দেশের বর্তমান পরিস্থিতি গণতন্ত্রের জন্য ‘অশনি সঙ্কেত’ মন্তব্য করে অবিলম্বে জাতীয় সংলাপ ও নির্বাচনের পরিবেশ উন্মুক্ত করার আহবান জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
আজ বৃহস্পতিবার রাতে দলের মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, অবাধ-নিরপেক্ষ ও সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর থেকেই দেশে রাজনৈতিক সঙ্কটের সূচনা। এ সঙ্কট উত্তরণে সরকারকে সময় থাকতেই উপায় বের করতে হবে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবিলম্বে একটি নির্বাচনের আয়োজন এখন জরুরি।
খালেদা জিয়া বলেন, দেশের চলমান সঙ্কট উত্তরণে গণতন্ত্র বিকাশের ক্ষেত্রকে সংকোচন না করে কর্তৃত্ববাদী মনোভাব থেকে সরে এসে একটি জাতীয় সংলাপের সূচনার পরিবেশকে উন্মুক্ত করতে হবে দেশ ও জাতীর স্বার্থে।
তিনি বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একটি ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর সরকার প্রধান অচিরেই আরেকটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেয়ার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার পর দেশে আজ এক সর্বগ্রাসী কর্ত্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থায় বিপর্যস্ত। যার ফলশ্রুতিতে শাসকদলের ক্ষমতা নির্ভর দম্ভ উল্লাসিকতা আর প্রশাসনের একাংশের সাথে মিলে মিশে একনায়কতান্ত্রিক আচরণে মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। এমনি পরিস্থিতিতে দেশ আজ গভীর সঙ্কটেও নিপতিত।
তিনি বলেন, আজ সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নেই, এমনকি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দু’জন সদস্য মাত্র ১৩ দিনের ব্যবধানে দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হয়েছেন। দু’জন বিদেশির দু:খজনক ও মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর একজন প্রকাশকও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
খালেদা জিয়া এসব ঘটনায় নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির করেন।
তিনি বলেন, ঘরে বাইরে এখন কেউই নিরাপদ বোধ করছেন না। চারদিকে আতংক, উৎকন্ঠা ও উদ্বেগ গোটা জাতিকে গ্রাস করেছে, যেন সামনে ঘোর অন্ধকার।
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, সরকার অবনতিশীল আইন পরিস্থিতির উন্নতিকল্পে উপযুক্ত পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ধরপাকড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এমন একজন অসুস্থ রাজনীতিককে কারাগারে পাঠানো-সরকারের চরম অমানবিক ও অসহিঞ্চু দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় ছাড়া আর কিছু নয়। সরকার জেনে বুঝে একজন অসুস্থ মানুষকে পুনরায় কারাগারে প্রেরণ করার মধ্য দিয়ে তার জীবনে স্বাস্থ্য ঝুঁকিকে বাড়িয়ে তুলেছে।
তিনি বলেন, দলের স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে আদালতে হাজিরা দিতে গেলে তাকেও কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দকে এভাবে একের পর এক কারাগারে বন্দী রাখার মধ্য দিয়ে সরকারের দুরভিসন্ধি রয়েছে। যখন আমরা সারাদেশে তৃণম–ল পর্যায় থেকে কাউন্সিল করে দলকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছি, তার পরপরই সারাদেশে দলের নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হচ্ছে।
খালেদা জিয়া অবিলম্বে দলের অসুস্থ ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এম কে আনোয়ার, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নান, সাংবাদিক শওকত মাহমুদ, যুগ্ম-মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান, রুহুল কবীর রিজভী, সাবেক সংসদ সদস্য ডাঃ দেওয়ান সালাউদ্দিন বাবু, কেন্দ্রীয় সদস্য সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জি কে গউস, কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি শরিফুল আলম, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলা বিএনপির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে হাফিজুর রহমান মোল্লা কচি ও জহিরুল হক খোকনসহ দলের ও অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের গ্রেফতারকৃত কর্মী ও নেতৃবৃন্দের মুক্তি দাবি করেন।
খালেদা জিয়া বলেন, জনগণের ভোটাধিকার বঞ্চিত করে পাতানো তথাকথিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আজ সরকার জনগণের কাঁধের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে-তারা তাদের অপশাসনকে প্রলম্বিত করার আকাংখায় দেশে এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতি দেশ-জনগণ-গণতন্ত্রের জন্য অশনি সঙ্কেত।
তিনি বলেন, হিংসাশ্রয়ী রাজনীতির চর্চা করে সরকার দেশের সব বিরুদ্ধমতকে দমনে আজ বেপরোয়া। তারা শুধু বিএনপিই নয়-নাগরিক সমাজ, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার বিরুদ্ধেও ক্ষুব্ধ। এমনকি সরকারী রোষানলের বাইরে গণমাধ্যমও নয়। যারাই সরকারের অপশাসন, দু:শাসন, দুর্নীতির সমালোচনা করছে-সরকার তাদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত।
তিনি বলেন, বিএনপি একটি গণতন্ত্র পন্থার দল। আমাদের দল কোনোভাবেই কোনো ধরণের উগ্রপন্থাকে সমর্থন করে না। সব ধরণের সহিংসতার বিরুদ্ধেও আমাদের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট। কিন্তু সরকার দেশে-বিদেশে বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দলকে সন্ত্রাসী চরিত্রের কালিমা লেপনের যে অপপ্রয়াস চালাচ্ছে তা দেশে বিদেশে কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি এবং পাবেও না, বরং সরকারের ফ্যাসিবাদী রুপই আরো বেশি করে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
খালেদা জিয়া বলেন, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আমরা জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছি, সর্বদলীয় বৈঠকের কথাও বলেছি। আমি বারবার জাতীয় সঙ্কট মোকাবেলায় জরুরিভাবে জাতীয় সংলাপের আহবান জানিয়েছি আন্তরিকভাবে, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও সত্য যে, সরকার আমাদের সে দাবির প্রতি এখন পর্যন্ত কর্ণপাত করেনি।
তিনি বলেন, আজ বেশ কিছু মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য হওয়া প্রয়োজন। তা হলো জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়া, গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া, সব পর্যায়ে বিচার ব্যবস্থায় স্বাধীন বিবেচনাবোধে কাজ করতে উৎসাহিত করা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে বাধা না দেয়া, দলীয়করণকৃত প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া এবং বর্তমান ক্ষমতাসীনদের আজ্ঞাবাহী নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে পুনর্গঠন করা, রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্যে গ্রেফতারকৃত সব রাজবন্দীর মুক্তি দেয়া ও মিথ্যা মামলা তুলে নিয়ে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্রকে ফিরিয়ে দেয়া।
