বড্ড করুণ সেই মুখ, মায়ামাখা সেই চাহনি। ডুবন্ত জাহাজের শেষ যাত্রী হয়ে তিনি একা অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে। অথচ তার চারপাশে তখন চলছে জয়োল্লাস, জিম্বাবুয়ের অধিনায়ক এলটন চিগুম্বুরার এই অসহায়ত্ব কি কেউ বুঝতে পারেননি? হয়তো পেরেছিলেন মাশরাফি, তাই ১৪৫ রানের জয় নিশ্চিত হওয়ার পর তিনিই প্রথম ক্যাপ খুলে হাত মিলিয়েছিলেন চিগুম্বুরার সঙ্গে। মুশফিকও এসেছিলেন কাছে, তবে তার আগে স্মরণীয় ম্যাচের স্মারক স্টাম্পটি তুলে। এমন নিষ্প্রভ প্রতিপক্ষের ওপর তো আর বুনো উল্লাস মানায় না, তাই ওয়ানডেতে প্রথম পাঁচ উইকেট শিকার করেও সাকিব বিনয়ী তার লাজুক হাসিতে।
আসলে বিশাল ব্যবধানের এই জয় পেতে ঘরের ছেলেদের খুব বেশি খাটুনি করতে হয়নি। ব্যাটিংয়ে মুশফিকের সেঞ্চুরির সঙ্গে সাবি্বরের ৫৭ রানের ঝড়ো হাওয়া। আর বোলিংয়ে সাকিব আর মাশরাফির কিছু স্পেল! ব্যাস এই চতুর্ফলাতেই এদিন বিধ্বস্ত হলো অতিথি জিম্বাবুয়ে। এখন তারা অপেক্ষায় আগামীকালের ম্যাচে সিরিজ হার এড়াতে।
চার মাস পর পাওয়া এ ম্যাচটি ঘিরে মিরপুরে আগ্রহের কমতি ছিল না। দুপুর থেকেই গ্যালারি উপচে পড়তে থাকে। তবে তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ‘স্পেশাল’। মুশফিকের মা রহিমা খাতুন। বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমের গায়ে লাগানো গ্যালারির এক কোণে বসেছিলেন তিনি। ছেলে যখন লুক জংওয়ের বলে ‘হেলিকপ্টার’ শটে বাউন্ডারি হাঁকিয়েছিলেন, তখন তার মুখে উজ্জ্বল হাসি। যখন ৫৩ রানে সুইপ খেলতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন তার উদ্বেগের চাহনি। আসলে তিনি কখনোই সেঞ্চুরির পর মুশফিকের ব্যাট উঁচানোর দৃশ্য মাঠে বসে দেখেননি। হয়তো মায়ের মন কোনোভাবে সাড়া দিয়েছিল, তাই এদিন মাঠে এসেছিলেন ম্যাচের শুরু থেকেই। মাকে গ্যালারিতে দেখেই হয়তো মুশফিকের সেঞ্চুরির উদযাপনটা ছিল একটু অন্যরকম। এর আগেও তিনি ওয়ানডেতে তিনটি সেঞ্চুরি করেছিলেন; কিন্তু আজকেরটা একটু বিশেষ কিছুই ছিল তার কাছে। এমনিতে দলের বাজে অবস্থায় তিনি ক্রিজে এসেছিলেন। ওপেনিংয়ে লিটন অফস্টাম্পের বাইরের বল ঠিকভাবে চালাতে না পেরে পয়েন্টে ক্যাচ তুলে দেন।
শুরুতে জিম্বাবুয়ের পেসার পানিয়াঙ্গারার বলও অস্বস্তিতে রাখে তামিমকে। তিনিও ধীরে চলো নীতিতে ব্যাট চালাতে থাকেন। এর মধ্যে মাহমুদুল্লাহ এসে ৯ রান করে পানিয়াঙ্গারার বলে বোল্ড হয়ে যান ঠিকভাবে স্ট্যান্স না নেওয়ায়। ৩০ রানে ২ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর চিগুম্বুরারাও দ্বিগুণ উৎসাহে বোলিং করতে থাকেন; কিন্তু তামিম-মুশফিকের মধ্যে কোনো আতঙ্কের ছাপ ধরা পড়েনি। বরং ওই জুটিতে ৭০টি রান আসে। যদিও রানের গড় তখন চারের নিচে ছিল। বল প্রত্যাশার চেয়ে ধীরে আসছিল ব্যাটে। তাই তুলে মারতে গিয়ে লংঅনে ক্যাচ দেন তামিম। ৬৮ বলে ৪০ রানে তার ইনিংস শেষ হয়।
ঠিক এখান থেকেই শুরু হয় বাংলাদেশের ‘দ্বিতীয়’ ইনিংস। প্রথম ২৫ ওভারে যেখানে আসে ১০৫ রান, সেখানে পরের ২৫ ওভারে ১৬৮। সাবি্বরের দুর্ধর্ষ মেজাজ আর মুশফিকের উত্তুঙ্গ আত্মবিশ্বাস- দুইয়ে মিলে পঞ্চম উইকেটে আসে ১১৯ রান। ওভারপ্রতি ৬ দশমিক ৩১। জিম্বাবুইয়ান পেসার মুজারবানি আর স্পিনার সিকান্দার রাজাকে কখনও সুইপ, প্যাডেল সুইপ এমনকি রিভার্স সুইপেও বাউন্ডারিছাড়া করতে থাকেন মুশফিক। মাঠের ‘কাউ কর্নার’ তার প্রিয় জায়গা দিয়ে একটি ছক্কাও হাঁকান মুশফিক। কম ছিলেন না সাবি্বরও, বাউন্ডারি হাঁকাতে অপেক্ষা করেছিলেন ১৯ বল পর্যন্ত। আর তার পরের ২৪ বল থেকে তুলে নেন ৪৬ রান। ৫৭ রানে আউট হওয়ার আগে ওয়ানতে তার সর্বোচ্চ স্কোর পেয়ে যান সাবি্বর। ওই সময় মাত্র ৬ বলের মধ্যে সাবি্বর, নাসির, মুশফিক আউট হয়ে যান; কিন্তু মাশরাফির বিশাল ছক্কা আর সানির তিনটি বাউন্ডারি মিলে দল ঠিকই ২৭৩ রানের পুঁজি পেয়ে যায়।
ড্রেসিংরুমের কাচের দরজা ঠেলে বাইরে এসে তখনই হাসি দেন কোচ হাথুরু। যার প্রতীকী অর্থ- এ রানই যথেষ্ট। শিশির বিন্দুতে শিক্ত মিরপুরের বাইশ গজে আড়াইশ’র ওপর রান তাড়া করা সহজ ছিল না। শুরুতে দুই ওপেনার মিলে ৪০ রানের জুটি গড়েছিলেন। মাশরাফি তার হাতের জাদু মুস্তাফিজকে ছেড়েছিলেন শুরুতে; কিন্তু কাজ হয়নি। আল-আমিন আর আরাফাত সানিকেও এনেছিলেন। কিন্তু জিম্বাবুইয়ান ওপেনার জংওয়ে যেন ধীরে ধীরে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে থাকেন। অবশেষে অষ্টম ওভারে আগমন সাকিব আল হাসানের এবং দশম ওভারেই প্রথম উইকেট। চিবাবা তুলে মারতে গিয়ে লংঅনে ক্যাচ দেন। নাসির-লিটন দু’জনই দৌড়ে এসে একটা ঝুঁকি তৈরি করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য লিটন তা লুফে নেন। এর পরও চলতে থাকে জংওয়ে শাসন! কিন্তু তাকে ফিরিয়ে দেন আল-আমিন।
উইকেটের পেছনে সহজ এক ক্যাচ তুলে জংওয়ে আউট হন ৩৯ রানে। তার আগেই অবশ্য জিম্বাবুয়ের বড় উইকেটটি শিকার করেন সাকিব। অরভিনকে মিডঅফে ক্যাচ তুলে ফিরিয়ে দেন মাত্র ২ রানে থাকতেই। প্রস্তুতি ম্যাচের নায়ক উইলিয়ামসকে সাকিব বোল্ড করেন মাত্র ৮ রানে থাকতেই। ৬৫ রানে ৪ উইকেট পড়ে যাওয়া জিম্বাবুয়ের এরপর আর মেরুদণ্ড সোজা করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু সেই ধুঁকতে থাকা জিম্বাবুইয়ানদের সামনেও যেন এক অবিচার নেমে আসে। মাশরাফির বল সিকান্দার রাজার ব্যাট স্পর্শ না করলেও মুশফিকের আবেদনে সাড়া দেন আম্পায়ার। রিভিউ না থাকার আফসোস নিয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরতে হয় রাজাকে। এ উইকেটটি শিকারের সঙ্গে সঙ্গে একটি মাইলফলক স্পর্শ করেন মাশরাফি। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ২০০তম উইকেট।
দলের সবাই এসে অধিনায়কের এই উইকেট শিকারের উদযাপন করতে থাকেন; কিন্তু উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে আফসোসে পুড়তে থাকেন চিগুম্বুরা। এরপর ওয়ালারকেও তুলে নেন মাশরাফি। আর তাসের ঘরের মতো সাকিব একাই ভাঙতে থাকেন জিম্বাবুইয়ানদের ইনিংস। চিগুম্বুরা একা কখনও কখনও সুন্দর কিছু বাউন্ডারি হাঁকান, কিন্তু তা তারিফ করার মতো অবস্থায় ছিল না গ্যালারি। কিপিং করার সময় পেসার পানিয়াঙ্গার বল পায়ে লাগে মুতুম্বামির। গোড়ালিতে এসে আঘাত করে ঘণ্টায় একশ’ ত্রিশ কিলোমিটার গতির ওই বলটি। সঙ্গে সঙ্গেই মিরপুর থেকে অ্যাপোলো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তাই একজন ব্যাটসম্যান কম নিয়েই তাড়া করতে নেমেছিল জিম্বাবুয়ে। ৪১ রানে থাকা চিগুম্বুরা তাই নাসিরের বলে এলবিডবি্লউ হওয়ার পরই সারেন্ডার করে বসেন।