কেঁচো সারে ফাতেমার মাসে আয় ৪৫ হাজার টাকা

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি


ফরিদপুর সদর উপজেলার পিয়ারপুর গ্রামের গৃহবধূ কানিজ ফাতেমা (৩১) ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার উৎপাদন করে প্রতি মাসে আয় করছেন ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। ইউটিউব দেখে হাতেখড়ি তার। এ কাজে তিনি নিজে যেমন হয়েছেন স্বাবলম্বী, তেমনি তৈরি করেছেন অন্যদের জন্য কাজের সুযোগও।

ফাতেমার এই উদ্যোগী হওয়ার পথটা সহজ ছিল না। ২০০৭ সালে এসএসসি পাস করার পরে তাকে বিয়ে দেওয়া হয় একই এলাকার শেখ শামসুর রহমানের সঙ্গে। এরপর আর পড়ালেখা চালিয়ে যেতে দেওয়া হয়নি।

তবে ফাতেমা দমে যাওয়ার মানুষ নন, তিনি ২০১৯ সালে ইউএসএআইডির (যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা) সঙ্গে কাজ শুরু করেন। সেখানে তিনি নারীদের হাঁস-মুরগি পালনের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতেন। তবে ভার্মি কম্পোস্ট সম্পর্কে ধারণা তিনি প্রথমে ইউটিউবে দেখেছেন। এরপর মানসিকভাবে স্থির হয়ে কিছু করার আশায় শুরু করেন ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনের কাজ।

ফাতেমা বলেন, ২০২১ সালে আমি একটি স্থানীয় এনজিও থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে দুই কেজি কেঁচো, চারটি কংক্রিটের স্ল্যাব রিং ও চারটি টিন কিনেছিলাম। এবং আমার বাড়ির গরুর গোবর ব্যবহার করে এক মাসে ৪০ কেজি ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি করি। এই সার প্রতি কেজি ১০ টাকা দরে বিক্রি করে ৪০০ টাকা পেয়েছিলাম।

তিনি আরও বলেন, ২০২১ সালের শেষের দিকে আরও ছয়টি কংক্রিটের স্ল্যাব রিং কিনেছিলেন এবং প্রতি মাসে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা উপার্জন করতে শুরু করলাম। এই কাজে এটাই প্রথম আয়। ২০২২ সালে ৬৫ হাজার টাকা ব্যয় করে খামারের জন্য চারটি চৌবাচ্চা এবং একটি টিনশেড ঘর তৈরি করি। এভাবেই বাড়তে থাকে খামারের পরিধি। এই সময় ব্যবসার নামকরণ করি ‘ইহান ভার্মি কম্পোস্ট’।

বর্তমানে ফাতেমা তার বাবার বাড়িতে পাঁচ শতাংশ জমিতে ১০ কংক্রিটের স্ল্যাব রিং এবং নয়টি চৌবাচ্চার মাধ্যমে প্রতি মাসে প্রায় আড়াই টন ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করেন। তিনি এগুলো বিক্রি করেন প্রতি কেজি ১৫-২০ টাকায়। এই ব্যবসায় তিনি এ পর্যন্ত প্রায় ৪ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন।

প্রতি মাসে আড়াই টন ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করতে ফাতেমার প্রয়োজন হয় ৫ টন গোবর, যা তিনি স্থানীয় বাসিন্দাদের থেকে প্রতি কেজি দুই টাকা দরে ক্রয় করেন। সবমিলিয়ে মাসে বর্তমানে তার ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা আয় হচ্ছে।

ফরিদপুর সদরের আলালপুর এলাকার গৃহবধূ চম্পা বেগম বলেন, ফাতেমা প্রতি সপ্তাহে আমার বাড়ি থেকে গোবর সংগ্রহ করেন ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করার জন্য। আর এই গোবর বিক্রি করে আমি প্রতি মাসে ১২০০-১৪০০ টাকা আয় করতে পারি, যা আগে ফেলে দিতাম।

ফাতেমার ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনের জন্য হিয়া বেগম নামের একজন স্থানীয় কর্মীকে নিয়োগ দিয়েছেন। হিয়া বেগম জানান, তিনি বাড়ির কাজ শেষ করে প্রতিদিন ফাতেমার ভার্মি কম্পোস্ট খামারে কাজ করেন। এভাবে তিনি প্রতি মাসে আয় করেন আট হাজার টাকা।

কানিজ ফাতেমা জানান, তিনি নিজে ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করার ধারণা পান ইউটিউবে। নানা পদ্ধতি জানার জন্য ইউটিউবে দেখেছেন অসংখ্য ভিডিও। কাজ শিখতে গিয়েছেন রাজশাহীতেও। তবে বর্তমানে তার কাছে কেউ এলে তিনি তাদের হাতেকলমে শিখিয়ে দেন। এ পর্যন্ত তিনি ২৫ জনকে শিখিয়েছেন ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করার পদ্ধতি। এই ২৫ জনের একজন ফরিদপুর সদর উপজেলার কোমরপুর গ্রামের বাসিন্দা সাহান খান।

সাহান খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করার পদ্ধতি আমি কানিজ ফাতেমার কাছ থেকে শিখেছি। আমি তার কাছ থেকে কেঁচোও ক্রয় করেছি। তিনি নিজে আমার বাড়িতে এসে আমাকে দেখিয়ে গেছেন কীভাবে সার উৎপাদন করতে হয়।

ফাতেমা তার বেশিরভাগ ভার্মি কম্পোস্ট পিয়ারপুর বাজারের সারের দোকানে বিক্রি করেন, আবার কখনো কখনো সরাসরি তার বাড়ি থেকেও বিক্রি করেন। এ ছাড়া তিনি ঢাকার বিভিন্ন দোকান ও গ্রাহকদের ভার্মি কম্পোস্ট সরবরাহ করেন।

ঢাকার মিরপুর-১ এলাকার বাসিন্দা আরিফ হোসেন বলেন, আমি আমার ছাদবাগানের জন্য কানিজ ফাতেমার কাছ থেকে ভার্মি কম্পোস্ট সংগ্রহ করি। গুণগত মান চমৎকার।

ফরিদপুর সদর উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফাতেমা জেলার অন্যতম শীর্ষ ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনকারী। আমরা তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করছি। তিনি দিনে দিনে তার ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করেই চলেছেন। তাকে দেখে অন্যান্য মানুষ বিশেষ করে নারীরা এ কাজে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন। সাংসারিক কাজের পাশাপাশি এটা আয়ের একটি চমৎকার বিকল্প হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *