চট্টগ্রামের শ্রমিক লীগ নেতা হামিদুর রহমান। কাগজে-কলমে তিনি জাতীয় শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত মেঘনা পেট্রোলিয়াম শ্রমিক ইউনিয়নের (সিবিএ) সাধারণ সম্পাদক। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচলাইশ থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলার অন্যতম আসামি তিনি। এজাহারভুক্ত এ আসামিকে ১৭ ডিসেম্বর দুপুরে আগ্রাবাদে অবস্থিত মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের কার্যালয় থেকে আটক করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি টিম।
এদিকে আটকের পর নগর যুবদলের কয়েকজন নেতা তার বিস্তারিত পরিচয় ডিবিতে উপস্থাপন করেন। এতে উল্লেখ করা হয়, হামিদুর রহমান চট্টগ্রাম আইন কলেজে পড়ার সময় ছাত্রদলের লোক ছিলেন। নগর যুবদলের কয়েকজন নেতা তাকে ছাড়ানোর যাবতীয় ব্যবস্থা করেন। এ কাজে তাদের সহায়তা করেন মহানগর ডিবির বন্দর ও পশ্চিম জোনের উপ-পরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা পরামর্শমূলক ভিডিও দিয়ে ভাইরাল হওয়া এ কর্মকর্তা ডিবি ডিসির (উপ-কমিশনার) ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে পরিচিত। ওই ইউনিটে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা ডিসির সঙ্গে এ কর্মকর্তার বিশেষ সখ্যতার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ডিবির এক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, শ্রমিক লীগ নেতাকে আটকের পর ডিবিতে যুবদল নেতাসহ কয়েকজনের সঙ্গে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় যোগাযোগ করেন ওই এসআই। ডিবিতে তিনি ডিসি স্যারের ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত। একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের লেনদেন এবং ছাত্রদলের সাবেক লোক পরিচয়ে হামিদুরকে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
মেঘনা পেট্রোলিয়ামের এক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে জানান, আওয়ামী লীগের লোক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেন হামিদুর রহমান। তিনি জাতীয় শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত মেঘনা পেট্রোলিয়াম শ্রমিক ইউনিয়নের (সিবিএ) সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আট বছর ধরে রয়েছেন। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রয়েছে। আওয়ামী লীগের লোক পরিচয়ে নিয়োগ, বদলি ও বিটুমিন বিক্রিসহ মেঘনা পেট্রোলিয়ামে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন হামিদুর রহমান।
আইন ভেঙে ছাড়া হয় শ্রমিক লীগ নেতাকে, যে ব্যাখ্যা দিলেন ডিবির ডিসি
ফৌজদারি অভিযোগে থানায় মামলা হলে আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করতে হয়। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তার আসামিকে আটক না করার এখতিয়ার রয়েছে। সেটি কেবল বিবেচনায় নেওয়া যায়– যদি তদন্ত চলাকালে নিশ্চিত হওয়া যায়, আসামি অপরাধের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নয়। যদিও আইনসম্মত প্রক্রিয়া হলো মামলার তদন্ত চলাকালে আসামিকে আদালত থেকে জামিন নিতে হবে।
শ্রমিক লীগ নেতা হামিদুর যে মামলার আসামি সেটি তদন্ত করছে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ। তাকে গ্রেপ্তার করা বা না করার এখতিয়ার রয়েছে থানা পুলিশের। তবে তারা কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম না হলে ডিবি বা অন্য কোনো সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে কাগজে-কলমে বা মৌখিকভাবে তারা আসামিকে গ্রেপ্তার করে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে থাকে। কিন্তু আসামি হামিদুরকে আটকের জন্য ডিবিতে কোনো অনুরোধপত্র পাঠানো হয়নি, এমনকি মৌখিকভাবেও অনুরোধ করা হয়নি। তাছাড়া পাঁচলাইশ থানা ডিবি উত্তর ও দক্ষিণ জোনের আওতাধীন। অর্থাৎ পাঁচলাইশ থানার যদি ডিবির সহায়তার প্রয়োজন হয় তবে তারা ডিবি উত্তর ও দক্ষিণ জোনের কাছে অনুরোধ করে থাকে। তবুও অতি উৎসাহী হয়ে আইন ভেঙে ডিবি বন্দর ও পশ্চিম জোনের কর্মকর্তারা হামিদুরকে আটক করে। পরে আবার আইন ভেঙেই ছেড়ে দেয়। এক্ষেত্রে ছাড়িয়ে নিতে এক যুবদল নেতা তদবির করেন বলে ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদককে কয়েকজন ডিবি কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এস এম দিদার উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, হামিদুরকে যে মামলায় আটক করা হয়েছে সেটি তদন্ত করছে থানা পুলিশ। এক্ষেত্রে প্রথম কথা হলো তাকে গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা একমাত্র তদন্ত কর্মকর্তার রয়েছে। যদি ডিবিকে তদন্ত কর্মকর্তা অনুরোধ করেন তাহলে তারা গ্রেপ্তার করতে পারে। এখন ডিবি যেহেতু আসামিকে আটক করে ফেলেছে সেহেতু উচিত ছিল আসামিকে তদন্ত কর্মকর্তার হাতে সোপর্দ করা। কিন্তু ডিবি তা না করে নিজেরাই এজাহারভুক্ত আসামিকে ছেড়ে দিয়েছে। এতে আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে।
জানতে চাইলে পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সোলাইমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, হামিদুর আমাদের একটি মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। ডিবি থেকে তাকে আমাদের কাছে সোপর্দ করা হয়নি। যদি করা হতো তবে আমরা আইন অনুযায়ী আদালতে সোপর্দ করে দিতাম।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম নগর ডিবি বন্দর ও দক্ষিণ জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) আলী হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা কোনো মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করিনি। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে এবং নাশকতার পরিকল্পনা করছেন এমন সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে আটক করা হয়েছিল। পরে বিভিন্ন লোকের মাধ্যমে আমরা জেনেছি তিনি ছাত্রদলের লোক ছিলেন। যাচাই-বাছাই করে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
এজাহারভুক্ত আসামিকে ছাড়ার বিধান রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি। উৎকোচ নিয়ে ছাড়ার বিষয়টিও অস্বীকার করেন ডিবির এই কর্মকর্তা।
বিএনপি নাকি আওয়ামী লীগের লোক হামিদুর?
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হামিদুর একসময় ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২০০৩ সালের জুন মাসে গঠিত চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদলের কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন তিনি। ওই কমিটির সভাপতি ছিলেন মোশাররফ হোসেন দীপ্তি।
নগর বিএনপির এক নেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রদলের সাবেক হিসেবে আর পরিচয় দেননি হামিদুর। মেঘনা পেট্রোলিয়ামে চাকরিরত অবস্থায় তিনি প্রকাশ্যে বিএনপির বিরুদ্ধে ছিলেন এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। হামিদুর শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত সংগঠন মেঘনা পেট্রোলিয়াম শ্রমিক ইউনিয়নের (সিবিএ) সাধারণ সম্পাদকও হন। সবশেষ জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তিনি ছাত্র-জনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনের বিরুদ্ধে অর্থসহ নানাভাবে সহায়তা করেন। এ কারণে পাঁচলাইশ থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলায় আসামিও হয়েছেন হামিদুর।
এ বিষয়ে হামিদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি মহানগর ছাত্রদলের কমিটিতে ছিলাম এবং ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। শ্রমিক নেতা হিসেবে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায় করতে আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে গিয়েছিলাম। আমাদের অফিসের কেউ ষড়যন্ত্র করে আমাকে মামলার আসামি করেছেন। ডিবিতে যাবতীয় কাগজপত্র দেওয়া হলে তারা আমাকে ছেড়ে দেয়।