একদিকে সিরিয়ায় আইএসের ওপর ব্যাপক বিমান হামলা, অন্যদিকে জঙ্গিদের ধরতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ ফ্রান্সজুড়ে দেড় শতাধিক পুলিশি অভিযানের মাধ্যমে প্যারিসে ভয়াবহ হামলার পাল্টা জবাব দিতে শুরু করেছে ফরাসি কর্তৃপক্ষ।
ফ্রান্সের কেঁৗসুলিরা গতকাল সোমবার জানিয়েছেন, শুক্রবারের ভয়াবহ হামলার মাস্টারমাইন্ড (মূল পরিকল্পনাকারী) হিসেবে বেলজিয়ামে জন্মগ্রহণকারী আবদেল হামিদ আবা’উদকে শনাক্ত করেছেন তারা। তিনি বর্তমানে সিরিয়ায় রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া আরও দুই হামলাকারীর পরিচয় প্রকাশ করা হয়েছে। গতকাল দেশব্যাপী পরিচালিত অভিযানে বিপুল সংখ্যক অস্ত্র উদ্ধার এবং ২৩ জনকে আটক ও অন্তত ১০৪ সন্দেহভাজনকে গৃহবন্দি করা হয়েছে।
প্রতিবেশী বেলজিয়ামও ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করছে। ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নতুন করে সন্ত্রাসী হামলার চক্রান্ত হচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন ফরাসি প্রধানমন্ত্রী ম্যানুয়েল ভলস। নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গতকাল ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। হামলার তিন দিন পর স্বাভাবিক চেহারায় ফিরতে শুরু করেছে রাজধানী প্যারিস।
গতকাল আবারও আলোকোজ্জ্বল হয়ে ওঠে আইফেল টাওয়ার। রাস্তায় যানবাহন ছিল চোখে পড়ার মতো। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাটও খোলা ছিল। ফরাসি সংস্কৃতিমন্ত্রী ফ্লেউর পেলারিঁ কনসার্টসহ বিভিন্ন উৎসব চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের ৬টি স্থানে শুক্রবার রাতের ওই বর্বর হামলায় নিহত হয়েছেন ১২৯ জন। আহত হয়েছেন ৩৫০ জনের বেশি। হামলায় সরাসরি জড়িত সাত জঙ্গি ঘটনাস্থলেই পুলিশের গুলি ও আত্মাঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মারা যায়। এদিকে আইএসকে ধ্বংস করার অঙ্গীকার করেছেন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ। গতকাল দেশটির পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে সিরিয়ায় হামলা আরও জোরদার করার কথা জানান তিনি। ‘ফ্রান্স যুদ্ধে রত’ উল্লেখ করে দেশটিতে জরুরি অবস্থা তিন মাস বাড়াতে আইন করার প্রস্তাব এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ফরাসি সংবিধান সংশোধনের কথা বলেন ওলাঁদ।
আইএসের রাজধানীতে ফরাসি হামলা: প্যারিসের ছয় স্থানে শুক্রবার রাতে একযোগে চালানো হামলার ঘটনাকে ‘যুদ্ধের শামিল’ আখ্যায়িত করে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ ‘নির্দয়’ জবাব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এর দু’দিন পর রোববার রাতে সিরিয়ার রাকা শহরে ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিদের একটি শক্ত ঘাঁটিতে ফরাসি বিমান হামলা চালিয়েছে। শহরটি আইএসের রাজধানী হিসেবে পরিচিত। ফরাসি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, এ অভিযানে আইএসের একটি কমান্ড পোস্ট, নিয়োগ কেন্দ্র, বিস্ফোরক গুদাম ও প্রশিক্ষণ শিবির বিধ্বস্ত হয়।
মন্ত্রণালয় জানায়, মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে জর্ডান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ১২টি যুদ্ধ বিমানের সাহায্যে ফ্রান্স এ অভিযান চালায়। লক্ষ্যবস্তুতে ফেলা হয় ২০টি বোমা। ব্রিটেনভিত্তিক সিরীয় মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ফর সিরিয়ান অবজারভেটরি জানায়, রোববার রাতভর অন্তত ৩৬টি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। এর কোনোটি বিমান হামলার কারণে, কোনোটি হয়েছে অস্ত্র ও বোমা বিস্ফোরণের ফলে। তবে হামলার পর আইএসের একটি মিডিয়া উইং দাবি করে, ওই স্থানগুলো পরিত্যক্ত ছিল। ফলে হামলায় কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
মাস্টারমাইন্ড চিহ্নিত: ফ্রান্সে নির্মম হামলার মূল পরিকল্পনাকারী বা মাস্টারমাইন্ড হিসেবে বেলজিয়ামের এক আইএস সদস্যকে চিহ্নিত করেছে ফ্রান্স। গতকাল ফরাসি কর্তৃপক্ষ জানায়, ওই জঙ্গির নাম আবদেল হামিদ আবা’উদ (২৯)। তিনি বর্তমানে সিরিয়ায় রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই জঙ্গি ফ্রান্সগামী একটি দ্রুতগতির ট্রেন ও প্যারিসের একটি গির্জায় ব্যর্থ হামলার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন বলে জানিয়েছে ফরাসি মিডিয়া। তাকে ইউরোপে আগের কয়েকটি পরিকল্পিত হামলারও হোতা বলে মনে করা হয়।
ফ্রান্সের আরটিএল রেডিওর বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, মরক্কো বংশোদ্ভূত আবা’উদ বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের উপশহর মলেনবিকের বাসিন্দা। সেখানে প্যারিস হামলায় অংশ নেওয়া জঙ্গিদের আস্তানা রয়েছে। আরটিএল আবা’উদকে আইএসের ‘অন্যতম সক্রিয় খুনি’ বলে পরিচয় দিয়েছে। গত জানুয়ারিতে বেলজিয়ামের পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে তার গ্রুপের দুই জঙ্গি নিহত হয়েছিল।
বেলজিয়ামের গণমাধ্যমের খবর- নিজের ১৩ বছর বয়সী ছোট ভাই ইউনিস আবা’উদকে আইএসে যোগ দেওয়ায় তার ভূমিকা ছিল। আইএসের সর্বকনিষ্ঠ যোদ্ধা মনে করা হয় ইউনিসকে। আবদেল হামিদ আবা’উদ ২০১৩ সালে সিরিয়ার আইএস জঙ্গিগোষ্ঠীতে যোগ দেন।
মলেনবিক কিছুটা পশ্চাৎপদ এলাকা। গতকাল ওই এলাকার একটি বাড়ি ঘিরে বড় ধরনের অভিযান চালায় বেলজিয়ামের পুলিশ। হামলার পর ফ্রান্স থেকে বেলজিয়ামে প্রবেশ করা জঙ্গি আবদেসালাম সালাহের (২৬) সন্ধানে এ অভিযান চালানো হয়। শেষ পর্যন্ত কাউকে আটক করতে পারেনি তারা। গত শনিবার থেকেই এলাকাটির বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ। সেখানে এ পর্যন্ত তিনজনকে আটক করা হয়েছে। সালাহ বেলজিয়ান বংশোদ্ভূত ফরাসি নাগরিক। হামলার ঘটনায় নিহত সাত জঙ্গির একজনের ভাই এই সালাহ। তার আরেক ভাই বেলজিয়ামে গ্রেফতার হয়েছেন। হামলার পর বেলজিয়ান নম্বরপ্লেটধারী যে দুটি গাড়ি প্যারিসে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে, সেগুলো ওই তিন ভাইয়ের দু’জনের নামে ভাড়া করা হয়েছিল। বিবিসি জানিয়েছে, হামলার কয়েক ঘণ্টা পর সালাহকে বেলজিয়াম সীমান্তে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল ফরাসি পুলিশ। কাগজপত্র পরীক্ষা করে তাকে ও তার সহযোগীদের চলে যেতে দেয় তারা। তখনও ওই হামলায় সালাহর সম্পৃক্ততা জানা ছিল না।
প্যারিসে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানো আরও দুই জঙ্গির নাম গতকাল প্রকাশ করেছে ফ্রান্স। তাদের একজনের জন্ম সিরিয়ায়, আরেকজন ফরাসি নাগরিক। বাটাক্লঁ কনসার্ট হলের বাইরে আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো জঙ্গির নাম সামি আমিমুর (২৮)। ২০১২ সালে তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আনা হয়েছিল। বিচার বিভাগীয় নজরদারিতেও রাখা হয়েছিল তাকে। তবে ২০১৩ সালে সে পালিয়ে গেলে তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। গতকাল তার তিন স্বজনকে আটক করেছে ফরাসি পুলিশ। তারা জানিয়েছে, দুই বছর আগে আমিমুর সিরিয়া গিয়েছিল। স্তাদে দে ফ্রান্স স্টেডিয়ামের বাইরে বিস্ফোরণ ঘটানো জঙ্গির নাম আহমদ আল মোহাম্মদ (২৫) বলে জানিয়েছে পুলিশ। আহমদের মৃতদেহের পাশে সিরিয়ার পাসপোর্ট পাওয়া গিয়েছিল। সিরিয়ার ইদলিবের এই বাসিন্দা গত অক্টোবরে গ্রিস হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করে। আঙুলের ছাপ মিলিয়ে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন তদন্তকারীরা।
আরেক আত্মঘাতী ওমর ইসমাইল মোস্তেফাইর নাম আগেই প্রকাশ করেছিল ফ্রান্স। গতকাল তুরস্ক জানিয়েছে, মোস্তেফাই সম্পর্কে গত বছর ফ্রান্সকে তথ্য দিয়েছিল তারা। কিন্তু ফ্রান্স তাতে সাড়া দেয়নি। এদিকে বেলজিয়ামে আটক দুই সন্দেহভাজনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ উত্থাপন করেন কেঁৗসুলিরা। বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী চার্লস মাইকেল দেশটিতে সন্ত্রাসীদের নির্মূল করার ঘোষণা দেন।
ইউরোপে আরও হামলার আশঙ্কা ফ্রান্সের: ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ম্যানুয়েল ভলস গতকাল এক রেডিওকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করে_ প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার পর ফ্রান্স ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে নতুন করে আরও হামলার চক্রান্ত করা হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, প্যারিসে হামলার পরিকল্পনা সিরিয়ায় করা হয়েছে এবং সেখান থেকেই এর সব আয়োজন করা হয়।
ম্যানুয়েল ভলস বলেন, ‘আমরা জানি হামলার পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। আর বিভিন্ন প্রস্তুতি এখনও নেওয়া হচ্ছে। এসব পরিকল্পনা শুধু ফ্রান্সের বিরুদ্ধেই নয়, বরং ইউরোপের অন্যান্য দেশের বিরুদ্ধেও হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ফ্রান্স কোনো একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে লড়ছে না, বরং একটি ‘সন্ত্রাসী সেনাবাহিনী’র সঙ্গে লড়ছে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আইএস আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হতে পারবে না। কিন্তু এই সন্ত্রাসী সংগঠনটি আমাদের দুর্বল ও বিভক্ত করতে চেষ্টা করবে।’ ফ্রান্সকে দীর্ঘদিন সন্ত্রাসী হামলার ভয় নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, শুক্রবারের হামলার পরিকল্পনা ফ্রান্সের বাইরে করা হয়েছিল বলে তদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কর্মকর্তারা সমস্ত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন- ভয়াবহ ওই হামলার পরিকল্পনা ফ্রান্সের বাইরে বসে করা হয়েছিল। ফ্রান্সে তাদের কারা সহায়তা করেছিল তা জানতেও তদন্ত চলছে। শিগগিরই তাদের খুঁজে বের করা হবে।’
১৫০ স্থানে অভিযান, গৃহবন্দি ১০৪ জন: প্যারিস হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন জঙ্গিদের খোঁজে এ পর্যন্ত ফ্রান্সজুড়ে ১৫০টি জায়গায় অভিযান চালায় পুলিশ। প্যারিসের ববিনিসহ গনব্লাঁ, তুঁঁলুজ, ?লিয়ঁসহ বেশক’টি শহরে সন্দেহভাজন বাড়িতে এসব অভিযান চালানো হয়। ফরাসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এসব অভিযানে অন্তত ২৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ছাড়া সন্দেহভাজন ১০৪ জনকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে।
গতকাল ভোরে লিয়ঁ শহরে ১৩টি অভিযান চালানো হয়। এতে পাঁচজনকে আটক ও ৩১টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে রকেট লঞ্চার, একটি কালাশনিকভ অ্যাসল্ট রাইফেল, বুলেটপ্রুফ ভেস্ট ও কয়েকটি হ্যান্ডগান। এদিকে হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ইতালির তুরিনে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জার্মানি কর্তৃপক্ষ আলজেরিয়ার এক আশ্রয়প্রার্থীকে গ্রেফতার করে।
নীরবতা পালন: শুক্রবারের নৃশংস হামলায় নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করেছে ফ্রান্স। গতকাল দুপুরে দেশজুড়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। ঘড়ির কাঁটা ১২টার ঘর ছুঁতেই যে যেখানে ছিলেন দাঁড়িয়ে পড়েন। নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে স্মরণ করেন ভয়াবহ হামলার শিকার মানুষদের। এ সময় স্তব্ধ হয়ে যায় পুরো প্যারিস। রাজধানীর সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে নীরবতা পালন কর্মসূচিতে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে যোগ দেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ। হামলার স্থানগুলোতেও বিপুল সংখ্যক মানুষ জড়ো হন নীরবতা পালনের জন্য।
এ ছাড়া ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশও এ কর্মসূচি পালন করে। নিহতদের প্রতি সম্মান জানাতে আগামী বৃহস্পতিবার সূর্যাস্ত পর্যন্ত হোয়াইট হাউস ও যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য সরকারি ভবনে দেশটির জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। গতকাল ওবামা তুরস্কে জি২০ সম্মেলনে আইএসকে ‘শয়তানের মুখ’ বলে উল্লেখ করেন। তবে তিনি সিরিয়ায় স্থলসেনা পাঠানোর বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে বলেন, স্থলবাহিনী পাঠানো হবে ভুল পদক্ষেপ। খবর : বিবিসি, এএফপি, সিএনএন, গার্ডিয়ান, রয়টার্স।