গত শুক্রবার প্যারিসে যে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হামলায় শতাধিক নিরপরাধ নাগরিকের প্রাণহানি এবং প্রায় দুইশ’ জন আহত হলো, তা স্বভাবতই কেবল ফ্রান্স বা ইউরোপে নয়, বরং বিশ্ব সম্প্রদায়কেই ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। প্যারিস শুধু বিশ্বের অন্যতম প্রধান ক্ষমতাধর রাষ্ট্র ফ্রান্সের রাজধানী নয়; গণতন্ত্র, সাম্য, ধর্মনিরপেক্ষতা আন্দোলনের সূতিকাগারও। বর্তমান বিশ্বের শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, চারু ও কারুকলা তথা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় প্যারিস গত কয়েক শতকে সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া অনেকের কাছে প্যারিস মানে এক স্বপ্নপুরী, মুক্তজীবন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার স্বর্গোদ্যান। আলোকিত সেই প্যারিসই যখন অন্ধকারের বাসিন্দাদের হামলায় রক্তাক্ত হলো, তখন জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতি নির্বিশেষে বিশ্ববাসী শঙ্কিত হবেই। এটাই স্বাভাবিক।
প্যারিসে এমন দুনিয়া নাড়িয়ে দেওয়া হামলার ঘটনা এমন এক সময় ঘটল, যখন মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া ও ইরাকজুড়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী একে অপরের সঙ্গে যেমন সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে, তেমনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসবাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ জোগান দিয়ে যাচ্ছে। আবার বিভিন্ন রাষ্ট্র বা সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীও একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন পেয়ে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই হানাহানি থেকে অনেক দিন দূরে থাকলেও সম্প্রতি রাশিয়া সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পক্ষ হয়ে আইসিসবিরোধী বিমান হামলার মধ্য দিয়ে দৃশ্যপটে হাজির হয়েছে।
প্যারিস হামলার পরপর স্বভাবতই জাতিসংঘসহ বিশ্বে নেতৃত্ব ফ্রান্সের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন এবং দেশটির নিরাপত্তার ব্যাপারে পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। ফরাসি নেতৃবৃন্দ প্রমাণ পেয়েছেন এই হামলার পেছনে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আইসিস জড়িত। সন্ত্রাসবাদী ওই সংগঠনের পক্ষ থেকেও হামলার পরপর দায় স্বীকার করা হয়েছে এবং হতাহতের সংখ্যা নিয়ে পৈশাচিক উল্লাস প্রকাশ করা হয়েছে। ফ্রান্স গত বছর থেকেই ইরাক ও সিরিয়ায় আইসিসবিরোধী বিমান হামলা চালিয়ে আসছিল। প্যারিস হামলার পর প্রেসিডেন্ট ফঁদ্ধাসোয়া ওলাঁদ ঘোষণা দিয়েছেন যে, তার দেশ আরও সক্রিয়ভাবে আইসিসবিরোধী অভিযান চালিয়ে যাবে। এই হামলার আগেই ফ্রান্স তার সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমানবাহী জাহাজ চার্লস দ্য গলকে ভূমধ্যসাগারে মোতায়েন করেছে আইসিসবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে। আগামী দিনগুলোতে স্বভাবতই ওই জঙ্গিগোষ্ঠীর স্থাপনা ও আবাসগুলোতে ফ্রান্সের আক্রমণ আরও জোরদার হবে।
আইসিস আগেই ঘোষণা দিয়েছিল যে, যেসব রাষ্ট্র আইসিসবিরোধী জোটে অংশগ্রহণ করবে, তারা সেসব দেশে নিজেদের সমর্থকদের মাধ্যমে সন্ত্রাসী হামলা পরিচালনা করবে। খুব সম্ভবত তারই অংশ হিসেবে আমরা দেখেছি গত বৃহস্পতিবার লেবাননের রাজধানী বৈরুতে শিয়া অধ্যুষিত এলাকায় বেশ কয়েকটি আত্মঘাতী আক্রমণ হয়েছে। এতে অর্ধশতাধিক নর-নারী প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন শতাধিক। বৈরুতের ওই এলাকায় ছিল হিজবুল্লাহর ঘাঁটি। ওই গোষ্ঠীও ইতিমধ্যে সিরিয়ায় আসাদ সরকারের সমর্থনে আইসিসবিরোধী অভিযানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে আসছে। প্যারিসের হামলাও সম্ভবত আইসিসের একই ঘোষণার সূত্র ধরে পরিচালিত।
ফ্রান্সে যে সাম্প্রতিককালে এটাই প্রথম সন্ত্রাসবাদী হামলা তা নয়। এ বছর জানুয়ারিতে প্যারিসে শার্লি এবদো নামের কার্টুন পত্রিকার অফিসে হামলা করেছিল বন্দুকধারীরা। ওই হামলায় পুলিশ, সাংবাদিকসহ এক ডজনের বেশি মানুষ নিহত হয়। এরপর থেকেই ফ্রান্সে উচ্চ মাত্রার সতর্কতা জারি ছিল। তা সত্ত্বেও খোদ রাজধানীতে শুক্রবারের সমন্বিত সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাকে অনেকে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা ব্যবস্থার বড় ধরনের ব্যর্থতা হিসেবেই চিহ্নিত করছেন। একই সঙ্গে স্মর্তব্য যে, ইউরোপ বা পশ্চিমা জগৎ থেকে অনেক তরুণ-তরুণী মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে আইসিসে যোগ দিচ্ছে। তাদের মধ্যে ফ্রান্স থেকে সবচেয়ে বেশি_ প্রায় এক হাজার। যদিও এদের মধ্যে বহুলাংশ উত্তর আফ্রিকা থেকে আগত অভিবাসীদের সন্তান যারা নিজেদের ফরাসি জীবনধারার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি। কিন্তু তারা ছাড়াও ফ্রান্স থেকে আইসিসে কিছু শ্বেতাঙ্গ তরুণও যোগ দিয়েছে, যারা আইসিসের ভাবধারায় আকৃষ্ট হয়ে তথাকথিত ইসলামী খেলাফত বা ‘জিহাদ’ করতে মধ্যপ্রাচ্যে চলে গেছে। এ ছাড়াও খোদ ফ্রান্সেই এক বা একাধিক সন্ত্রাসী সেল গঠিত হয়ে থাকতে পারে যারা আইসিসের নির্দেশে ফ্রান্সসহ ইউরোপে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। এমন আশঙ্কাও অমূলক হবে না যে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে যে শরণার্থী স্রোত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, সেখানেও কিছু আইসিস সদস্য ছদ্মবেশে ঢুকে পড়তে পারে এবং ইউরোপে গিয়ে তাদের সমর্থক ও সহযোগী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যোগ দিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পারে। সব মিলিয়ে প্যারিস হামলার পর বিশ্ব যে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে সন্দেহ সামান্যই।
খোদ মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি আরও নাজুক। বিবদমান বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে কে যে চূড়ান্ত অর্থে কার হয়ে লড়াই করছে, সেটা বোঝা মুশকিল। আমরা দেখতে পাচ্ছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একদিকে যেমন আইসিসবিরোধী বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে; অন্যদিকে আইসিসের হাতেই শোভা পাচ্ছে অত্যাধুনিক মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র। দেখা যাচ্ছে, তুরস্ক একদিকে যেমন ন্যাটোর সদস্য হিসেবে আইসিসের বিরুদ্ধে হামলা পরিচালনা করছে; অন্যদিকে আইসিসের বিরুদ্ধে মাঠপর্যায়ে সবচেয়ে সক্রিয় সংগ্রামরত কুর্দি বাহিনীর ওপর বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। কখনও মনে হচ্ছে লড়াইরত পক্ষগুলোর মধ্যে কেউ কেউ একে অন্যের সহযোগী; আবার কখনও মনে হচ্ছে তারা সহযোদ্ধার পিঠেই ছুরিকাঘাত করছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে আইসিসবিরোধী দাবি করে; কিন্তু রাশিয়া যখন আসাদের সমর্থনে বিমান হামলা চালাচ্ছে, তখন ওয়াশিংটন মস্কোকে সমর্থনের বদলে মধ্যপ্রাচ্যে সংযত হওয়ার ছবক দিচ্ছে। আইসিস একদিকে সৌদি আরবের রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ ঘোষণা করেছে; অন্যদিকে সুনি্ন মতাবলম্বী সৌদি আরবের প্রতিপক্ষ আরবের বিভিন্ন শিয়া মসজিদ ও ধর্মীয় স্থাপনায় আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। একদিকে সৌদি আরব আইসিসবিরোধী লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে; অন্যদিকে আইসিস সেই সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলোর কাছ থেকে অর্থের জোগান পাচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের এই গভীর অন্তর্দ্বন্দ্ব একদিকে যেমন বৃহৎ শক্তিবর্গের শক্তি প্রদর্শনের ক্রীড়াক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে; অন্যদিকে মুসলিম বিশ্বের মধ্যে শিয়া ও সুনি্ন বিভেদ আরও প্রকট ও রক্তাক্ত করে তুলছে। গত কয়েক মাস ধরে ইয়েমেনের শিয়া মতাবলম্বী হুতু উপজাতিদের ওপর সৌদি বিমান বাহিনী নির্বিচার বোমা হামলা চালিয়ে গেলেও তা বিশ্ববিবেক তো বটেই, মুসলিম বিশ্বকেও নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়নি দৃশ্যত শিয়া-সুনি্ন বিভেদের কারণেই। সৌদি রাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে ইয়েমেনের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্তনাদ চাপা পড়ে গেছে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ও শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশেও ইয়েমেনে সৌদি আরবের নির্বিচার হামলা নিয়ে কোনো প্রতিবাদ দূরে থাক, সমবেদনাও চোখে পড়েনি।
মুসলিম সমাজ ও সাবির্ক অর্থে গোটা বিশ্ব এখন গভীর সংকটময় পরিস্থিতিতে স্বীকার করতেই হবে। ভৌগোলিকভাবে দূরে থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি তো বটেই, প্যারিসের মতো শহরে সন্ত্রাসী হামলার ঢেউও বাংলাদেশ এড়িয়ে যেতে পারে না। কারণ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি প্রবাসী রয়েছে। ওই অঞ্চলগুলোতে যে কোনো অস্থিতিশীলতা দেশীয় সমাজ ও অর্থনীতিকে প্রভাবিত করবেই। বিশেষ করে প্যারিসের সঙ্গে অর্থনীতি ছাড়াও আমাদের শিল্প-সাহিত্যের যোগসাজশ স্পষ্ট। কেবল তাই নয়, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের ছায়া বাংলাদেশেও বিভিন্ন মাত্রায় পড়েছে। যে কারণে প্যারিস হামলার পর আমাদের দেশেও সবার মধ্যে শোক, সমবেদনা ও শঙ্কা ছিল স্পষ্ট। আমাদের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ওই হামলার নিন্দা জানিয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে ফ্রান্সের পাশে থাকবে বাংলাদেশ।
আমরা জানি, বাংলাদেশের সরকার ও জনসাধারণ বরাবরই শান্তিপ্রিয় এবং যে কোনো ধরনের সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। প্যারিস বা মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন হামলা ও হতাহতের ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই আমরা মর্মাহত। এ ছাড়াও এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে ধর্মীয় লেবাসধারী বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন অতীতে বাংলাদেশকেও অস্থিতিশীল করতে চেয়েছে। এখনও যে তারা তাদের হীন কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য সংগঠিত হওয়ার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তার প্রমাণ আমরা মাঝেমধ্যেই দেখতে চাই। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চেতনা, সহিষ্ণু সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেসব গোষ্ঠীর চক্ষুশূল, তারাও এসব জঙ্গি গোষ্ঠীকে উস্কানি ও মদদ দিয়ে থাকে। এসব জঙ্গি ও উগ্রবাদী গোষ্ঠী যাতে কখনোই বাংলাদেশে শিকড় বিস্তার করতে না পারে, সেজন্য সরকারের পাশাপাশি জনসাধারণকেও সর্বদা সতর্ক ও সচেষ্ট থাকতে হবে। আমাদের তরুণ সমাজ যেন ধর্মের নামে কোনো ধরনের সন্ত্রাস বা সংঘাতমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত না হয়, সেজন্য উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম সর্বস্তরে চালিয়ে যেতে হবে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন মসজিদের ইমাম, স্কুল ও মাদ্রাসার ধর্মীয় শিক্ষক, আলেম-ওলামারা। একই সঙ্গে সরকারকেও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে আমাদের ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ও দীর্ঘমেয়াদি দায়িত্ব রয়েছে।
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ যাতে বাংলাদেশেও শিকড় ছড়াতে না পারে, সেজন্য অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও সক্রিয় থাকতে হবে। বিশেষ করে সার্ক ও আসিয়ানের মতো আঞ্চলিক সংস্থাভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অর্থায়ন প্রক্রিয়া ও সূত্র গভীর পর্যবেক্ষণে রাখতেই হবে। সামাজিক উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ অর্থও অনেক ক্ষেত্রে জঙ্গিবাদ বিস্তারের কাজে ব্যবহৃত হওয়ার নজির বাংলাদেশে কম নেই। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রোধে অন্য যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে রাজনৈতিক ঐকমত্য। গণতান্ত্রিক, উদার, অসাম্প্রদায়িক, উন্নয়নকামী যে বাংলাদেশ আমরা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জন করেছি; তা রক্ষা ও আরও সমৃদ্ধ করে তুলতে সব রাজনৈতিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে ঠিক একাত্তরের মতোই।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমডোর
প্যারিস হামলার পরপর স্বভাবতই জাতিসংঘসহ বিশ্বে নেতৃত্ব ফ্রান্সের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন এবং দেশটির নিরাপত্তার ব্যাপারে পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। ফরাসি নেতৃবৃন্দ প্রমাণ পেয়েছেন এই হামলার পেছনে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আইসিস জড়িত। সন্ত্রাসবাদী ওই সংগঠনের পক্ষ থেকেও হামলার পরপর দায় স্বীকার করা হয়েছে এবং হতাহতের সংখ্যা নিয়ে পৈশাচিক উল্লাস প্রকাশ করা হয়েছে। ফ্রান্স গত বছর থেকেই ইরাক ও সিরিয়ায় আইসিসবিরোধী বিমান হামলা চালিয়ে আসছিল। প্যারিস হামলার পর প্রেসিডেন্ট ফঁদ্ধাসোয়া ওলাঁদ ঘোষণা দিয়েছেন যে, তার দেশ আরও সক্রিয়ভাবে আইসিসবিরোধী অভিযান চালিয়ে যাবে। এই হামলার আগেই ফ্রান্স তার সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমানবাহী জাহাজ চার্লস দ্য গলকে ভূমধ্যসাগারে মোতায়েন করেছে আইসিসবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে। আগামী দিনগুলোতে স্বভাবতই ওই জঙ্গিগোষ্ঠীর স্থাপনা ও আবাসগুলোতে ফ্রান্সের আক্রমণ আরও জোরদার হবে।
আইসিস আগেই ঘোষণা দিয়েছিল যে, যেসব রাষ্ট্র আইসিসবিরোধী জোটে অংশগ্রহণ করবে, তারা সেসব দেশে নিজেদের সমর্থকদের মাধ্যমে সন্ত্রাসী হামলা পরিচালনা করবে। খুব সম্ভবত তারই অংশ হিসেবে আমরা দেখেছি গত বৃহস্পতিবার লেবাননের রাজধানী বৈরুতে শিয়া অধ্যুষিত এলাকায় বেশ কয়েকটি আত্মঘাতী আক্রমণ হয়েছে। এতে অর্ধশতাধিক নর-নারী প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন শতাধিক। বৈরুতের ওই এলাকায় ছিল হিজবুল্লাহর ঘাঁটি। ওই গোষ্ঠীও ইতিমধ্যে সিরিয়ায় আসাদ সরকারের সমর্থনে আইসিসবিরোধী অভিযানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে আসছে। প্যারিসের হামলাও সম্ভবত আইসিসের একই ঘোষণার সূত্র ধরে পরিচালিত।
ফ্রান্সে যে সাম্প্রতিককালে এটাই প্রথম সন্ত্রাসবাদী হামলা তা নয়। এ বছর জানুয়ারিতে প্যারিসে শার্লি এবদো নামের কার্টুন পত্রিকার অফিসে হামলা করেছিল বন্দুকধারীরা। ওই হামলায় পুলিশ, সাংবাদিকসহ এক ডজনের বেশি মানুষ নিহত হয়। এরপর থেকেই ফ্রান্সে উচ্চ মাত্রার সতর্কতা জারি ছিল। তা সত্ত্বেও খোদ রাজধানীতে শুক্রবারের সমন্বিত সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাকে অনেকে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা ব্যবস্থার বড় ধরনের ব্যর্থতা হিসেবেই চিহ্নিত করছেন। একই সঙ্গে স্মর্তব্য যে, ইউরোপ বা পশ্চিমা জগৎ থেকে অনেক তরুণ-তরুণী মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে আইসিসে যোগ দিচ্ছে। তাদের মধ্যে ফ্রান্স থেকে সবচেয়ে বেশি_ প্রায় এক হাজার। যদিও এদের মধ্যে বহুলাংশ উত্তর আফ্রিকা থেকে আগত অভিবাসীদের সন্তান যারা নিজেদের ফরাসি জীবনধারার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি। কিন্তু তারা ছাড়াও ফ্রান্স থেকে আইসিসে কিছু শ্বেতাঙ্গ তরুণও যোগ দিয়েছে, যারা আইসিসের ভাবধারায় আকৃষ্ট হয়ে তথাকথিত ইসলামী খেলাফত বা ‘জিহাদ’ করতে মধ্যপ্রাচ্যে চলে গেছে। এ ছাড়াও খোদ ফ্রান্সেই এক বা একাধিক সন্ত্রাসী সেল গঠিত হয়ে থাকতে পারে যারা আইসিসের নির্দেশে ফ্রান্সসহ ইউরোপে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। এমন আশঙ্কাও অমূলক হবে না যে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে যে শরণার্থী স্রোত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, সেখানেও কিছু আইসিস সদস্য ছদ্মবেশে ঢুকে পড়তে পারে এবং ইউরোপে গিয়ে তাদের সমর্থক ও সহযোগী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যোগ দিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পারে। সব মিলিয়ে প্যারিস হামলার পর বিশ্ব যে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে সন্দেহ সামান্যই।
খোদ মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি আরও নাজুক। বিবদমান বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে কে যে চূড়ান্ত অর্থে কার হয়ে লড়াই করছে, সেটা বোঝা মুশকিল। আমরা দেখতে পাচ্ছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একদিকে যেমন আইসিসবিরোধী বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে; অন্যদিকে আইসিসের হাতেই শোভা পাচ্ছে অত্যাধুনিক মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র। দেখা যাচ্ছে, তুরস্ক একদিকে যেমন ন্যাটোর সদস্য হিসেবে আইসিসের বিরুদ্ধে হামলা পরিচালনা করছে; অন্যদিকে আইসিসের বিরুদ্ধে মাঠপর্যায়ে সবচেয়ে সক্রিয় সংগ্রামরত কুর্দি বাহিনীর ওপর বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। কখনও মনে হচ্ছে লড়াইরত পক্ষগুলোর মধ্যে কেউ কেউ একে অন্যের সহযোগী; আবার কখনও মনে হচ্ছে তারা সহযোদ্ধার পিঠেই ছুরিকাঘাত করছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে আইসিসবিরোধী দাবি করে; কিন্তু রাশিয়া যখন আসাদের সমর্থনে বিমান হামলা চালাচ্ছে, তখন ওয়াশিংটন মস্কোকে সমর্থনের বদলে মধ্যপ্রাচ্যে সংযত হওয়ার ছবক দিচ্ছে। আইসিস একদিকে সৌদি আরবের রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ ঘোষণা করেছে; অন্যদিকে সুনি্ন মতাবলম্বী সৌদি আরবের প্রতিপক্ষ আরবের বিভিন্ন শিয়া মসজিদ ও ধর্মীয় স্থাপনায় আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। একদিকে সৌদি আরব আইসিসবিরোধী লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে; অন্যদিকে আইসিস সেই সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলোর কাছ থেকে অর্থের জোগান পাচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের এই গভীর অন্তর্দ্বন্দ্ব একদিকে যেমন বৃহৎ শক্তিবর্গের শক্তি প্রদর্শনের ক্রীড়াক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে; অন্যদিকে মুসলিম বিশ্বের মধ্যে শিয়া ও সুনি্ন বিভেদ আরও প্রকট ও রক্তাক্ত করে তুলছে। গত কয়েক মাস ধরে ইয়েমেনের শিয়া মতাবলম্বী হুতু উপজাতিদের ওপর সৌদি বিমান বাহিনী নির্বিচার বোমা হামলা চালিয়ে গেলেও তা বিশ্ববিবেক তো বটেই, মুসলিম বিশ্বকেও নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়নি দৃশ্যত শিয়া-সুনি্ন বিভেদের কারণেই। সৌদি রাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে ইয়েমেনের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্তনাদ চাপা পড়ে গেছে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ও শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশেও ইয়েমেনে সৌদি আরবের নির্বিচার হামলা নিয়ে কোনো প্রতিবাদ দূরে থাক, সমবেদনাও চোখে পড়েনি।
মুসলিম সমাজ ও সাবির্ক অর্থে গোটা বিশ্ব এখন গভীর সংকটময় পরিস্থিতিতে স্বীকার করতেই হবে। ভৌগোলিকভাবে দূরে থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি তো বটেই, প্যারিসের মতো শহরে সন্ত্রাসী হামলার ঢেউও বাংলাদেশ এড়িয়ে যেতে পারে না। কারণ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি প্রবাসী রয়েছে। ওই অঞ্চলগুলোতে যে কোনো অস্থিতিশীলতা দেশীয় সমাজ ও অর্থনীতিকে প্রভাবিত করবেই। বিশেষ করে প্যারিসের সঙ্গে অর্থনীতি ছাড়াও আমাদের শিল্প-সাহিত্যের যোগসাজশ স্পষ্ট। কেবল তাই নয়, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের ছায়া বাংলাদেশেও বিভিন্ন মাত্রায় পড়েছে। যে কারণে প্যারিস হামলার পর আমাদের দেশেও সবার মধ্যে শোক, সমবেদনা ও শঙ্কা ছিল স্পষ্ট। আমাদের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ওই হামলার নিন্দা জানিয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে ফ্রান্সের পাশে থাকবে বাংলাদেশ।
আমরা জানি, বাংলাদেশের সরকার ও জনসাধারণ বরাবরই শান্তিপ্রিয় এবং যে কোনো ধরনের সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। প্যারিস বা মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন হামলা ও হতাহতের ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই আমরা মর্মাহত। এ ছাড়াও এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে ধর্মীয় লেবাসধারী বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন অতীতে বাংলাদেশকেও অস্থিতিশীল করতে চেয়েছে। এখনও যে তারা তাদের হীন কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য সংগঠিত হওয়ার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তার প্রমাণ আমরা মাঝেমধ্যেই দেখতে চাই। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চেতনা, সহিষ্ণু সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেসব গোষ্ঠীর চক্ষুশূল, তারাও এসব জঙ্গি গোষ্ঠীকে উস্কানি ও মদদ দিয়ে থাকে। এসব জঙ্গি ও উগ্রবাদী গোষ্ঠী যাতে কখনোই বাংলাদেশে শিকড় বিস্তার করতে না পারে, সেজন্য সরকারের পাশাপাশি জনসাধারণকেও সর্বদা সতর্ক ও সচেষ্ট থাকতে হবে। আমাদের তরুণ সমাজ যেন ধর্মের নামে কোনো ধরনের সন্ত্রাস বা সংঘাতমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত না হয়, সেজন্য উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম সর্বস্তরে চালিয়ে যেতে হবে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন মসজিদের ইমাম, স্কুল ও মাদ্রাসার ধর্মীয় শিক্ষক, আলেম-ওলামারা। একই সঙ্গে সরকারকেও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে আমাদের ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ও দীর্ঘমেয়াদি দায়িত্ব রয়েছে।
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ যাতে বাংলাদেশেও শিকড় ছড়াতে না পারে, সেজন্য অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও সক্রিয় থাকতে হবে। বিশেষ করে সার্ক ও আসিয়ানের মতো আঞ্চলিক সংস্থাভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অর্থায়ন প্রক্রিয়া ও সূত্র গভীর পর্যবেক্ষণে রাখতেই হবে। সামাজিক উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ অর্থও অনেক ক্ষেত্রে জঙ্গিবাদ বিস্তারের কাজে ব্যবহৃত হওয়ার নজির বাংলাদেশে কম নেই। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রোধে অন্য যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে রাজনৈতিক ঐকমত্য। গণতান্ত্রিক, উদার, অসাম্প্রদায়িক, উন্নয়নকামী যে বাংলাদেশ আমরা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জন করেছি; তা রক্ষা ও আরও সমৃদ্ধ করে তুলতে সব রাজনৈতিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে ঠিক একাত্তরের মতোই।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমডোর