ওএসডি-বদলি-নিয়োগ ও পদায়নে ঘটনাবহুল জনপ্রশাসন

Slider জাতীয়


বিদায় নিয়েছে ২০২৪। ঘটনাবহুল বছরটি নিয়ে আলোচনা থাকবে বছরের পর বছর। ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে গত ৫ আগস্ট পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরপরই পাল্টে যায় দৃশ্যপট। দায়িত্ব নিয়ে জনপ্রশাসনে ব্যাপক ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালায় এ সরকার।

চুক্তি বাতিল, ওএসডি, বদলি, নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নের মতো আলোচিত ঘটনা ঘটে জনপ্রশাসনে।

আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত সচিব, অতিরিক্ত সচিব, বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর ও সংস্থার প্রধান, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি), উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ (ইউএনও) অনেক কর্মকর্তাকে পদ থেকে সরানো হয়। কাউকে বদলি, কাউকে বাধ্যতামূলক অবসর এবং কাউকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। কারও কারও চুক্তি বাতিল করা হয়। এসব পদে নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হয়। এছাড়া ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তাদের পদোন্নতিও দেওয়া হয়।

আন্দোলন ঘিরে কারফিউ ও সাধারণ ছুটি

কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে গত ১৮ জুলাই থেকে স্থবির হয়ে পড়েছিল রাজধানীর জনজীবন। ১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে দেশজুড়ে কারফিউ জারি করা হয়। কারফিউয়ের মধ্যে ২১ থেকে ২৩ জুলাই সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

২৪ জুন কারফিউ কিছুটা শিথিল করা হলে অফিস খোলা হয়। ওই সময় বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত চার ঘণ্টা অফিসের কার্যক্রম চলে।

ধারাবাহিকভাবে কারফিউ শিথিলের সময় বাড়ানো হলে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত অফিস চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। পরে স্বাভাবিক সূচিতে ফিরে আসে অফিসের সার্বিক কার্যক্রম।

৩ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষিত সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবি এবং অসহযোগ আন্দোলনকে ঘিরে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ব্যাপক সংঘাত-সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।

৪ আগস্ট অনির্দিষ্টকালের জন্য সারা দেশে কারফিউ জারি করে তৎকালীন সরকার। যা ওই দিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে কার্যকর হয়। এ ছাড়া ৫ আগস্ট থেকে দেশে তিন দিনের (৫, ৬ ও ৭ আগস্ট) সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়।

তবে, ছাত্র-জনতা সেই কারফিউ মানেনি। কারফিউ লঙ্ঘন করে রাজপথে নেমে আসে ছাত্র-জনতা। তাদের আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। পরে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার।

শুরুতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার শুরুতে সরকারি বিভিন্ন উচ্চ পদে থাকা চুক্তিভিত্তিক সব নিয়োগ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ১৪ আগস্ট জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানসহ ১১ জন সচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়।

সবমিলিয়ে শতাধিক কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার।

ওএসডি ও বাধ্যতামূলক অবসর

সচিব, অতিরিক্ত সচিবসহ বহু কর্মকর্তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে অন্তর্বর্তী সরকার। এ ছাড়া বেশ কয়েকজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। তারা সবাই আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রথম তিন মাসে সহকারী সচিব থেকে সচিব পর্যায়ে ৮০ জন কর্মকর্তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। এ সময়ের মধ্যে চারজন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়।

বদলি

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম তিন মাসে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা মোট এক হাজার ৮৭০ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়। এর মধ্যে সিনিয়র সচিব/সচিব পদে ৪৩ জন, গ্রেড-১ পদে ১১ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ১৩৭ জন, যুগ্মসচিব পদে ১৭৩ জন, উপসচিব পদে ৩৯১ জন, সিনিয়র সহকারী সচিব/সহকারী সচিব পদে ছিলেন ৪১৪ কর্মকর্তা।

অন্যদিকে, বিভাগীয় কমিশনার চারজন, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার তিনজন, জেলা প্রশাসক ৫৯ জন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ১১৮ জন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদে ১৬৫ জন, সিনিয়র সহকারী কমিশনার/সহকারী কমিশনার ৮৩ জন, সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা ১২৬ জন, এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট/আইন কর্মকর্তা/মেরিন সেফটি অফিসার ৩৯ জন, উপপরিচালক/পরিচালক (স্থানীয় সরকার) ১৮ জন, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী ও নির্বাহী ৩০ জন, জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার ১৮ জন, চার্জ অফিসার ছয়জন, পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ১৯ জন, ক্যান্টনমেন্ট এক্সিকিউটিভ অফিসার তিনজন এবং অন্যান্য ১০ জনকে বদলি করা হয়।

‘বঞ্চিতদের’ পদোন্নতি ও পদায়ন

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ‘বঞ্চিত’ থাকা কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও পদায়ন করে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রথম তিন মাসে সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে ১২ জন, গ্রেড-১ পদে তিনজন, অতিরিক্ত সচিব পদে ১৩৫ জন, যুগ্মসচিব পদে ২২৬ জন, উপসচিব পদে ১২৫ জন, অন্যান্য ক্যাডারে ২২১ জন, সিনিয়র সহকারী সচিব (নন-ক্যাডার) পদে নয়জন এবং সহকারী সচিব (নন-ক্যাডার) পদে ৩৭ জনসহ সর্বমোট ৭৬৮ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়।

পুরাতনদের সরিয়ে নতুন ডিসি, পরে বিতর্ক

গত ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর দুই দিনে দেশের ৫৯ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়। এ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ তুলে ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে হট্টগোল করেন উপসচিব পর্যায়ের একদল কর্মকর্তা। নিয়োগ পাওয়া অধিকাংশ ডিসিদের নিয়ে আপত্তি জানান তারা।

এর পরিপ্রেক্ষিতে নতুন নিয়োগ পাওয়া ৫৯ জন ডিসির মধ্যে গত ১২ সেপ্টেম্বর নয়জনের নিয়োগ বাতিল করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে চার জেলার ডিসি পদে রদবদল আনা হয়।

সম্পদের হিসাব নেওয়ার উদ্যোগ

প্রত্যেক সরকারি কর্মচারীকে চাকরিতে প্রবেশের সময় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির হিসাব দিতে হয়। এরপর পাঁচ বছর অন্তর সম্পদ কমা বা বাড়ার বিবরণী নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের কাছে জমা দেওয়ার নিয়ম আছে। দুর্নীতি রোধ ও চাকরিজীবীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আচরণবিধিমালায় এমন নিয়ম আছে। কিন্তু এ নিয়ম মানা হয় না বললেই চলে।

গত ২৬ আগস্ট জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ভাষণে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের সব উপদেষ্টাদের সম্পদের বিবরণী দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রকাশ করবেন বলে জানান। পর্যায়ক্রমে সব সরকারি কর্মচারীর ক্ষেত্রে তা নিয়মিত ও বাধ্যতামূলক করা হবে বলেও জানান প্রধান উপদেষ্টা। এরপর গত ১ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি জারি করে সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের বিবরণী দাখিলের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

দুর্নীতির লাগাম টানতে প্রতি বছর সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার নির্দেশ দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রতি বছর ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে হিসাববিবরণী জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। যারা সম্পদের হিসাব দেবেন না তাদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে বলেও জানানো হয়।

dhakapost

চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ল

সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছিলেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। সর্বশেষ গণ-আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর সেই দাবির মুখে বয়সসীমা ৩২ বছর নির্ধারণ করে সরকার।

গত ১৮ নভেম্বর বয়স বাড়ানোর অধ্যাদেশ জারি করা হয়। সেখানে সরকারির পাশাপাশি স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফাইন্যানসিয়াল কর্পোরেশনসহ স্ব-শাসিত সংস্থাগুলোতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে একই বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়।

দাবি-দাওয়া নিয়ে নজিরবিহীন হট্টগোল

সরকার পতনের পর বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ভিড় করেন বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। ডিসি পদ নিয়ে ‘বঞ্চিত’ হওয়া কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে নজিরবিহীন হট্টগোলও করেন।

গত ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর দুই দিনে দেশের ৫৯ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়। এ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ তুলে ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে হট্টগোল করেন উপসচিব পর্যায়ের একদল কর্মকর্তা।

ওই দিন দুপুরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দুই যুগ্মসচিবের কক্ষে হট্টগোল করেন তারা। বিকেল ৩টায় বঞ্চিত দাবি করা কর্মকর্তারা ওই দুই যুগ্ম সচিবের কক্ষ অবরুদ্ধ করে রাখেন। কর্মকর্তাদের রোষ থেকে নিজেকে বাঁচাতে একজন যুগ্ম সচিব পাশের রুমের টয়লেটে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দেন। প্রায় দুই ঘণ্টা পর সিনিয়র কর্মকর্তারা সেখানে গিয়ে তাকে বের করে আনেন।

ওই ঘটনায় সমালোচনার মুখে তদন্ত কমিটি গঠন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। পরে ১৭ জন উপ-সচিবকে শাস্তি দেওয়ার সুপারিশ করে গঠিত কমিটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *