নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ আলোচিত সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বারাসাতের মুখ্য বিচার বিভাগীয় আদালত। শুক্রবার এই মামলার শুনানি ছিল। শুনানি শেষে উত্তর চব্বিশ পরগনার অতিরিক্ত মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট সন্দ্বীপ চক্রবর্তী এই নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি তার নির্দেশে নূর হোসেনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হলো কিনা সেটা দু’মাসের মধ্যে আদালতকে জানাতে বলেছেন। দীর্ঘ ১৬ মাস নূর হোসেন ভারতের জেলে রয়েছেন। প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, দ্রুততার সঙ্গেই নূর হোসেনকে বিএসএফ’র মাধ্যমে সীমান্তে বিজিবি’র হাতে প্রত্যর্পণ করা হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের স্বাক্ষরিত প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী নূর হোসেনকেই প্রথম প্রত্যর্পণ করা হচ্ছে। গত কিছুদিন ধরেই নূর হোসেনকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে সরকারি স্তরে তৎপরতা চলছিল। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অনুরোধে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক নূর হোসেনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে সবুজ সংকেত দেয়। এর পর পশ্চিমবঙ্গের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের নির্দেশে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩১১ ধারা অনুযায়ী নূর হোসেনের বিরুদ্ধে ফরেনার্স আইনে আনা মামলা প্রত্যাহার করে দেবার জন্য সরকারি কৌঁসুলি আদালতে আবেদন জানান। আবেদনে মামলা প্রত্যাহারের কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছিল যে, নূর হোসেন বাংলাদেশের একজন দাগি অপরাধী। তার নামে ইন্টারপোলের রেডকর্নার নোটিস রয়েছে। বাংলাদেশে প্রেপ্তার এড়াতেই তিনি ভারতে এসে বেআইনিভাবে আত্মগোপন করে ছিলেন। সেই আবেদনে আরও বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ সরকার ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের মাধ্যমে নূর হোসেনকে নিজেদের দেশে ফেরত নিতে চেয়েছে। সেজন্যই সরকার অনুপ্রবেশের মামলাটি প্রত্যাহার করে নূর হোসেনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চায়। সরকারি আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন দে জানিয়েছেন, আদালতের পূর্ণ ক্ষমতা রয়েছে বিচারের যে কোন পর্যায়ে মামলা প্রত্যাহারের সরকারি আর্জি মেনে নেয়ার। বিচারক এদিন সেটিই করেছেন। তবে গত একমাসে দু’দুবার মামলার শুনানি হওয়ার কথা থাকলেও নানা কারণে তা হয়নি। একেবারে শেষপর্যায়ে নূর হোসেন কয়েকজন আইনজীবী নিয়োগ করে মামলা দীর্ঘায়িত কররতে সচেষ্টা হয়েছিলেন। তার হয়ে আইনজীবীরা তাদেও বক্তব্য শোনও আরজি জানিয়েছিলেন। তবে শুক্রবার মামলার শুনানি শেষে মামলা প্রত্যাহার করে নেয়ার অনুমতি দিয়েছেন বিচারক। সেই সঙ্গে তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোরও নির্দেশ দিয়েছে আদালত। গত বছরের ১৪ই জুন কলকাতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অদূরে কৈখালীতে ভিআইপি রোডের উপর সুবিশাল ইন্দ্রপ্রস্থ আবাসনের এ-ব্লকের একটি বাড়ির চারতলার ৫০৩ নম্বর ফ্ল্যাট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল নূর হোসেন ও তার দুই সহযোগী খান সুমন ও ওহিদুল জামান। গত ১৫ই জুন বারাসাত আদালতে পুলিশ যে কেস ডায়েরি পেশ করেছিল তাতে বলা হয়, বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার শিমরাইলের বাসিন্দা নূর হোসেন ওরফে চেয়ারম্যান, বন্দর থানার কুড়িপাড়ার ওহিদুল জামান শালিম ওরফে শালিম ও ফতুল্লা থানার বাসরবাদের খান সুমন ওরফে বিট্টুকে অবৈধভাবে ভারতের অনুপ্রবেশের দায়ে বিদেশী আইনের ১৪ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, এরা বসিরহাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিল। এদের কাছে ভারতের ও বাংলাদেশের ১১টি সিম কার্ড ও ভারত ও বাংলাদেশের কয়েক হাজার টাকা পেয়েছে। পুলিশ প্রথমদিকে নূর হোসেনকে হেফাজতে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বাংলাদেশী অপরাধী ও তার কনটাক্টম্যানদের খোঁজে তল্লাশি চালালেও পরবর্তীতে আর রিমান্ডে নেয়া হয়নি। ঘটনার বিবরণে জানা গেছে, গত বছরের ২৭শে এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম এবং আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজন অপহৃত হন। অপহরণের পরপরই নজরুলের পরিবারের পক্ষ থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। মামলার পর অভিযোগ অস্বীকার করে সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য দিলেও তিনদিনের মাথায় শীতলক্ষ্যা নদীতে অপহৃতদের লাশ ভেসে ওঠার পর লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান নূর হোসেন। নূর হোসেন ও তার সহযোগীরা র্যাবকে ছয় কোটি টাকা দিয়ে নজরুলসহ সাতজনকে হত্যা করিয়েছেন বলে নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম অভিযোগ করেন। তার অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব-১১ এর তখনকার অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন এবং লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এমএম রানাকে অবসরে পাঠানো হয়। এরপর হাইকোর্টের নির্দেশে র্যাব’র সাবেক তিন কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হন। আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে আরিফ ও রানা ওই ঘটনায় তাদের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেন। নূর হোসেনের কাছ থেকে পাওয়া অর্থের বিনিময়ে তারা নজরুলসহ সাতজনকে খুন করেছেন বলে স্বীকারোক্তি দেন। তবে ঘটনার পর থেকেই নূর হোসেন পলাতক ছিলেন। র্যাব’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, নূর হোসেন কলকাতায় পালিয়ে গেছেন। তাকে ধরার জন্য ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিস জারি করা হয়েছিল। ভারতের কাছেও পাঠানো হয়েছিল সেই আবেদন। সেই নোটিশের ভিত্তিতেই নূর হোসেনকে শনাক্ত করেছিল বিধান নগর পুলিশ কমিশানেরেটের গোয়েন্দারা। আদালতে হাজির হওয়ার প্রথমদিকে নূর হোসেন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিলেন যে, তিনি রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার। আর বাংলাদেশে মামলা হওয়াতেই তিনি ভারতে চলে এসেছেন। কে তাকে ফাঁসিয়েছে তার নাম বলতে অস্বীকার করলেও তিনি জানিয়েছেন, যে তাকে ফাঁসিয়েছে সেই তাকে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছে। একপর্যায়ে তিনি দাবি করেছিলেন, নজরুলের সঙ্গে তার কোন বিরোধ ছিল না। তিনি র্যাবকে টাকা দেয়ার কথাও অস্বীকার করেছিলেন। একপর্যায়ে দেশে ফিরে বিচারের মুখোমুখি হতে রাজি বলেও তিনি জানিয়েছিলেন।
ফিরিয়ে আনতে আরও কিছুটা সময় লাগবে-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী: নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনতে আরও কিছুটা সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। ভারতের আদালতে দেয়া নির্দেশনার বিষয়ে অবহিত হওয়ার পর তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাকে ফিরিয়ে দিতে ভারত সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে চিঠি আদান-প্রদান হয়েছে। আদালতের আদেশের পর এখও ভারত থেকে বাংলাদেশের কাছে এ ব্যাপারে কিছু জানানো হয়নি। পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে তাই কিছুটা সময় লাগবে। তিনি বলেন, ভারত সরকার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানাবে। সেখান থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নোট ভারবাল পাঠানো হবে। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে।