ভারি মেকআপে লুকানো কষ্ট

বিচিত্র

 

hijra_BG_393306019

 

 

 

 

 

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়- জিনগত ত্রুটির কারণে জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, যাদের জন্মপরবর্তী লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা দেয় মূলত তারাই হিজড়া। বিশ্বে প্রতি ১৫ হাজার নবজাতকের মধ্যে অন্তত একজন (ইন্টারসেক্স ডিস্অর্ডার) হিজড়া রোগে আক্রান্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করছে।

বাংলাদেশে হিজড়াদের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ বলে জানা যায়। তবে হিজড়াদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। রাজধানী ঢাকাতে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় পনের হাজার। বর্তমানে রমনা পার্ক, কুড়িল বাড্ডা, পুরান ঢাকা, খিলগাঁও মার্কেটের পেছনে ভূঁইয়াপাড়াসহ অনেক এলাকাতেই হিজড়ারা দলবদ্ধভাবে বসবাস করে।

মিলাও অন্য হিজড়াদের সঙ্গে কুড়িলের কাছে একটি বাড়িতে অবহেলিত ও মানবেতর জীবন যাপন করছে। মিলা বলেন, সে যখন বুঝতে পারে তাকে পরিবার থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে, আর কখনো বাবা-মায়ের কাছে ফেরা হবে না। তখন বহুবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু সিমা, মিনা, অঞ্জনাসহ অন্য হিজড়ারা তাকে সান্তনা দিয়ে আগলে রাখে।

হিজড়াদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের অসহায় এবং ভিকটিম বলে মনে করে। পরিবার-সমাজ থেকে আলাদা, সবার কাছে অবহেলা পেয়ে আসলে মানুষ নয়, হিজড়া হিসেবেই বেড়ে উঠছে তারা।

মিলা বলেন, নারী না-হয়েও হিজড়ারা নিজেদের নারীরূপে ভেবে থাকে, নারীদের নামেই পরিচিত হতে পছন্দ করে। নারীদের পোশাক, অলংকার-কসমেটিক এদের প্রথম পছন্দ।কড়া মেকআপ, জমকালো সাজে তারা ঘুরে বেড়ায়। অনেক সময় তাদের এই সাজ ও অঙ্গভঙ্গি দেখে অনেকেই বিদ্রুপ করে। কিন্তু একবারও কেউ কি জানতে চেয়েছে আমরা এভাবে কেন থাকি? দিনে রাতে চড়া-লিপিস্টিক আর কাজলের আড়ালে নিজেদের দুঃখ লুকাই আর নেচে গেয়ে সবার জন্য আনন্দ বিলাই।

প্রতিকুল পরিবেশের ফলে বাসস্থান, চিকিৎসা আর শিক্ষার মতো অতি প্রয়োজনীয় মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত তারা। চরম অস্বাস্থ্যকর ঘিঞ্জি এলাকায় গাদাগাদি করে বসবাস করে এই হিজড়ারা।

অস্বাস্থ্যকর জীবন যাপন ও যৌন আচরণের ফলে বিভিন্ন রোগ এবং ভয়াবহ এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেশি এই জনগোষ্ঠীর।

আর নিরাপত্তা, বিনোদন এসব কেতাবি শব্দের সঙ্গে কখনো এদের পরিচয় হয়েছে বলেও মনে পড়ে না হিজড়া মিলার। কিছু কিনতে গেলে দোকানীরা বলবে, আপা আসেন কী নেবেন দেখেন, জ্বর হলে মা মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে, বাবা জানতে চাইবে কি খেতে ইচ্ছা করে? খুব ইচ্ছা ভোট দেয়ার, তার কাছে এসে প্রার্থীরা দোয়া চাইবে, ভোট দিতে ‍অনুরোধ করবে। জ্বর হলেও একদিন এ্যাপোলো হাসপাতালে যাওয়ার ইচ্ছা, সিনেমা দেখতে এসি হলে তো একদিন যেতেই হবে মনের মানুষটিকে নিয়ে।

এগুলো সবই দিবাস্বপ্ন মিলার।

আসলে অধিকার বলতে তেমন কিছুই নেই। তাদের জন্য অধিকার মানে শুধু বেঁচে থাকা, মনের মানুষ হয়তো একজন আছে কিন্তু সুখের সংসার কখনো কোনো হিজড়ার হয়নি। হিজড়াদের অধিকার রক্ষায় এখনও প্রতিষ্ঠা পায়নি উল্লেখযোগ্য কোনো আইনি সহায়তা কেন্দ্র। উত্তরাধিকার প্রাপ্তিতে রয়েছে প্রতিবন্ধকতা ও বঞ্চনার অসংখ্য ইতিহাস। আজ পর্যন্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো পদে দেখা যায়নি কোনো হিজড়াকে।

পারিবারিক ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয়ে আলাদা হয়ে পড়া অনেক হিজড়া বাঁচার তাগিদে যৌন পেশাকেই বেছে নেয়।
প্রতিরাতে ভারি মেকআপ দিয়ে সারাদিনের কান্না লুকায় এই মিলারা।

হিজড়াদের মানবাধিকার এবং এইচআইভিসহ বিভিন্ন রোগ থেকে নিজেদের রক্ষা ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের মাধ্যেমে সুস্থ ও স্বাভাবিক সমাজে সম্পৃক্ত করতে ১৯৯৬ সাল থেকে কাজ করছে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি।

বন্ধুর প্রধান নির্বাহী সালেহ আহমেদ বলেন, সরকার ২০১১ সালে হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দিয়েছে, এখন তাদের স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে পরিবারের ভেতরে থেকেই শিক্ষা ও কাজের সুযোগ দিয়ে উন্নত জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আর এটা আমাদের সবার দায়িত্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *