ঢাকা, নয়া দিল্লির চোখে অনুপ চেটিয়া দুর্ধর্ষ অপরাধী, রাষ্ট্রদ্রোহী। আসামে তার বিরুদ্ধে খুন, গণহত্যা, চাঁদাবাজির অজস্র মামলা রয়েছে। তার চেয়ে বড় কথা তিনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গিয়ে আসামকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন। ঢাকা-দিল্লির কাছে তিনি দুর্ধর্ষ অপরাধী, রাষ্ট্রদ্রোহী হলেও তার পরিবার, নিজ গ্রাম আসামের জেরাইগাঁওয়ে তিনি যেন ‘বীর’। দিব্রুগড় থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে এই গ্রাম। সেখানে এখন বসবাস তার ভাই ও পরিবারের অন্যদের। রয়েছেন স্ত্রী মনিকা বড়–য়া সহ সন্তানরা। উলফার এই দুর্ধর্ষ নেতার সঙ্গে তার স্ত্রী মনিকা, ছেলে বুমোনি (২২) ও মেয়ে বুলবুলি (১৭)র দেখা নেই ১৬ বছর ধরে। অনুপ চেটিয়ার ভাই সুরেন বড়–য়ার বয়স এখন ৮২ বছর। তিনিও পরপারের পথে। জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে তিনি ভাইয়ের দেখা পাবেন। এমন আশায় তাদের বুকের ছাতি অনেকটা উঁচু হয়ে উঠেছে। জেরাইগাঁও গ্রাম যেন অনুপ চেটিয়াকে স্বাগত জানানোর অপেক্ষায় আছে। অনলাইন টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে এমনই লিখেছেন সাংবাদিক রাজিব দত্ত। এতে তিনি লিখেছেন, প্রায় দুই দশমের অপেক্ষার অবসান। উলফার সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়ার পরিবার স্বস্তিতে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। তাকে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ থেকে ভারতের কাছে তুলে দেয়ায় তার আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে আবেগঘন এক আশা জেগে উঠেছে। ২০০৯ সাল থেকে তারা তার মুক্তি আশায় প্রহর গুনেছেন। ওই সময় খবর ছড়িয়ে পড়েছিল যে, অনুপ চেটিয়াকে বাংলাদেশের জেল থেকে মুক্তি দেয়া হবে। বুধবার যখন তার মুক্তির খবর পৌঁছল স্বজনদের কাছে, গ্রামে তখন যে আনন্দের এক আবহ বয়ে গেছে। উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে জেরাইগাঁওয়ে। বুধবার সকাল থেকেই তার বাড়িতে ৮২ বছর বয়সী ভাই সুরেন বড়–য়া উল্লাসে ফেটে পড়ছেন। সুরেন বড়–য়ার স্ত্রী দিব্যলতা ও ছেলে অরুপও যেন সেই আনন্দে আত্মহারা। বাড়ির বারান্দায় বসে সুরেন বলেন, তার অকস্মাৎ মুক্তির খবরে আমাদের আনন্দ অপার, সীমাহীন। অনেক বছর আগে আমরা গোলাপ (অনুপ চেটিয়ার আরেক নাম) কে বাড়িতে স্বাগত জানানোর আয়োজন করেছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই হতাশ হয়েছি। এখন আমার বয়স হয়েছে। এখন গোলাপের উচিত বাড়ি ফিরে সব দায়দায়িত্ব নেয়া। উল্লেখ্য, উলফা (স্বতন্ত্র) কমান্ডার ইন চিফ পরেশ বড়–য়া হলেন অনুপ চেটিয়ার নিকট-আত্মীয় (কাজিন)। দু’জনের আত্মীয়স্বজন, পরিবারের সদস্যরা প্রতিবেশী। অনুপ চেটিয়া তার সাত ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট। তারা মোট দু’ভাই ও পাঁচ বোন। তার পিতা সেবেন ও মাকোলি বড়–য়া মারা গেছেন অনেক বছর আগে। ১৭ই মে ঢাকা থেকে অনুপ চেটিয়ার স্ত্রী মনিকা বড়–য়া, ছেলে বুমোনি (২২) ও মেয়ে বুলবুলি (১৭) আসামে পৌঁছেন। তারপর থেকে তারা জেরাইগাঁও গ্রামে থাকেন কিছু দিন। মনিকা বড়–য়া বলেন, গত ১৬ বছর ধরে স্বামীর সঙ্গে তার সাক্ষাত নেই। ১৯৮৯ সালের ৩০শে জুন অনুপ চেটিয়ার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। অনুপ চেটিয়ার বয়স এখন ৬৪ বছর। তিনি গোলাপ বড়–য়া নামেও পরিচিত। অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ, বাংলাদেশী ভুয়া পাসপোর্ট, নিবন্ধনহীন স্যাটেলাইট ফোন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, থাইল্যান্ড, স্পেন, বেলজিয়ামের মতো দেশের মুদ্রা রাখার অভিযোগে লক্ষী প্রসাদ গোস্বামী, বাবুল শর্মার সঙ্গে ১৯৯৭ সালের ২১শে ডিসেম্বর ঢাকায় তাকে আটক করা হয়। ১৯৭৯ সালের ৭ই এপ্রিল তিনি ভীমাকান্ত বুরাগোহাইন, রাজিব রাজকোনওয়ার ওরফে অরবিন্দ রাজখোয়া, সমীরণ গগৈ ওরফে প্রদীপ গগৈ, ভাদরেশ্বর গোহাইন ও পরেশ বড়–য়াকে নিয়ে শিবসাগরের রাংগড়ে গঠন করেন উলফা। তারপর থেকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তিনিই দলের সাধারণ সম্পাদক। অনুপ চেটিয়া খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও একাডেমিক কর্মকা-ে ছিলেন বেশ দক্ষ। তার দীর্ঘ দিনের বন্ধু প্রভাত গোহাইন বলেন, স্থানীয় জেরাই চোকোলি ভোরিয়াগাঁও এলপি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। তিনি খুব ভাল ছাত্র ছিলেন। ছিলেন দক্ষ ফুটবল খেলোয়াড়। গ্রামে যে জয় হিন্দ লাইব্রেরি রয়েছে তা স্থাপনে তার ছিল নেতৃস্থানীয় ভূমিকা। জেরাইগাঁও গ্রামের হেডম্যান ফটিক ফুকান বলেন, পুরো গ্রাম তাকে স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষ করছে। আমাদের কাছে সে একজন বীর ছাড়া কিছু নয়। সে আসামের জনগণের জন্য দীর্ঘ সময় লড়াই করেছে।