
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার পর শিল্পরাজধানী গাজীপুর। বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় গাজীপুর এখন রাজনীতির উর্বর ভূমি। রাজধানী ভিত্তিক কেন্দ্রিয় রাজনীতিতে গাজীপুরের বিশেষ ভূমিকা সব সময় অগ্রগন্য। শিল্পরাজধানী হওয়ায় গাজীপুরে প্রায় চার হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নানা ধরণের ব্যবসা বানিজ্য এখন রমরমা। এই সকল ব্যবসা বানিজ্য সাধারণত ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রনে হাতে থাকে। যারা রাজনীতি করেন তাদের ছোট একটি অংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ব্যবসা করে কাঁচা টাকায় রাতারাতি বড় লোক হয়ে য়ায়। রাজনীতি করে নেতার আস্থাভাজন হয়ে এক রাতে বড় লোক হওয়ার উর্বর ভূমি গাজীপুর। রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি রাজনৈতিক সুবিধাভোগীরাও অল্প সময়ে বড় লোক হতে পারে রাজনীতির সুফল পেয়েই। তাই গাজীপুরে রাজনীতি একটি বড় ব্যবসা। এই ব্যবসা কাউকে হিরো করে আবার জিরোতেও নামিয়ে আনে। সব মিলিয়ে গাজীপুর বাংলাদেশের মধ্যে রাজনীতির ধনী হওয়ার ভান্ডার। এই ভান্ডারে এখন নেতার অভাব নেই। যারা ছিলেন হিরো, তারা এখন জিরো। যারা ছিলেন জিরো তারা এখন হিরো।
অনুসন্ধান বলছে, বিগত আওয়ামীলীগের আমলে গাজীপুর জেলা, মহানগর ও উপজেলা গুলোতে যারা নেতৃত্ব দিয়ে বড় লোক হয়েছেন তাদের অনেকেই এখন পলাতক। বাস্তবতা বলছে, হিরো বনে যাওয়া নেতারা এখন জিরোতে অবস্থান করছেন। আবার তাদের দল এসে গেলে তারা আবার হিরো হয়ে যাবেন। বর্তমান অন্তর্বতী সরকারের আমলে সবচেয়ে সুবিধাজনক স্থানে রয়েছে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে থাকা ১৪ দল বাদে অন্যান্য দল। তবে গাজীপুরে সকল শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিএনপির একক আধিপত্য বিরাজমান। শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহ সকল প্রতিষ্ঠানে বিএনপি সহ একাধিক দলের প্রাধান্য আছে। কোথাও কোথাও বিএনপি, জামায়াত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে আছে। কোথাও বিএনপিপন্থী পেশাজীবী হিসেবে পরিচিত লোকজনও সুবিধাজনক স্থানে বসে গেছে। শিল্পনগরী টঙ্গীতে ২০০১ সাল থেকে বিএনপি ও আওয়ামীলীগ মিলে মিশে যে সমঝোতার ব্যবসা শুরু করেছিল তা এখনো বহাল আছে। টঙ্গীর রাষ্ট্রায়াত্ব একাধিক মিলে বিএনপি ও আওয়ামীলীগ অলিখিত সমবায় সমিতি করে ব্যবসা বানিজ্য করছেন। গাজীপুর মহানগরের সকল জায়গায় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিএনপির লোকজন ব্যবসা বানিজ্য করছেন। বিএনপির একাধিক গ্রুপ দৃশ্যমান থাকলেও ব্যবসা বনিজ্যের ক্ষেত্রে তারা গোপনে একাট্রা। একই পরিস্থিতি গাজীপুর জেলা ও সকল উপজেলায়। গাজীপুর জেলা বিএনপির নেতৃত্বে সকল উপজেলার ব্যবসা বানিজ্য এখন বিএনপির দখলে। গাজীপুরের ৫াট সংসদীয় আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী যাদের নাম মাঠে চাউর হয়ে আছে, তারা সকলেই ব্যবসা বানিজ্য ভাগভাটোয়ারার মূল কারিগর। এসকল এমপি প্রার্থীরা মঞ্চে উঠে যেসব নীতিবাক্য বলেন বাস্তবে তার মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন। বিএনপির এমপি প্রার্থীদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে ঝুট ব্যবসা, জমি দখল, মামলা বানিজ্য, আওয়ামীলীগের নিকট থেকে উপহার গ্রহন, পুনর্বাসন বানিজ্য, কেউ আবার আওয়ামীলীগের মন্ত্রীর এপিএস ছিল বলেও গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। কিন্তু এসব বিষয়ে তাদের আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য তারা দিচ্ছেন না।
এদিকে গাজীপুরের একটি সাংবাদিক সিন্ডিকেট আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে কতিপয় জনপ্রতিনিধিদের একান্ত আস্থাভাজন হয়ে কাজ করেছেন। আওয়ামীলীগের পতনের পর তারা বিএনপির একটি বড় অংশের হয়ে রাতারাতি বোল পাল্টিয়ে ফেলেছেন। বর্তমানে তারা নতুন খোলস পড়ে মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। আগে আওয়ামীলগীগের এখন বিএনপির লোক হয়ে তারা বর্তমানে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। বিএনপির লোক সেজে কৌশলে তারা আওয়ামীলীগের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করছেন। বিএনপির কাকে কাকে নেতা বানানো যায়, তারা তাও নির্ধারণ করছেন। ফলে প্রায়ই তাদেরকে বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে দেখা যায়। কথা প্রচলিত আছে, এই আওয়ামী-বিএনপি সিন্ডিকেট গাজীপুরের ৫টি আসনে বিএনপির প্রার্থীর জনপ্রিয়তার মানদন্ড তৈরী করেন। যাকে তাদের ইচ্ছে হয় তাকে উপরে তুলেন, যাকে পছন্দ হয় না তাকে ডুবিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। এই সিন্ডিকেটের সুবিধাভোগী গাজীপুরের একাধিক শীর্ষ নেতা এখন বুক ফুলিয়ে আছেন কারণ তারাই ধানের শীষ পাবেন। সম্প্রতি এক নেতার বিরুদ্ধে কয়েকশত কোটি টাকা মুল্যে জমি দখল চেষ্টার অভিযোগ বাতাসে ভাসা শুরু হয়েছে। জমি দখল, ব্যবসা দখল, মামলা বানিজ্য এসব অভিযোগ এখন অহরহ।
অপরদিকে আওয়ামীলীগ আমলে যে সকল নেতা বর্তমান বিএনপি নেতাদের মত হিরো ছিলেন তারা এখন জিরোতে অবস্থান করছেন। কিন্তু তাদের দল ক্ষমতায় আসলে তারা আবার হিরো হয়ে যাবেন। আওয়ামীলীগের হিরো থাকা নেতাদের দ্বারা যারা বড়লোক হয়েছেন তাদের অনেকেই এখন বিএনপির পতাকাতলে কৌশলে চলে আসা শুরু করেছেন। আওয়ামীলীগ আসলে তারা আবার ঘরে ফিরে যাবেন। তবে আওয়ামীলীগ আমলে যেসকল নেতা-কর্মীরা দলীয় কোন্দলের কারণে সুবিধা পান নি তারা এখন অসহায় জীবন যাপন করছেন। মামলায় জর্জরিত হয়ে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন কিন্তু নেতারা তাদের খবরও নিচ্ছেন না।
গাজীপুরের রাজনীতি সচেতন মানুষ বলছেন, বিএনপি আর আওয়ামীলীগ নেই, দুই দলেই ত্যাগী নেতা-কর্মীরা সব সময় অবহেলিত। দলের সুদিনে তারা মূল্যায়িত হয় না কিন্তু দুর্দিনে তারাই বুক পেতে দাঁড়ায়। এই দুই দলেই সুবিধাভোগীরা সব সময় সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান করে। ফলে আদর্শিক ও ত্যাগী নেতা-কর্মীরা সব সময় অবহেলায় কষ্ট পেয়ে এক সময় নীরব হয়ে যায। এই অবস্থায় রাজনৈতিক ভালোমন্দ সময়ে এক দলের সুবিধাভোগীরা ক্ষমতা হারিয়ে আরাম আয়েসে জীবন যাপন করবেন। এই আরাম আয়েসে আবার যাওয়া আসাও হবে। যারা এখন যেখানে আছেন সময়ের প্রয়োজনে তারা স্থান আদান প্রদান করবেন। এই। জিরো থেকে হিরো আবার হিরো থেকে জিরো হওয়ার এই রীতি দিন দিন সংস্কৃতিতে পরিণত হচ্ছে বলে অনেকেই ধারণা করছেন। সুতরায় গাজীপুরের রাজনীতিতে বেহুস না হয়ে সব সময় হুসে থাকা উচিত বলে মনে করেন অনেকেই।
রিপন আনসারী
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী
