরতা নেই। জাতীয় পার্টি এখন সরকারদলীয় বিরোধী দল। ১/১১ থেকেই একে একে বিপর্যয় মোকাবিলা করে আসছে বিএনপি। দেশের অন্যতম বৃহত্তম এই রাজনৈতিক দলের এখন সংসদেও কোন প্রতিনিধিত্ব নেই। ৫ই জানুয়ারি নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে বিএনপিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল। এখন অনেকেই বলছেন, সেটা ছিল আসলেই একটি চাল। যে চালে হেরে যান খালেদা জিয়া। তার কার্যালয়কেন্দ্রিক প্রভাবশালী একটি গ্রুপ তাকে এ ব্যাপারে প্রভাবিত করেছিল। অনেকেই অবশ্য বলেন, তারা সরকারেরই লোক। নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনকে জঙ্গিবাদী কর্মসূচি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। দেশের অভ্যন্তরে রাজনীতির বাইরে অন্যসব সেক্টরেও রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর শক্ত নিয়ন্ত্রণ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিরোধীদের দমনে সর্বাত্মক কার্যক্রম বিরামহীনভাবে পরিচালনা করছে। তাদের, এমন কী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে বহুগুণ। শিক্ষকরা এক ধরনের আন্দোলনে ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর তাদের আর খোঁজ মিলছে না। টেলিভিশন টকশোতে একসময় সরকারের কিছু সমালোচনা হতো। তারা এখন উন্নয়ন প্রচারে মনোযোগী হয়েছে। সংবাদপত্রও একই লাইনে রয়েছে।
বাংলাদেশের সবকিছুই এখন শেখ হাসিনার একক নিয়ন্ত্রণে। কোথাও এখন তার বিরোধিতা নেই।