মোটরযান বা মোটরগাড়ির কাগজপত্র ও ফিটনেস হালনাগাদে জরিমানা মওকুফ করেছে সরকার। তবুও কাঙ্ক্ষিত সাড়া দিচ্ছেন না গাড়ির মালিকরা। যে কারণে রাস্তায় প্রতিনিয়ত কাগজ মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জরিমানা মওকুফ করা হলেও অতিরিক্ত করের কারণে গাড়ির মালিকরা কাগজপত্র হালনাগাদ করছেন না।
মন্ত্রণালয় বলছে, সিসিভেদে (ইঞ্জিন ক্ষমতা) একটি গাড়ির কাগজপত্র হালনাগাদ করতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ) নির্ধারিত যে ফি দিতে হয়, তার চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ অগ্রিম কর দিতে হয়। আবার যদি মালিকের একাধিক গাড়ি থাকে তাহলে যোগ হবে পরিবেশ সারচার্জ। অগ্রিম কর আর পরিবেশ সারচার্জ মিলে বিরাট অঙ্কের কর জমা দিতে হয় তাদের। এ কারণে বিআরটিএ জরিমানা মওকুফের সুযোগ দিলেও করের ভয়ে গাড়ির মালিকরা কাগজপত্র হালনাগাদে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না।
সমস্যা সমাধানে মাত্র দুই বছরের (চলতি ও এর আগের অর্থবছর) অগ্রিম কর আদায়ের ব্যবস্থা করতে মন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেখানে বাকি অর্থবছরগুলোর বকেয়া কর মোটরযান মালিকের রিটার্ন দাখিলের সময় আদায়ের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করা হয়েছে। এতে এনবিআরের অগ্রিম আয়কর, ভ্যাট, পরিবেশ সারচার্জ, সম্পূরক শুল্ক ইত্যাদি আদায় যেমন বাড়বে, তেমনি মোটরযান কর ও ফি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আদায় হবে এবং ফিটনেসবিহীন মোটরযানের সংখ্যা কমবে।
এ বিষয়ে এনবিআরের কর বিভাগের ঊর্ধ্বতন (সদস্য) কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোনো পরিবহন মালিক একসঙ্গে পাঁচ বছরের কাগজপত্র নবায়ন করতে গেলে করের জন্য স্বাভাবিকভাবে অসুবিধায় পড়বেন। তবে তিনি প্রতি বছর কাগজপত্র নবায়ন করলে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। একসঙ্গে পাঁচ বছরের নবায়নের সময় দুই বছরের (চলতি ও এর আগের বছর) কর নেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, পুরোনো বকেয়া পরিশোধ না করলে এ সুবিধা দেওয়া যাবে না। এরপরও মন্ত্রণালয় যে চিঠি দিয়েছে, তা আমরা বিবেচনা করব।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিআরটিএ মোটরযান কর ও ফি হিসেবে দুই হাজার ২১৪ কোটি টাকা এবং এনবিআর নির্ধারিত কর হিসেবে দুই হাজার ৫০৬ কোটি টাকা আদায় করেছে। বিআরটিএ’র সফটওয়্যারের মাধ্যমে এ দুই ধরনের ফি ও কর আদায় করা হয়। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর থেকে একই সফটওয়্যারে এনবিআরের পরিবেশ সারচার্জ আদায় শুরু হয়েছে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের চিঠি ও এনবিআরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিটি গাড়ির কাগজপত্র হালনাগাদ বা নবায়নে বিআরটিএ’র কর ও ফি’র চেয়ে এনবিআর নির্ধারিত কর প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। যেমন— নিজাম উদ্দীন নামের এক ব্যক্তির একটি ১৫০০ সিসির গাড়ির কাগজপত্র যদি নবায়ন করতে হয়, তাকে বিআরটিএ’র ফি (ফিটনেস ফি ১৬০৫ টাকা ও সড়ক কর ৫৮০২ টাকা) হিসেবে মোট দিতে হয় সাত হাজার ৪০৭ টাকা। সেখানে তাকে ওই গাড়ির জন্য এনবিআর নির্ধারিত অগ্রিম কর দিতে হয় ২৫ হাজার টাকা। ফলে বিআরটিএ’র ফি ও এনবিআর নির্ধারিত অগ্রিম করসহ এ গাড়ি নবায়নে তাকে পরিশোধ করতে হয় ৩২ হাজার ৪০৭ টাকা।
আবার নিজাম উদ্দীনের ১৫০০ সিসির গাড়ির সঙ্গে আর একটি ২০০০ সিসির জিপ থাকে, তাহলে তাকে পরিবেশ সারচার্জ দিতে হয়। কারণ, একাধিক গাড়ি থাকলে পরিবেশ সারচার্জ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নিজামের ১৫০০ সিসির সঙ্গে ২০০০ সিসির জিপের কাগজপত্র নবায়ন করার সময় তাকে বিআরটিএ’র ফি (প্রতিটির ফিটনেস ফি ১৬০৫ টাকা ও সড়ক কর ৫৮০২ টাকা) হিসেবে দিতে হবে মোট ১৪ হাজার ৮১৪ টাকা। সঙ্গে দুটি গাড়িতে অগ্রিম কর এক লাখ টাকা ও পরিবেশ সারচার্জ ৫০ হাজার টাকাসহ মোট কর দিতে হয় এক লাখ ৬৪ হাজার ৮১৪ টাকা। অর্থাৎ নিজাম উদ্দীনকে একটি গাড়িতে বিআরটিএ’র ফি হিসেবে ৩২ হাজার ৪০৭ টাকা আর দুটি গাড়ি থাকলে এনবিআর নির্ধারিত কর হিসেবে দিতে হচ্ছে এক লাখ ৬৪ হাজার ৮১৪ টাকা। এক্ষেত্রে একটি গাড়ির জন্য যে পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হয় তার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হয় গাড়ি মালিককে।
মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, সারা দেশে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। এসব যানবাহনের কারণে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। পাশাপাশি এসব যানবাহন পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করছে। আবার অনেক মোটরযানের মালিক বছরের পর বছর কাগজপত্র হালনাগাদ করেন না। মূলত বিআরটিএ’র জরিমানা ও করের ভয়ে কাগজপত্র নবায়ন করেন না তারা। ফিটনেসবিহীন গাড়ি বাতিল ও মোটরযানের মালিকদের কাগজপত্র নবায়নে আগ্রহী করতে মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নেয়। পরে অর্থ মন্ত্রণালয়কে জরিমানা ব্যতীত মোটরযানের কাগজপত্র (ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেন ও রুট পারমিট) ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়নের সুযোগ দিতে অনুরোধ জানানো হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় সম্মতি দেওয়ার পর একাধিকবার বিআরটিএ মোটরযানের কাগজপত্র নবায়নের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয়। কিন্তু মোটরযানের মালিকরা আশানুরূপ সাড়া দেননি। এনবিআর নির্ধারিত করের কারণে সাড়া দেননি বলে মনে করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। কারণ, বিআরটিএ’র অনলাইন ব্যাংকিং সফটওয়্যারে মোটরযানের কর ও ফি জমা প্রদান করতে গেলে আগের অর্থবছরের বকেয়া আয়কর পরিশোধ করতে হয়, যা আর্থিক বিবেচনায় বিআরটিএ’র সেবামূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
উদাহরণ হিসেবে চিঠিতে বলা যায়– ১৫০০ সিসির একটি গাড়ির মালিক যদি পাঁচ বছর কাগজপত্র নবায়ন না করেন, তাহলে নবায়নের সময় তাকে বিআরটিএ’র ফি সাত হাজার ৪০৭ টাকা হিসেবে দিতে হবে ৩৭ হাজার ৩৫ টাকা। আর অগ্রিম কর হিসেবে দিতে হবে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা। একই মালিকের একাধিক গাড়ি থাকলে বিপুল পরিমাণ সারচার্জ দিতে হবে। যেমন– ৩৫০০ সিসির অধিক একটি গাড়ির অগ্রিম আয়কর দুই লাখ টাকা। একের অধিক গাড়ির ক্ষেত্রে সাড়ে তিন লাখ টাকা। অথচ এ গাড়িতে বিআরটিএ’র ফি মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। আর অধিক সিসির গাড়ির ক্ষেত্রে বিআরটিএ’র ফি’র সঙ্গে এনবিআরের নির্ধারিত অগ্রিম কর ও সারচার্জের পার্থক্য অনেক বেশি।
এনবিআর সূত্রমতে, আয়কর আইন- ২০২৩ এর ধারা ১৫৩ অনুযায়ী, গাড়ি নিবন্ধন ও ফিটনেস নবায়নের সময় আয়কর রিটার্ন জমার প্রাপ্তি স্বীকার (পিএসআর) জমা না দিলে অগ্রিম করের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। যেমন– ১৫০০ সিসির একটি গাড়িতে অগ্রিম কর ২৫ হাজার টাকা। তবে, গাড়ি নিবন্ধন বা ফিটনেস নবায়নের সময় পিএসআর দিতে না পারলে জরিমানা দিতে হবে ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা। আর একাধিক গাড়ির ক্ষেত্রে দিতে হবে ৫৬ হাজার ২৫০ টাকা।
একইসঙ্গে ৩৫০০ সিসির একটি গাড়িতে অগ্রিম কর দিতে হয় দুই লাখ টাকা। পিএসআর দিতে না পারলে জরিমানা দিতে হবে তিন লাখ টাকা। একাধিক গাড়ি থাকলে দিতে হবে চার লাখ ৫০ হাজার টাকা। একইভাবে সব গাড়ির নিবন্ধন ও ফিটনেস নবায়নের সময় পিএসআর দিতে না পারলে সিসিভেদে মোটা অঙ্কের জরিমানা দিতে হয়। এ জরিমানার কারণে অনেক গাড়ির মালিক ফিটনেস নবায়ন করেন না।
সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে ‘মোটরযান মালিকদের উৎসাহ’ দিতে এনবিআরের কাছে দুই অর্থবছরের কর আদায়ের একটি প্রস্তাবনা দিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। তাদের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, খেলাপি মোটরযান মালিকদের কাগজপত্র নবায়নের ক্ষেত্রে যত বছরের বকেয়া থাকুক না কেন, কাগজপত্র নবায়নের সময় চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর ও এর আগের এক বছরের (২০২৩-২৪) বকেয়া অগ্রিম কর আদায় করা যেতে পারে। বিআরটিএ’র সফটওয়্যারে এনবিআর এ দুই বছরের কর পরিশোধের সুযোগ দিলে বিপুল সংখ্যক মোটরযান মালিক কাগজপত্র নবায়ন করবেন। আগের অর্থবছরগুলোর বকেয়া অগ্রিম আয়কর মোটরযানের মালিকদের আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় আয়কর অফিস আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এ ছাড়া ইলেকট্রিক মোটরযানের পরিবেশ সারচার্জ মওকুফ করারও অনুরোধ জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।