গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে ঢাকা-দিল্লির দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ এবং কলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে হামলার ঘটনায় দুই নিকট প্রতিবেশীর সম্পর্ক চরম অস্বস্তি আর টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে আজ (সোমবার, ৯ ডিসেম্বর) ঢাকায় পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে বসছে বাংলাদেশ ও ভারত। মোটাদাগে বৈঠকে উভয়পক্ষ রাজনৈতিক দূরত্ব কমানোর বিষয়ে জোর দেবে। এ ছাড়া ঢাকার পক্ষ থেকে ভারতে বসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ, ভারতীয় গণমাধ্যমের বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার প্রতিরোধ এবং ভিসার জট খোলার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হতে পারে। অন্যদিকে, দিল্লি সম্পর্ক স্বাভাবিক করে তোলার পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের স্বার্থ এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আর্জি জানাতে পারে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন। ভারতের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন দেশটির পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি। বৈঠকে দুই দেশের সম্পর্কের সামগ্রিক বিষয়ে আলোচনা করার সুযোগ থাকবে। বৈঠকে বাণিজ্য, কানেক্টিভিটি, সীমান্ত হত্যা, পানি বণ্টন ছাড়াও থাকবে আরও অনেক উপাদান।
আজ (সোমবার, ৯ ডিসেম্বর) ঢাকায় পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে বসছে বাংলাদেশ ও ভারত। মোটাদাগে বৈঠকে উভয়পক্ষ রাজনৈতিক দূরত্ব কমানোর বিষয়ে জোর দেবে। এ ছাড়া ঢাকার পক্ষ থেকে ভারতে বসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ, ভারতীয় গণমাধ্যমের বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার প্রতিরোধ এবং ভিসার জট খোলার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হতে পারে। অন্যদিকে, দিল্লি সম্পর্ক স্বাভাবিক করে তোলার পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের স্বার্থ এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আর্জি জানাতে পারে
ঢাকার কূটনৈতিক অঙ্গন-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পররাষ্ট্রসচিব হওয়ার পর বিক্রম মিশ্রি প্রথম বাংলাদেশ সফরে আসছেন। ঢাকায় বাংলাদেশ-ভারত পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকে আলোচনার বিষয়বস্তু মুখ্য নয়। বরং, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দুই দেশ আলোচনায় বসছে— এটি হবে বড় বার্তা। রাজনৈতিক বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে।
জানা গেছে, সংক্ষিপ্ত সফরে সোমবার সকালে ঢাকায় আসছেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি। ঢাকায় কয়েক ঘণ্টার সফরে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।
ঢাকার একটি কূটনৈতিক সূত্র বলছে, বৈঠকে সামগ্রিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হলেও বাংলাদেশ তিনটি বিষয়ের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেবে। সেগুলো হলো- ভারতে বসে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সক্রিয়তা বন্ধ, ভারতীয় গণমাধ্যমের বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার প্রতিরোধ এবং ভিসার জট খোলা।
প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে একপর্যায়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথমদিকে তিনি সেখানে একেবারে চুপ থাকলেও পরবর্তীতে তার কিছু টেলিফোন আলাপ ফাঁস হয়। সেগুলো নিয়ে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বেশ বিরক্ত প্রকাশ করে। ভারত সরকারকে এমন রাজনৈতিক বক্তব্য বন্ধের অনুরোধও জানায়। তবে, এতে কোনো কাজ হয়নি।
উল্টো, সাম্প্রতিক সময়ে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বেশ বেড়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আওয়ামী লীগ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে তিনি ভার্চুয়ালি যোগ দেন। রোববার লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক সভায় ভার্চুয়াল মাধ্যমে বক্তৃতা করেন শেখ হাসিনা। এ ছাড়া বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে আগামী ১৬ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের জ্যাকসন হাইটসে আওয়ামী লীগ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে তার ভার্চুয়ালি যোগ দেওয়ার কথা।
ভারতে আশ্রয় নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এমন রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞ বন্ধের পাশাপাশি সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে ভারতীয় গণমাধ্যমের বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার বন্ধে দেশটির সরকারের কার্যকর ভূমিকা চাইবে ঢাকা।
সোমবার বাংলাদেশ-ভারতের পররাষ্ট্রসচিবরা বৈঠকে বসবেন। তাদের বৈঠকে দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নে বড় ধরনের কোনো অগ্রগতি হবে— এটি আশা করা না গেলেও রাজনৈতিক দূরত্ব কমানোর ক্ষেত্রে একটা সুযোগ তৈরি হবে। আশা করছি, উভয়পক্ষ এটি কাজে লাগাতে পারবে
নাম প্রকাশ না করা শর্তে সাবেক এক কূটনীতিক
এ ছাড়া বাংলাদেশিদের জন্য ভারতীয় ভিসার স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। শুধু জরুরি চিকিৎসাসেবা এবং তৃতীয় দেশ সফরের জন্য ভিসাসেবা চালু রয়েছে। অবশ্য ভারতের পক্ষ থেকে জনবলের ঘাটতির কথা বলা হচ্ছে। জনবল বাড়ানোর পর পুরোদমে ভিসাসেবা চালুর আশ্বাস দিয়েছে দেশটি। আশা করা হচ্ছে, পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকে ভিসার জট খোলার বিষয়ে অনুরোধ করা হবে।
একই সঙ্গে ভারত থেকে নিত্যপণ্য আমদানি এবং বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানির বাধা দূরীকরণের বিষয়টি বৈঠকে উপস্থাপন করতে পারে ঢাকা।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে সাবেক এক কূটনীতিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজনৈতিক পালাবদলের পর দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়। সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশে যা ঘটছে পুরো বিশ্ব তা দেখছে। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে চলমান উত্তেজনা কমাতে হবে। সবাইকে আবেগের বহিঃপ্রকাশ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এটি করা না গেলে ভারত কিংবা বাংলাদেশ, কারও জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না।
‘সোমবার বাংলাদেশ-ভারতের পররাষ্ট্রসচিবরা বৈঠকে বসবেন। তাদের বৈঠকে দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নে বড় ধরনের কোনো অগ্রগতি হবে— এটি আশা করা না গেলেও রাজনৈতিক দূরত্ব কমানোর ক্ষেত্রে একটা সুযোগ তৈরি হবে। আশা করছি, উভয়পক্ষ এটি কাজে লাগাতে পারবে’— বলেন ওই কর্মকর্তা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৫ আগস্টের আগে ও পরে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের যে পরিবর্তন, সেটি রাজনৈতিক। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ভারতীয় প্রশাসনের রাজনৈতিক বোঝাপড়া ভালো ছিল। হঠাৎ বাংলাদেশের পটপরিবর্তন হয়। ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। শুরুতে ড. ইউনূসকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অভিনন্দন জানালেও নতুন সরকারের সঙ্গে দেশটির রাজনৈতিক সম্পর্ক সেভাবে তৈরি হয়নি। বরং সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটে। বাংলাদেশ মনে করে, হিন্দুদের প্রতি অত্যাচারের অভিযোগ অতিরঞ্জিত। ভারতের গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক দল তা নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
এমন পর্যায়ে এসে দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক হতে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটা বৈঠক জরুরি ছিল। পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক হবে, এটা খুবই ভালো একটা সুযোগ। এ সুযোগ যেন উভয় পক্ষই গ্রহণ করেন। সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে, সেটা থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা গেলে দুই পক্ষের জন্যই মঙ্গল।
আমাদের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তার বিষয়ে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আমরা ভারত বেষ্টিত। আমরা তাদের পেটের ভেতরে আছি। পেটের ভেতরে অস্থিরতা তৈরি হলে আপনি আরামে থাকবেন, সেটি হওয়ার কথা নয়। এ কারণে আমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখাও ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটা ভারতের দিক থেকেও যেমন দরকার, আমাদেরও দরকার চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ
‘ভারতের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বা বিনিয়োগ রয়েছে। তবে আমাদের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তার বিষয়ে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আমরা ভারত বেষ্টিত। আমরা তাদের পেটের ভেতরে আছি। পেটের ভেতরে অস্থিরতা তৈরি হলে আপনি আরামে থাকবেন, সেটি হওয়ার কথা নয়।’
‘এ কারণে আমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখাও ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটা ভারতের দিক থেকেও যেমন দরকার, আমাদেরও দরকার। ভারতের প্রয়োজন যেমন আমাদের, আমাদেরও তাদের প্রয়োজন। ফলে আমার কাছে মনে হচ্ছে, পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকটি হবে অত্যন্ত ইতিবাচক। সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে এবং চলমান উত্তেজনা প্রশমনে এটি সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।’
ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সম্পাদিত চুক্তি এবং বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে অসন্তোষ আছে। এসব বিষয়ে সমালোচনামুখর দেশের সাধারণ মানুষও। এ প্রসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ বলেন, ‘সম্পর্ক আগে স্বাভাবিক হওয়া জরুরি। ইতোমধ্যে পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে বা আমরা সেটা করে ফেলেছি। এখন আমাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে হবে। সেজন্য দুই পক্ষকে বলতে হবে, সব ঠিক আছে। চুক্তি বা প্রকল্পের ক্ষেত্রে আমরা যদি মনে করি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসমতা আছে, সেগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা হতে পারে। কিন্তু সেগুলো নিয়ে এখন পরিবেশ নষ্ট করাটা ঠিক হবে না।’
এদিকে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বার্তা দিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। রোববার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা বলেন, ‘কোনো সমস্যার সমাধান করতে হলে আগে স্বীকার করতে হবে যে, সমস্যা আছে। আমাদের এটিও স্বীকার করতে হবে যে, ৫ আগস্টের আগে ও পরে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের একটি গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। এটা মেনে নিয়েই আমাদের চেষ্টা করতে হবে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। সেই হিসাবে আমি প্রস্তাব করেছিলাম, আমাদের যে ফরেন অ্যাফেয়ার্স কনসালটেশন, সেটা শুরু করার।’