রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ভিআইপি এলাকার স্বর্ণতুল্য শত শত কোটি টাকা মূল্যের প্লটের জাল দলিল বানিয়ে কোটি কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে প্রতারক চক্র। গুলশান, বনানীসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় রয়েছে এসব প্লট। স্বাধীনতার পূর্বে তৎকালীন ডিআইটি (ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট) এসব প্লট বরাদ্দ দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর এ রকম শ’দুয়েক প্লটের কোনো মালিক খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে ভুয়া মালিক সেজে জাল কাগজপত্র বানিয়ে অনেকে প্লট বাগিয়ে নিয়েছেন। এভাবে একের পর এক হাতছাড়া হয়ে গেছে রাজউকের শ’দেড়েক প্লট। এ রকম ৩৯টি প্লট নিয়ে মহাঝামেলা চলছে। এসব প্লট দখলে মরিয়া প্রতারক চক্র
গত সোমবার গুলশান-২ এর ৫৯ নম্বর রোডের ১৯ নম্বর [এনডবি্লউ(ই)০২] প্লটটি নিয়ে এ রকম প্রতারণার জাল পাতা হয়েছে। কয়েকজন প্রতারক একজন বৃদ্ধাকে ভুয়া
মালিক সাজিয়ে রাজউকে গিয়ে ওই প্লট বিক্রির অনুমতি চায়। রাজউক কর্তৃপক্ষ তাদের পুলিশে দেয়। গতকাল আদালতে হাজির করলে তাদের জেলে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
রাজউকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবদুুর রহমান সমকালকে বলেন, পরিকল্পিত নগর গড়ার লক্ষ্যে ১৯৬২ সালে গুলশান-বনানী এলাকায় প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্লটপ্রাপ্ত পাকিস্তানিদের অনেকেই স্বাধীনতার পর ফিরে আসেনি। ওইসব প্লট নিয়েই মূলত প্রতারণার জাল বিস্তার করছে প্রতারক চক্র। এসব প্লটের একটির বিপরীতে কখনও কখনও সাতজন পর্যন্ত মালিকানা দাবি করে।
জানা যায়, প্রতারক চক্রের সদস্যরা আগেভাগেই প্লটের ফাইলগুলো রাজউক থেকে গায়েব করে ফেলে। রাজউকের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এই চক্রকে সহযোগিতা করে। পরে সেগুলোর জাল কাগজপত্র তৈরি করে একজনকে ভুয়া মালিক সাজিয়ে রাজউকে হাজির হয়ে বিক্রির অনুমতি প্রার্থনা করে। ওই প্লটটির নথিও অনেক আগেই রাজউক থেকে গায়েব করা হয়।
রাজউকের বোর্ড সদস্য (সম্পত্তি) আবদুুল হাই সমকালকে বলেন, এ ধরনের প্লটের ক্ষেত্রে একাধিক মালিক হাজির হলেই সন্দেহ হয়। মূল ফাইল গায়েব হওয়ায় আসল মালিক চিহ্নিত করাও কঠিন হয়ে পড়ে। ওইসব দাবিদার আদালতে মামলাও করেছে। একই প্লটের বিপরীতে চার-পাঁচটি মামলা দায়েরের ঘটনাও রয়েছে। এসব কারণে এই বিতর্কিত প্লট হস্তান্তর বা বিক্রির কাজ প্রায় বন্ধ এখন।
রাজউকের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, এসব প্লটের বিপরীতে প্রতারক চক্র বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রি বা পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিচ্ছে। যারা টাকা নিয়ে এসব প্লট কিনছেন তারা পরে মালিকানায় গলদের বিষয় বুঝতে পারেন। তখন তিনি আদালতের শরণাপন্ন হন। তখন আদালত তার পক্ষে রায় দিয়ে রাজউককে প্লট বুঝিয়ে দিতে বলেন। এ রকম চারজন রাজউকের বিরুদ্ধে প্লট বুঝিয়ে দেওয়ার মামলা দাখিল করেছেন।
এক প্লটের কতজন মালিক :২০০৪ সালের দিকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও মূল মালিকের নাতি হিসেবে পরিচয় দিয়ে আসিফ আহমেদ নামে এক ব্যক্তি প্রথম গুলশানের ৫৯ নম্বর রোডের ১৯ নম্বর প্লটের মালিকানা দাবি করেন। ডিআইটি জনৈক আজিম উদ্দিন আহমদের স্ত্রী হাফিজা বেগমকে ওই প্লটটি বরাদ্দ দিয়েছিল। হাফিজা বেগমের পুত্র আজমল বখতের ছেলে হিসেবে নিজেকে দাবি করেন আসিফ আহমেদ। এর পর মাঝেমধ্যেই তিনি ওই প্লট বিক্রির জন্য রাজউকে ধরনা দেন। এখনও রাজউক তাকে অনুমতি দেয়নি। ইতিমধ্যে ওই প্লটের আরও অন্তত পাঁচজন মালিক রাজউকে হাজির হয়। কেউ কোনো বৃদ্ধাকে নিয়ে রাজউকে হাজির করে তাকে হাফিজা বেগম হিসেবে উপস্থিত করে; কেউ হাফিজা বেগমের মৃত্যু হয়েছে উল্লেখ করে তার ভুয়া মৃত্যু সনদ, ভুয়া ভোটার আইডি কার্ড ও ভুয়া পাসপোর্টের অনুলিপিও রাজউকে জমা দিয়েছে। এসব দাবিদারের মধ্যে ৩/১, পুরানা পল্টনের আশরাফ আলী মণ্ডল, ৮১/১, মণিপুরিপাড়ার ওয়াজ উদ্দিন, মোহাম্মদপুরের ২৬/১, তাজমহল রোডের মনির, জনৈক আবদুুল্লাহ, মিরপুরের ফজলুল হক মোড়লের তথ্য দিতে পেরেছেন রাজউকের কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, ইতিমধ্যে ওই প্লট বিক্রির জন্য বড় একটি রিয়েল এস্টেটের সঙ্গে চুক্তি করেছেন আসিফ আহমেদ। অন্য এক রিয়েল এস্টেটের কাছে সাড়ে ৬ কোটি টাকায় বিক্রির জন্য চুক্তি করে ভুয়া হাফিজা বেগম, ওয়াজ উদ্দিন ও মো. মনির। বিষয়টি ধরে পড়লে বাড্ডা থানায় মামলা হয়। এ ঘটনায় ২০১৩ সালে ওয়াজ উদ্দিন ও মনিরকে জেলও খাটতে হয়। জেল থেকে বেরিয়েই তারা নতুন ক্রেতার সন্ধানে নামে। এবার জনৈক আবদুুল গনিকে ক্রেতা হিসেবে ঠিক করে। সোমবার যাকে হাফিজা বেগম সাজিয়ে রাজউকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তার আসল নাম হালিমা বেগম। স্বামী ইকবাল হোসেন। ঠিকানা :২৬/১১, তাজমহল রোড, ব্লক সি, মোহাম্মদপুর, ঢাকা। ওই দিন রাজউকের কর্মকর্তারা হালিমা বেগমকে বোধশক্তিশূন্য ধারণা করে ছেড়ে দিলেও পরে মতিঝিল থানা পুলিশ তাকেও মামলায় আসামি করে। আদালত হালিমা বেগমকেও জেল হাজিতে পাঠিয়েছেন। হালিমা বেগমের মেয়ে ফাতেমা বেগম বলে, যেসব লোক তার মাকে রাজউকে নিয়ে গিয়েছিল তা মাও বুঝতে পারেনি। সেও তাদের চেনে না।
আরও কিছু দৃষ্টান্ত :বিভিন্ন সময়ে একই প্লটের বিপরীতে একাধিক মালিকের বিভিন্ন সময়ে রাজউকে হাজির হয়ে মালিকানা দাবির নজির আছে। গুলশানের ৪৪ নম্বর রোডের ১১৯ নম্বর প্লটের (সিডবি্লউএনবি ২৮) বিপরীতেও বিভিন্ন সময়ে ছয়জন পৃথকভাবে মালিকানা দাবি করে রাজউকে বিক্রির অনুমতি চেয়েছে। নিজেকে হোসনে আরা বা হোসেন আরার ছেলে, নাতি-নাতনি ইত্যাদি সম্পর্কের উত্তরাধিকার দাবি করে জাল দলিলপত্র বানিয়ে বিক্রির অনুমতি চেয়েছে। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই জাল কাগজপত্র, ভুয়া ভোটার আইডি কার্ড, জাল পাসপোর্ট দাখিলের ঘটনা আছে। কেউ কেউ কোনো বৃদ্ধাকে নিয়েও তাকে হোসনে আরা বলে জাহির করেছে। যারা হোসনে আরাকে মৃত দেখিয়েছে তারা হোসনে আরার আজিমপুর কবরস্থানে দাফনের কাগজপত্রও উপস্থাপনের নজির স্থাপন করেছে। গুলশানের ১১ নম্বর রোডের ৩ নম্বর (এসডবি্লউএ ৩০) হোল্ডিংয়ের সৈয়দ আহমদ হাসমীর প্লট, গুলশানের ২/১ নম্বর রোডের ২ নম্বর হোল্ডিংয়ের (এসডবি্লউএইচ৭) রওশন আরা বেগম গংয়ের প্লট, ৪৯ নম্বর রোডের ১ হোল্ডিংয়ের (সিডবি্লউএন ০২) এসএম তাকী ও হীন কোরাইশীর প্লটের নথি গায়েব হয়ে গেছে রাজউক থেকে। পরে মালিকানা দাবির ঘটনা ঘটছে। এসব প্লটের কোনোটিরই আয়তন ১০ কাঠার কম নয়।
এ ছাড়া গুলশান ও বনানীর আরও অনেক প্লট নিয়ে প্রতারক চক্র সক্রিয়।