দ্রোহের মার্জিত রূপ : বিদ্রোহের নমনীয় পন্থা

সাহিত্য ও সাংস্কৃতি

2015_11_22_17_57_40_DpHRHnKbZKooSQmwnzo5ECRIjHPr7T_original

 

 

 

 

 

 

 

‘দ্রোহের মার্জিত রূপ’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় একুশে বইমেলা ২০০৯ সালে, শিখা প্রকাশনী থেকে। মোটামুটি বছর ছয়েক আগে। উপন্যাসটির রচয়িতা তানিম যুবায়ের। বইতে লেখা পরিচিতি থেকে জানতে পারলাম তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে অধ্যয়নরত। তবে এতদিনে তিনি নিশ্চয়ই তার স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন।‘দ্রোহের মার্জিত রূপ’  ২৫৩ পৃষ্ঠার এক সুদীর্ঘ উপন্যাস। উপন্যাসটি পুরো শেষ করতে সময় লেগেছে এক সপ্তাহ। টানা পড়তে পারিনি। তবে দ্রুত শেষ করার তাগিদটা বরাবরই ছিলো। মানে একটা আকর্ষণ ছিলো। কাহিনির রহস্য উন্মোচনে বরাবরই উৎসুক ছিলাম। লেখকের পাঠক ধরে রাখার একটা ক্ষমতা আছে এটা স্বীকার করতেই হবে।‘দ্রোহের মার্জিত রূপ’ উপন্যাসটি লেখকের প্রথম উপন্যাস। যেহেতু এটি তার প্রথম উপন্যাস, আমার মনে হয়েছে তার বাস্তব জীবন থেকেও কিছু অভিজ্ঞতা চিত্রিত হয়েছে। মানে লেখকের নিজ পারিপার্শ্বিকতার ছিঁটেফোটা হলেও উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। আরেকটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই- উপন্যাসটি লেখার সময় লেখকের বয়স ছিলো মাত্র বিশ বছর।

এবার উপন্যাসের চরিত্র ও কাহিনি সম্পর্কে আলোচনা করি। উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে আছে তিনজন- রিফাত, পৃথ্বিলা ও মুহিব। তারা তিনজনই একে অপরের সহপাঠি। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তারা পড়াশুনা করছে। রিফাতের পরিবার, তার মাকে নিয়ে আর পৃথ্বিলার বাবাকে নিয়ে। মুহিবের পরিবার বেশ অসচ্ছল। তার বাবা মা দুজনই বলা যায় শয্যাশায়ী। পুরো পরিবারের দায়িত্ব তার কাঁধে। পৃথ্বিলার বাবা পেশায় একজন মনোচিকিৎসক। উপন্যাসেই ফুটে উঠেছে তার কিছুটা মনোবৈকল্য। আর রিফাতের মনপীড়ার কারণ হচ্ছে- সে পিতৃপরিচয়হীন। পৃথ্বিলার বাবা রিফাত ও মুহিবকে নিয়ে মানবজীবন বিধংসী খেলায় মেতে উঠে। তারা মানুষের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট, বঞ্চনা অপ্রাপ্তির জন্য দায়ি করে বিধাতাকে। তারা বিধাতার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে চায়। এর উপায় হিসেবে তারা বেছে নেয় নারীর প্রজনন ক্ষমতাকে বিনষ্ট করা। যাতে আর কোনো মানবসন্তান পৃথিবীর আলো দেখতে না পায়। বিধাতা যাতে নতুন করে মানুষকে দুঃখ-কষ্ট দিতে না পারেন। এছাড়া পৃথ্বিলার বাবা মনে করেন, আত্মহত্যা- এটিও বিধাতার প্রতি বিদ্রোহের একটি রূপ। উপন্যাসের শেষ অংশে আমরা দেখতে পাই- তিনি নিজেও আত্মহত্যা করেছেন। সংক্ষিপ্ত কথায় এটাই হচ্ছে উপন্যাসের মূল কাহিনি। উপন্যাসের নামকরণটিও সার্থক হয়েছে বলে আমি মনে করি। দ্রোহ শব্দের একটি অর্থ বিদ্রোহ। সেক্ষেত্রে বিদ্রোহের মার্জিত রূপটাকেই তারা তুলে ধরেছে। যেখানে কোনো বিদ্রোহে সাধারনত প্রয়োজন হয় হাতিয়ার বা অস্ত্রের। কিন্তু তারা কোনো মারামারি বা রক্তারক্তির দিকে যায়নি। বিধাতার প্রতি তাদের যে ক্ষোভ ঘৃণা, তার বহিঃপ্রকাশে কোনো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়নি। তারা তাদের প্রতিশোধ পন্থা হিসেবে বেছে নিয়েছে রক্তপাতহীন নমনীয় উপায় মানে z factar নামক রাসায়নিক দিয়ে নারীকে সন্তান জন্মদানের অক্ষম করা। ‘দ্রোহের মার্জিত রূপ’ নামকরনটি খুবই প্রাসঙ্গিক। বইটির প্রচ্ছদটিও খুব সুন্দর। যেটি করেছেন মো. মনিরুল ইসলাম। যিনি নামকরা একজন চিত্রশিল্পী।উপন্যাসটির সৃজিত চরিত্রগুলোর মধ্যে বৈচিত্র ও স্বকীয়তা আছে। বিশেষ করে পৃথ্বিলা চরিত্রটি। যে কিনা মানবজাতিকে সম্ভাব্য এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করে। রিফাত এবং মুহিবকেও ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে আনে। উপন্যাসের সংলাপও প্রাসঙ্গিক, গভীরতা সম্পন্ন, শ্রুতিমধুর, সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং বৈচিত্রময়। যেমন ৫৪ পৃষ্ঠায় বাড়িওয়ালা ও রিফাতের মায়ের মধ্যকার কথোপকথন তুলে ধরছি-‘ আপনাকে আজই আমার বাড়িটা ছেড়ে দিতে হবে। কেন ছাড়তে হবে তা নিশ্চয়ই আমাকে আর ব্যাখ্যা করতে হবেনা, বুঝতেই পারছেন। আমার এ ব্যাপারে আর কিছু বলার নেই। যা বলার মানুষজনই বলে দিয়েছে।’
‘তারা যা বলেছে সব মিথ্যা।’
‘ অযথা তর্ক করবেন না। তাতে আপনার ক্ষতির সম্ভাবনাই শুধু বাড়বে। উত্তেজিত জনতার কাছে যুক্তি তর্ক চলে না।’
‘ তাই বলে উত্তেজিত জনতার ভয়ে তাদের সকল মিথ্যাচার আমি মেনে নিবো!’
‘ আপা, আপনাকে অনুরোধ করে বলছি, আপনি আজকেই আমার বাড়িটা ছেড়ে দিন। আপনি যদি মনে করেন, আপনার অতীত কেউ জানেনা তবে আপনি ভুল করছেন। এইসব কাহিনি বেশিদিন লুকিয়ে রাখা যায়না। একদিন না একদিন তা প্রকাশ হবেই। অতএব , আমি বলছি আর কথা না বাড়িয়ে আপনারা চলে যান। অন্যথায় মানুষজন আমার বাড়ি পুড়িয়ে দেবার হুমকি দিচ্ছে।’একথা বলতেই মানুষের মাঝে রব উঠলো, পেট্রোল নিয়ে আয় পেট্রোল নিয়ে আয়। এখনি বাড়ি জ্বালিয়ে দিবো। আর তাতেই অই মাগী বাইরে বেরিয়ে আসবে। বাড়িওয়ালা তাদের ধমক দিলেন। মাকে বললেন, আপনাকে আশ্রয় দিয়ে তো আমি আমার নিজের ক্ষতি ডেকে আনতে পারিনা। বরং আপনাকে বাড়ি ভাড়া দিয়েছি একারণে তারা আমাকেও সন্দেহ করছে।’
‘এই একদিনের নোটিশে আমি কোথায় যাবো!’
‘সেটা আপনার ব্যাপার।’
আরেকটা বিষয় উপন্যাসটির ঘটনা প্রবাহ এগিয়ে গিয়েছে চরিত্রগুলোর নিজস্ব বর্ণনার মাধ্যমে। মানে একেক চরিত্র- ঘটনা গুলো নিজেরাই বলে উপন্যাসটিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে।

এখন উপন্যাসের যে বিষয়গুলো আমার কাছে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বা নেতিবাচক মনে হয়েছে তা হলো স্থান কাল পাত্র সবকিছুকেই যুক্তি দিয়ে বোঝানো। লেখকের একটি ঘটনার গভীরে গিয়ে তার কারণ- ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করার। যেমন পৃথ্বিলা তাদের পরিকল্পনাটি নস্যাৎ করে দিয়েছিলো z factar বিনষ্ট করার মধ্য দিয়ে। কিন্তু এটি ড্রেনের মধ্যে ফেলা হয়েছে- এটি না বললেও হতো। লেখককে মনে রাখতে হবে, উপন্যাস কোনো বৈজ্ঞানিক সত্য প্রকাশ করার জন্য কোনো গবেষণা নয়। যেখানে যুক্তি তর্ক দিয়ে প্রতিটি ঘটনার কারণ এবং পরিনতি ব্যাখ্যা করতে হবে। নিজ আঙ্গিকে বিশ্লেষনের জন্য অনেককিছু পাঠকের উপর ছেড়ে দিতে হয়। উপন্যাস কোনো প্রবন্ধ নয়। যেখানে পাঠক বা দর্শককে সবকিছু ব্যাখ্যা যুক্তি সহকারে বোঝাতে হবে। আরেকটি বিষয়- যেটি খুব বেমানান এবং বিরক্তিকরও বটে। সেটি হলো ভুলে ভরা কম্পোজিং। একটি মান সম্পন্ন চমৎকার একটি উপন্যাসকে  পাঠকরা এই একটি কারণে নিম্নমানের বই হিসেবে মূল্যায়ন করতে পারে। আর প্রুফ রিডিংও খুব দুর্বল। অথবা করা নাও হয়ে থাকতে পারে। এদুটি বিষয় অবশ্য বহুলাংশে প্রকাশকের দায়িত্ব। ‘দ্রোহের মার্জিত রূপ’ উপন্যাসটির প্রকাশকের এব্যাপারে বিশেষ মনোযোগি হওয়া উচিৎ ছিলো।

‘দ্রোহের মার্জিত রূপ’ উপন্যাসটি এককথায় আমাদের গতানুগতিক ভাবনাকে একটি ভিন্ন মাত্রা দিবে। যা মানুষের চিন্তা চেতনার স্তরকে উচ্চতর করতে পারে। পাশাপাশি আমাদের নিত্য দিনের সুখ দুঃখ, ঘাত-প্রতিঘাতের নির্মম রূপ ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *