গাজীপুরে বিএনপির এডহক কমিটি বিরুদ্ধে আওয়ামীপ্রীতির অভিযোগ এখন সরকারের ঘরে!

Slider গ্রাম বাংলা

গাজীপুর: পতিত আওয়ামীলীগ গত ১৬ বছরে যা পারেনি তা করেছে বিএনপি। শত চেষ্টা করেও যাদের পদোন্নতি দিতে পারেনি, পতিত সরকার, সেকাজটা করেছে বিএনপির কমিটি। তাই কমিটির বিরুদ্ধে শিক্ষকদের অভিযোগ এখন উপদেষ্টার কার্যালয়ে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গাজীপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত কাজী আজিমুদ্দিন কলেজ। বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে সাবেক ক্রীড়াপ্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল কলেজটিকে নিজের মত করে পরিচালনা করেছেন। যা খুশি তাই করেছেন। মানেননি কোন নিয়ম কানুন। ৫ আগষ্টের পর গঠিত হয় এডহক কমিটি। এই কমিটির সবাই বিএনপির লোক। কিন্তু এই এডহক কমিটি সাবেক প্রতিমন্ত্রী রাসেলকে ছাড়িয়ে গেছে ইতোমধ্যে। অতিআওয়ামীলীগ প্রীতির বিএনপির এই এডহক কমিটি মানছে না কোন নিয়ম কানুন। এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অমান্য করেই দেদার চলছে নিয়োগ ও পদোন্নতি। শুধু রুটিন দায়িত্ব পালনের কথা থাকলেও পত্রিকায় বিজ্ঞাপন না দিয়েই নিয়োগ দেয়া হয়েছে বেশ কিছু অতিথি শিক্ষক ও কর্মচারী। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বিতর্কিত ও সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর এক আত্মীয়কে নিয়মবহির্ভূতভাবে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়ায় সমালোচনার ঝড় উঠেছে গাজীপুরের একটি কলেজের অ্যাডহক কমিটির বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে তদন্তের আবেদন জমা পড়েছে শিক্ষা উপদেষ্টার দফতরেও। একই সাথে ভুয়া ভোটার তালিকা প্রণয়ন নিয়েও চলছে তুমুল বিতর্ক। অভিযোগ উঠেছে, জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের বিধান অমান্য করে কলেজে ছয়টি অধ্যাপক, আটটি সহযোগী অধ্যাপক এবং ২০টি সহকারী অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি না করেই সম্প্রতি ৩৪ জনের আবেদন গ্রহণ করে তাদের পদোন্নতি দেয়ারও তোড়জোর শুরু হয়েছে।

তালিকায় থাকা এই ৩৪ জনের মধ্যে বেশির ভাগই স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ পলাতক আ’লীগ নেতাদের পরিবারেরই লোকজন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) সূত্রে জানা যায়, গাজীপুরের ঐতিহ্যবাহী কাজী আজিমউদ্দিন কলেজে গত ৫ আগস্টের পরেও চলছে ফ্যাসিস্টদেরই দৌরাত্ম্য। বিগত ১৬ বছরের আওয়ামী ফ্যাসিস্ট আমলের মতোই এখনো চলছে তুঘলকি সব কাণ্ড। অভিযোগে জানা যায়, আওয়ামী লীগের সময়ে মন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয়ে প্রভাব খাটিয়ে ১৬ বছর কলেজে না এসে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করার কারণে একাধিকবার শোকজ খেয়েছেন আর সেই জন্য তার পদোন্নতিও হয়নি। কিন্তু ৫ আগস্টের পর গঠিত অ্যাডহক কমিটি নিয়ম বহির্ভূতভাবে প্রভাষক পদ থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির সুপারিশ করেছেন সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের আপন ভাগিনা মাসুদুল হককে। এমনকি মাসুদুল হক এখন কলেজের অঘোষিত অধ্যক্ষের মতো প্রভাব খাটিয়ে আওয়ামী লীগের শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন।
কলেজের শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গভর্নিং বডির সভাপতি হিসেবে গাজীপুর জেলা প্রশাসক দায়িত্ব পালন করেছেন। এই সময়ে কলেজ ফান্ডে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা হয়। পরে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অত্র কলেজ পরিচালনার জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী আকন্দকে অ্যাডহক কমিটির সভাপতি এবং একই বিশ^বিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক মোস্তফা নাজমুল মানছুরকে বিদ্যোৎসাহী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেন। এরপর কলেজে ব্যক্তিগত প্রভাববিস্তার, কলেজ ফান্ডের অর্থের প্রতি লালসা এবং অর্থের বিনিময়ে সৃষ্ট পদে শিক্ষক এবং এমপিও ও নন-এমপিও কর্মচারী নিয়োগ দেয়ার লক্ষ্যে একটি প্রভাবশালী মহল প্রভাব খাটিয়ে ২৬ সেপ্টেম্বর বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাদ দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় শূন্য অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও মো: আনোয়ারুল ইসলাম অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হয়ে আসেন। অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হওয়ার পর তিনি মুহাম্মদ অহিদুল ইসলামকে অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) দায়িত্ব প্রদান করেন।

শিক্ষকদের অভিযোগ, এমপিও নীতিমালা-২০২১ এর ১১.৫, ১১.৬ ধারা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্মারক নং ৩৭.০০.০০০০.০৭৪.০৩০.০০১.২০১৭(অংশ-১).১৪৭ পরিপত্র অমান্য করে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের আপন ভাগিনা মো: মাসুদুল হক, প্রভাষককে (প্রাণিবিদ্যা) সহকারী অধ্যাপক পদে জেলা পদোন্নতি বাছাই কমিটির সুপারিশ ছাড়াই অনলাইনে ডিজিতে প্রেরণ করে তার পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আবার জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের বিধান অনুসারে অ্যাডহক কমিটির নিয়োগ প্রদানের এখতিয়ার না থাকা সত্ত্বেও কোনো ধরনের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন না দিয়ে নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়াই বর্তমানে চারজন অতিথি শিক্ষক এবং ছয়জন কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কমিটির বিরুদ্ধে কলেজ প্রাঙ্গণে ক্যান্টিন স্থাপনের নামে দুই লাখ টাকা উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগও রয়েছে। অপর দিকে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় নন-এমপিও শিক্ষকদের নিয়োগ যাচাই-বাছাই করার জন্য নির্দেশনা দিলেও অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) ও বর্তমান অ্যাডহক কমিটি কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। এমনকি গভর্নিং বডি নির্বাচন-২০২৫ এ সরকারি ও জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী নিয়োগ না হওয়া শিক্ষকদের নিয়মিত শিক্ষক হিসেবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

অ্যাডহক কমিটির সভাপতি মো: আনোয়ারুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছেন, কোনো শিক্ষকের পদোন্নতির বিষয়টি মাউশি দেখভাল করে। এখানে আমাদের কোনো কিছু করার নেই বা এখতিয়ারও নেই। তবে আগে যদি কোনো শিক্ষক ক্লাসে বা কলেজে অনিয়মিত আসতেন সেটা আমরা বিবেচনায় নিচ্ছি না। বিশেষ করে আমি দায়িত্ব নেয়ার পর দেখছি বর্তমানে কে কী করছেন। কেননা আগের কোনো ঘটনা নিয়ে পড়ে থাকলে তো কলেজকে রান করাতে পারব না। আমার শিক্ষার্থীরাও কিছুই শিখতে পারবে না। তাই আমি চেষ্টা করছি অতীত বাদ দিয়ে সবাইকে সাথে নিয়ে একসাথে সামনে দিকে এগিয়ে যেতে। সেই জন্য আমরা সব শিক্ষক-কর্মচারীকে সাথে কাজ শুরু করেছি।

অভিযোগের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, আমাদের কাছে লিখিতভাবে কোনো অভিযোগ জমা হলে আমরা সেই অভিযোগ তদন্তের জন্য মাউশি কিংবা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুসন্ধান করার দায়িত্বভার দিয়ে দেই। কাজী আজিম উদ্দিন কলেজের বিষয়েও সেই একই প্রক্রিয়ায় অভিযোগ অনুসন্ধান করা হবে। উল্লেখ্য, গাজীপুর মহানগরের প্রাণকেন্দ্রে ১৯৮১ সালের ০৪ জুলাই কাজী আজিমউদ্দিন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিক, ডিগ্রি (পাস), ১৩টি বিষয়ে অনার্স ও তিনটি বিষয়ে মাস্টার্স কোর্সের ৬,৫৯৪ জন ছাত্রছাত্রী এবং ৩৯ জন এমপিওভুক্ত শিক্ষক, ২৭ জন নন-এমপিও ভুক্ত শিক্ষক এবং ১৫ জন কর্মচারী নিয়ে কলেজটি পরিচালিত হচ্ছে।

সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, এই কলেজের কমিটি ও অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কতিপয় শিক্ষক শিক্ষা উপদেষ্টা ও জাতীয় বিশ্ব বিদ্যালয়ে এই বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে ও এডহক কমিটি বাতিল চেয়ে আবেদন করেছেন। আবেদনটি তদন্তাধীন। একই সঙ্গে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন সহ ক্রিয়াশীল বিভিন্ন মহলে এই বিষয়টি এখন আলোচনার তুঙ্গে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *