ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী ও প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা বিদেশে পালিয়েছেন। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলররাও পালিয়ে অথবা আত্মগোপনে চলে যান। পরে মেয়রদের অপসারণ করে প্রশাসক বসানো হয়। অপসারণ করা হয় কাউন্সিলরদেরও। পরে সিটি কর্পোরেশন পরিচালনায় দুটি কমিটি গঠন করা হয়।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় দুই কমিটির ৫০ জন ও ২০ জন আঞ্চলিক কর্মকর্তাসহ ৭০ জনকে। বর্তমানে ওয়ার্ডগুলোতে প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে সংশ্লিষ্ট সচিবরা দায়িত্ব পালন করছেন। তবে নানা জটিলতার কারণে তারা নাগরিকসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।
এ অবস্থায় সেবা নিয়ে ভোগান্তি বেড়েছে নগরবাসীর। দুই সিটির বাসিন্দারা বলছেন, কাউন্সিলর না থাকায় আগে যেসব সেবা পেতেন তাও এখন ঠিকমতো মিলছে না। প্রতিদিনই কাউন্সিলরের অফিসে গিয়ে সেবা না পেয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে।
নাগরিক সেবায় ভোগান্তি
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জন্ম সনদ, মৃত্যুর নিবন্ধন, চারিত্রিক সনদসহ অন্য সেবা নিতে এসে নাগরিকদের নানা ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। অন্যদিকে, দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতির এখনো অবনতি হচ্ছে। অথচ মশক নিধনে মশক কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মিত ওষুধ ছিটানোর বিষয়ে নেই যথেষ্ট তদারকি। এ ছাড়া ময়লা বাণিজ্য দখল নিয়ে জটিলতার কারণে নিয়মিত বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য অপসরণ কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে।
সেবাগ্রহীতারা বলছেন, মেয়র-কাউন্সিলররা না থাকায় কোনো কিছুই শৃঙ্খলার মধ্যে নেই। তাই নাগরিক সেবা কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে এসেছে।
ডিএনসিসিতে সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন ৫৪ জন এবং সংরক্ষিত আসনের মহিলা কাউন্সিলর ছিলেন ১৮ জন। ডিএসসিসিতে সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন ৭৫ জন এবং সংরক্ষিত আসনের মহিলা কাউন্সিলর ছিলেন ২৫ জন। সবমিলিয়ে কাউন্সিলর ছিলেন ১৭২ জন। সেখানে দুই সিটি কর্পোরেশন পরিচালনায় দুই কমিটিতে ৫০ জন, আঞ্চলিক কর্মকর্তা ২০ জনসহ ৭০ জন সরকারি কর্মকর্তাকে জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা নুরুন নাহিদ বলেন, জনপ্রতিনিধি না থাকায় সিটি কর্পোরেশন থেকে নাগরিক সেবা পেতে আমাদের খুব ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, কিছু কিছু সড়কে লাইট নষ্ট, অন্ধকারে চলাচল করতে এলাকাবাসীর সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু এ অভিযোগটা জানানোর কোনো জায়গা এই মুহূর্তে আমাদের নেই। সাধারণ মানুষকে ভাঙা রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। কিন্তু রাস্তা সংস্কারের কোনো উদ্যোগ আমরা দেখছি না। কাউন্সিলর অফিসে যারা দায়িত্বে আছেন তাদের বারবার বলা হয়েছে কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। মূলত কাউন্সিলররা না থাকায় মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে।
রাজধানীর মধ্য বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা আলমগীর হোসেন বলেন, আমার ছেলের পাসপোর্ট করানোর জন্য নাগরিক সনদ প্রয়োজন, যা কাউন্সিলর অফিস থেকে দেওয়া হয়। কিন্তু আমি বেশ কিছুদিন যাবত ঘুরেও নাগরিক সনদ সংগ্রহ করতে পারছি না। যেহেতু কাউন্সিলর নেই, তাই সে কাজ ঠিকমতো করে নিতে পারছি না। বর্তমানে ওয়ার্ড সচিবরা এসব সেবা দিচ্ছেন। কিন্তু নানা কারণে কাউন্সিলররা সাধারণ মানুষদের যে সাপোর্ট দিতেন সেই সাপোর্টটা এখন পাওয়া যাচ্ছে না। একটা কাজের জন্য বারবার যেতে হচ্ছে তবুও সেই সেবাটা আমরা ঠিকমতো পাচ্ছি না।
নাগরিকদের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের এক ওয়ার্ড সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কিছু কিছু জায়গায় সেবা দিতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে, এটা ঠিক। সনদপত্র কেন্দ্রিক মানুষের যে অভিযোগ তা সঠিক। কারণ আগের যে প্যাডে নাগরিক সনদ দেওয়া হতো এখন সেই প্যাড আর কার্যকর নেই। ফলে নতুন করে প্যাড, সিল বানিয়ে নাগরিক সনদ ইস্যু করতে হবে। সে কারণে নাগরিক সনদ নিতে এসে অনেককে ঘুরে যেতে হয়েছে। এ ছাড়া কাউন্সিলররা সার্বিক কাজে অভ্যস্ত ছিলেন, এ অবস্থায় হুট করে তারা নেই। নতুন কর্মকর্তারা দায়িত্বে এসে এসব কাজ করতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে।
স্কুলে ভর্তির জন্য জন্ম সনদ পেতে ভোগান্তিতে অভিভাবকরা
নতুন বছরে সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে আবশ্যিক প্রয়োজন জন্ম সনদ। কিন্তু ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের বাসিন্দারা তাদের সন্তানদের জন্য জন্ম সনদ নিতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১ থেকে ৩৬ নম্বর পর্যন্ত ওয়ার্ডে কাউন্সিলররাই জন্ম সনদ দিতে পারতেন। কিন্তু বর্তমানে কাউন্সিলররা না থাকায় জন্ম সনদ নিতে গিয়ে বারবার ঘুরতে হচ্ছে অভিভাবকদের। এ ছাড়া উত্তর সিটির ৩৭ থেকে ৫৪ নম্বর পর্যন্ত ওয়ার্ডে জন্ম সনদ পেতে নাগরিকদের যেতে হতো এলাকা ভিত্তিক ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয়ে। অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে জন্ম সনদ নিতে অভিভাবকরা সেখানে গিয়েও ভোগান্তিতে পড়ছেন। একই অবস্থা ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়েও।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে আঞ্চলিক কার্যালয়ে সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করাতে এসেছিলেন লুৎফুর নাহার নামের একজন। তিনি কয়েকদিন ঘুরেও জন্ম নিবন্ধন করাতে পারেননি। এ অভিভাবক বলেন, জন্ম নিবন্ধন করানো মনে হচ্ছে সবচেয়ে ভোগান্তির কাজ। জন্ম সনদ নেওয়ার যে ভিড় তাতে তা পাওয়া মুশকিল বললেই চলে। আমি কয়েকদিন ঘুরলাম তবুও পাচ্ছি না।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয়ে এসে জন্ম সনদ পাননি আজগর আলী নামের একজন অভিভাবক। তিনি বলেন, আগে বেশ কয়েক মাস ঘুরেছি কিন্তু কাজ হয়নি। এখন আবার কাউন্সিলর নেই। সে কারণে ওয়ার্ড সচিবের কাছে আরও কয়েকদিন ঘুরতে হয়েছে। এখন জানানো হয়েছে আমার জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্ম সনদের মধ্যে কিছুটা তারতম্য আছে। যে কারণে আমার ছেলের জন্ম সনদ হবে না। আগে আমারটা ঠিক করাতে হবে। এটি ঠিক করার জন্য ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয়ে বেশ কিছুদিন ধরে ঘুরছি কিন্তু কাজ করাতে পারছি না।
তিনি আরও বলেন, নতুন বছরে ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাতে হবে কিন্তু জন্ম সনদ ছাড়া তো সেটা সম্ভব নয়। দিনের পর দিন সিটি কর্পোরেশনের বারান্দায় ঘুরেও কোনো লাভ হচ্ছে না।
জন্ম সনদ নেওয়ার জন্য এখন অভিভাবকদের খুব ভিড় হচ্ছে জানিয়ে ডিএসসিসির অঞ্চল-২ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিব বলেন, নতুন বছরে সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য এসময়ে জন্ম সনদের চাহিদা বেড়ে যায়। এখন সব আঞ্চলিক কার্যালয়ে অভিভাবকদের ভিড় বেড়েছে।
জন্ম মৃত্যু রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের তথ্য মতে, এ বছরের ৬ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে জন্ম নিবন্ধনের আবেদনের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৩৯৮। গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৪ হাজার ২৬১টিতে। সবশেষ নভেম্বরের প্রথম ১০ দিন পর্যন্ত জন্ম নিবন্ধনের আবেদনের সংখ্যা ছিল ৩৮ হাজার ৫৫টি আর জন্ম নিবন্ধন হয়েছে ৩৩ হাজার ৯১৮টি।
ডেঙ্গুর ভয় আর মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ নগরবাসী
মশার উপদ্রবে রীতিমতো অতিষ্ঠ ঢাকার দুই কোটির বেশি বাসিন্দা। দুই সিটিতে নতুন প্রশাসক আসার পর নানা উদ্যোগ, অভিযানসহ নিত্য নতুন কার্যপরিচালনা করেও হার মানতে হচ্ছে মশার কাছে। মূলত কাউন্সিলরদের অনুপস্থিতিতে ভেঙে পড়েছে ওয়ার্ড ভিত্তিক মশক নিধন কার্যক্রম। অন্যদিকে প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। যা দেখে ডেঙ্গুর ভয় আরও বাড়ছে নাগরিকদের।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন বাসাবো এলাকার বাসিন্দা রাজিব আহমেদ বলেন, অনেক দিন ধরে মশক নিধন কর্মীদের দেখতেই পাই না। তারা আসলে কাজ করে না কি করে, কিছুই বুঝতে পারি না। মশার অত্যাচারে দিনরাত সবসময় মশারি টানিয়ে বাসায় থাকতে হয়। আবার যে হারে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে তা দেখে ভয়ে বুক শুকিয়ে আসছে। আমাদের বেশ কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন ইতোমধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। আগে মেয়র-কাউন্সিলররা মশা মারার কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতেন, এখন তারা না থাকায় এসব কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রমের সুপারভাইজার জাহিদুর রহমান বলেন, আমরা মশক নিধন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। আগে এলাকা ভিত্তিক কাউন্সিলররা এসব তদারকি করতেন, এখন আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে করা হচ্ছে। আমাদের কর্মীরা তাদের রোস্টার অনুযায়ী ঠিকমতোই মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আমরা সার্বক্ষণিক বিষয়গুলো মনিটরিং করছি।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মুখপাত্র মকবুল হোসাইন বলেন, মশক নিধনে যাবতীয় কার্যক্রমের পাশাপাশি জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমও আমরা পরিচালনা করছি। মশা নিধনে আমাদের কোনো কার্যক্রমই থেমে নেই।