শান্তিরক্ষা মিশন ওবামা প্রশাসনের নয়ানীতি

Slider টপ নিউজ সারাবিশ্ব

97685_f1

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ব্যাপারে নিজেদের নীতিতে পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শান্তিরক্ষা মিশনে নিজেদের উপস্থিতির হার বাড়াতে চায় দেশটি। এ লক্ষ্যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সংস্থাগুলোকে ইতিমধ্যেই নির্দেশ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। গত ২৮শে সেপ্টেম্বর হোয়াইট হাউস থেকে প্রেরিত ১০ পৃষ্ঠার এক প্রেসিডেন্সিয়াল স্মারক নির্দেশনায় এ নির্দেশ প্রদান করা হয়। এ নির্দেশনা অনুযায়ী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে শীর্ষ সৈন্যদাতা দেশগুলোর ওপর নির্ভরতা কমাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৫ সালের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের সঙ্গে মিল রেখে ওই নির্দেশনায় বলা হয়, বিশ্বজুড়ে ভঙ্গুর রাষ্ট্রের সংখ্যা ও রাষ্ট্রসমূহের অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র সংঘাত প্রতিরোধ, হ্রাস এবং সমাধানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থ জড়িত। ওই নির্দেশনায় বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান জঙ্গিবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ ও আইএস সংশ্লিষ্ট সামপ্রতিক আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের উত্থানকে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত জাতীয় স্বার্থের জন্য হুমকি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এই সব সমস্যা সমাধানে বহুপক্ষীয় কূটনীতি বিশেষ করে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমকে প্রাথমিক মাধ্যম হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করবে বলে উল্লেখ করে ওই স্মারক নির্দেশনায় বলা হয় বিশ্বজুড়ে আমেরিকার কৌশলগত জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে জাতিসংঘ শান্তি মিশনের এ উপযোগিতার সুযোগ নিতে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক নির্ধারিত সীমানার মধ্যে থেকেই কাজ করবে। আর এ উদ্দেশ্যে সংঘাত নিরসন, শান্তির পক্ষে পরিবেশ তৈরি এবং শান্তি বিনির্মাণ প্রক্রিয়ায় কর্মরত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনগুলোকে আরও ব্যাপক, গঠনমূলক এবং কার্যকর করার লক্ষ্যে জাতিসংঘ শান্তিমিশনে যুক্তরাষ্ট্রের অধিকতর কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনবিষয়ক ১৯৯৪ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ঘোষিত প্রথম নীতিমালা প্রেসিডেন্সিয়াল ডিসিশন ডাইরেক্টিভ (পিডিডি-২৫)-এর কথা উল্লেখ করে এ বছরের ২৮শে সেপ্টেম্বরের পিডিডিতে বলা হয় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের আওতায় শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের ক্ষেত্র ও সুযোগ অতীতের তুলনায় বর্তমানে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে জাতিসংঘের ইতিহাসের সর্বোচ্চ সংখ্যক শান্তিরক্ষী (১৬টি শান্তিমিশনে সর্বমোট ১ লাখ ১৯ হাজার) পৃথিবীর সংঘাতসংকুল স্থানগুলোতে কাজ করছে। এর বাইরে ১১টি ফিল্ড পর্যায়ের অফিসের মাধ্যমে জাতিসংঘ মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া এবং আফ্রিকায় পলিটিক্যাল মিশন ও পিস-বিল্ডিং মিশনগুলোয় কাজ চালাচ্ছে।
এদিকে বিশ্বজুড়ে সংঘাত বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শান্তিমিশনে সৈন্য প্রেরণের চাহিদা যেমন বেড়েছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের ব্যয়, জটিলতা এবং ঝুঁকি। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা আশংকা করছেন আগামীতে বিশ্বজুড়ে অস্থিতিশীলতা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে এবং তখন ইতিমধ্যেই প্রয়োজনীয় সৈন্য প্রেরণ করতে হিমশিম খাওয়া জাতিসংঘের বর্তমান শীর্ষ সৈন্য প্রেরণকারী দেশগুলো প্রয়োজনীয় সৈন্য, কৌশল, অভিজ্ঞতা ও আনুষঙ্গিক রসদ যোগান দিতে সক্ষম না-ও হতে পারে। এরকম পরিস্থিতির উদ্ভব হলে তা হবে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার উপর চরম হুমকি। এছাড়া, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেয়া বেশির ভাগ দেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রেকর্ড যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য নয় বলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ওই সব রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসের অভ্যন্তরে এবং কংগ্রেসের বাইরে অনেকদিন ধরেই ব্যাপক সমালোচনার মুখে রয়েছে মার্কিন প্রশাসন। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষকরাও এ বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্ন তুলে আসছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস’ কর্তৃক বিগত জুলাই ২০১৫ প্রকাশিত জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর পল ডি উইলিয়ামসের ‘এনহ্যান্সিং ইউএস সাপোর্ট ফর পিস অপারেশনস ইন আফ্রিকা’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ফান্ড প্রদান, অংশগ্রহণকারী সৈন্যদের প্রশিক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করার যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান নীতিতে পরিবর্তন দরকার। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত সংঘাতপূর্ণ দেশগুলোর শান্তিমিশনগুলোতে এমন মানের নিজস্ব সৈন্য প্রেরণ করা যারা সেখানে টেকসই শান্তি স্থাপনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে এবং এ উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত একটি নিজস্ব জাতীয় শান্তিরক্ষী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা। এছাড়া, জাতিসংঘের বিভিন্ন শান্তিরক্ষা মিশনে এডহক ভিত্তিতে ভূমিকা না রেখে এ বিষয়ে একটি স্থায়ী কৌশলগত প্রশাসনিক অ্যাপ্রোচ গ্রহণ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন প্রফেসর উইলিয়ামস। ওই গবেষণা প্রবন্ধে প্রফেসর উইলিয়ামস আরও বলেন, সুশাসন ও মানবাধিকারের তোয়াক্কা করে না এমন রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম নিয়ে আলাদাভাবে কাজ না করে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত জাতিসংঘের প্রত্যেকটি শান্তিরক্ষা মিশন নিয়ে নিজস্ব পর্যবেক্ষণ, পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা ও মূল্যায়ন এবং সে মোতাবেক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করা। আর এ উদ্দেশ্যগুলো সর্বোত্তমভাবে বাস্তবায়ন করতে যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনগুলোতে নিজস্ব সৈন্য প্রেরণের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে- বলে মত প্রকাশ করেন প্রফেসর পল ডি উইলিয়ামস। উল্লেখ্য, জাতিসংঘের ১৬টি শান্তিরক্ষা মিশনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেবলমাত্র ৭৪০ জন সৈন্য কাজ করে। জাতিসংঘের বার্ষিক প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলারের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে শীর্ষ চাঁদা প্রদানকারী তিনটি দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র (মোট বাজেটের ২৯%), জাপান (১১%) ও ফ্রান্স (৮%)।
হোয়াইট হাউসের বিগত ২৮শে সেপ্টেম্বরের পিডিডি’র নির্দেশনায় জাতিসংঘ শান্তিমিশনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা জোরদার করার লক্ষ্যে তিনটি ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ ভূমিকা রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে:
১). শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী শরিকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সক্ষমতা বৃদ্ধি করে মিশনের লক্ষ্য অর্জনে উপযোগী করে তোলা; ২). শান্তিমিশনের সাফল্যের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অধিকতর কূটনৈতিক সহযোগিতা, সক্ষমতা সহযোগিতা এবং সৈন্য সহযোগিতা প্রদান; এবং ৩). শান্তিমিশনের কার্যক্রম মাঠ পর্যায়ে আরও বেশি গতিশীল ও কার্যকর করতে এর ম্যান্ডেট বিষয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবনায় সংস্কার উদ্যোগের নেতৃত্ব দেয়া। উল্লেখ্য, বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনগুলোকে প্রদত্ত নিরাপত্তা পরিষদের ম্যান্ডেট আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছাড়া শান্তিরক্ষীদের শান্তিরক্ষা মিশনের উদ্দেশ্য লাভের প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের অনুমতি দেয় না, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র চায় শান্তিরক্ষা বাহিনী শান্তির প্রয়োজনে অফেন্সিভ ভূমিকা রাখুক। এ নিয়ে এ বছর প্রেসিডেন্ট ওবামার উদ্যোগে নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা সম্মেলনে সংশ্লিষ্ট সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক চলে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনগুলোকে নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক প্রদত্ত ম্যান্ডেট পরিবর্তনের যে কোন উদ্যোগে ভারত বিরোধিতা করবে বলে উল্লেখ করে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলেন, ভারতীয় সৈন্যরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অন্য কারও পাহারাদার হিসেবে কাজ করবে না।
কিন্তু এতদিন যাবৎ বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা জাতিসংঘ শান্তিমিশনে গেলে ওই মিশনে কর্মরত অন্য দেশের কমান্ডারের অধীনে কাজ করতে হবে এ যুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ শান্তিমিশনে নিজস্ব সৈন্য প্রেরণের ধারণাকে গুরুত্ব দেয়নি। এ বিষয়ে জানতে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী মিশনে যোগাযোগ করলে বলা হয়, মার্কিন জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজনীয় মনে হলে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে প্রেসিডেন্ট প্রতিরক্ষা বাহিনীকে জাতিসংঘ কমান্ডের অধীনে কাজ করার নির্দেশ দিতে পারেন।
এদিকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন নীতি প্রসঙ্গে জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত ডক্টর আবদুল মোমেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষ সৈন্যদাতা দেশগুলোর ওপর থেকে চাপ কমাতে চায়। কারণ বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সৈন্য প্রেরণের চাহিদা  প্রচুর, আমাদের ওপর অনেক চাপ। তাই যুক্তরাষ্ট্র চায়, কমবেশি সকল দেশই শান্তিমিশনে সৈন্য প্রেরণ করুক। উল্লেখ্য, এ বছর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭০তম অধিবেশনের মূল বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘বাংলাদেশ ৪৮ ঘণ্টার নোটিশে জাতিসংঘ শান্তিমিশনে সৈন্য প্রেরণে প্রস্তুত’ বলে উল্লেখ করেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *