মা ইলিশ রক্ষায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলায় নদীতে সব ধরনের মাছ ধরা, বিক্রি ও পরিবহন বন্ধ। কিন্তু তারপরেও রাজবাড়ীর সদর উপজেলা ও গোয়ালন্দ উপজেলার নদী তীরবর্তী এলাকায় প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে ইলিশ। নদীতে এ সময়েও ইলিশ ধরার মহোৎসব চলছে, গ্রাহকের কাছে সেগুলো পৌঁছাচ্ছে হোম ডেলিভারি।
সদর উপজেলার চন্দনী ইউনিয়নের জৌকুড়া ঘাট থেকে গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ঘাট পর্যন্ত নদী এলাকায় চলছে এসব ইলিশ বেচাকেনা। বিশেষ ক্ষেত্রে রাজবাড়ী শহরে এনে চোরাই ইলিশ হোম ডেলিভারিও দিচ্ছেন অসাধু জেলে ও তাদের লোকেরা।
তবে জেলা মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যে-সব জেলেরা মাছ ধরছেন তাদের ভিজিএফসহ অন্যান্য সুবিধা বাতিল করা হচ্ছে। এছাড়াও ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাদের জেল, জরিমানা করা হচ্ছে। তাদের থেকে জব্দ করা জাল পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে।
শনিবার (১৯ অক্টোবর) সরেজমিনে রাজবাড়ী সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়ন ও গোয়ালন্দ উপজেলার নদী তীরবর্তী এলাকায় পদ্মা নদীতে জেলেদের নৌকা নিয়ে মাছ শিকার করতে দেখা গেছে।
একই দিন দুপুর ১২টার দিকে গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়নের কাওয়ালজানি গ্রামের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন অবৈধ শৌখিন জেলেরা নদী থেকে ইলিশ শিকার করে তারা নদীর তীরে এনেই বিক্রি করছেন। ১ কেজির বেশি ওজনের ইলিশগুলো তারা ১ হাজার ৫০০ টাকা ও ছোট (জাটকা) ইলিশ মাছ ৫৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন তারা। তবে এ সময় নদীতে মৎস্য বিভাগের কাউকে অভিযান চালাতে দেখা যায়নি।
এদিকে নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন সময়েও দৌলতদিয়া ফেরিঘাট, লঞ্চঘাট, চলন্ত ফেরি ও লঞ্চে প্রকাশ্যে ব্যবসায়ীদের ডালিতে করে ইলিশ বিক্রি করতে দেখা গেছে। এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ভাইরাল হয়েছে।
একটি বিশেষ সূত্রে জানা গেছে, নিষেধাজ্ঞা শুরু হওয়ার পর থেকে নদী থেকে দিনে ও রাতে অবৈধভাবে ধরা ১ কেজি বা তার বেশি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা কেজি হিসেবে। আর ২৫০ গ্রাম বা তার চেয়ে কম/বেশি ওজনের সাইজের ইলিশ ৫০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এসব মাছ রাজবাড়ী শহরে জেলে ও তাদের লোকজন বিভিন্ন বাসাবাড়িতে হোম ডেলিভারিও দিচ্ছেন।
মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রাজবাড়ী জেলায় পদ্মা নদীর অংশ রয়েছে ৪২ কিলোমিটার। গত ১৩ অক্টোবর থেকে আজ ১৯ অক্টোবর ৭ দিনে জেলায় মা ইলিশ রক্ষা অভিযান চালিয়ে মোবাইল কোর্টে চারজন জেলেকে ৭ দিনের কারাদণ্ড ও ২৬ হাজার ৪০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়াও এই সাত দিন অভিযান চালিয়ে ইলিশ শিকারে ব্যবহৃত অবৈধ ১ লাখ ৬২ হাজার মিটার কারেন্ট জাল পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়েছে এবং ৩১০ কেজি ইলিশ জেলেদের কাছ থেকে জব্দ করে স্থানীয় এতিমখানায় দান করে দেওয়া হয়েছে।
গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও প্রতিদিনই বিভিন্ন অবৈধ শৌখিন জেলেরা পদ্মা নদী থেকে কারেন্ট জাল দিয়ে ইলিশ ধরে নদীর কিনারে নিয়ে আসছেন। সেখানে প্রকাশ্যে বড়, ছোট ইলিশ মাছগুলো মৌসুমি মাছ ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া সেখানে একটু কম দামে পাওয়ায় গ্রামের অনেক দরিদ্র মানুষ সেখান থেকে ইলিশ কিনছেন। পুলিশ এসে অভিযান চালালেও অজানা কারণে তারা রেহাই পেয়ে আবার অগোচরে মাছ ধরা অব্যাহত রাখছেন।
মাছ কিনে নেওয়া এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইলিশগুলো আমরা এখান থেকে একটু কম দামে কিনে নিয়ে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে একটু লাভ রেখে বিক্রি করি। তবে তিনি এ ব্যাপারে ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি।
দৌলতদিয়া ঘাট নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. এমরান হোসেন তুহিন বলেন, আমি সবেমাত্র দৌলতদিয়া নৌ-পুলিশ ফাঁড়িতে এসে যোগদান করেছি। এখন ইলিশ মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষেধ। আপনাদের কাছ থেকে জেলেদের প্রকাশ্যে মাছ ধরা ও বিক্রির বিষয়টা জেনেছি। এমন কোনো ঘটনা ঘটে থাকলে আমরা নৌ-পুলিশ নিয়ে নদীতে অভিযান চালাবো।
গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জ্যোতি বিকাশ চন্দ্র বলেন, গত ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত কেউ মা ইলিশ ধরতে পারবেন না। গোয়ালন্দের ১৯ কিলোমিটার অংশের পদ্মা নদীতে প্রশাসন, থানা পুলিশ ও মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞার মধ্যে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞার এই সময়ের মধ্যে কেউ মা ইলিশ ধরলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, নদীর মাছ বিক্রির অভিযোগ এসেছে। শনিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত সেনাবাহিনী নিয়ে পদ্মা নদীর কলাবাগানসহ দেবগ্রামে অভিযান চালানো হয়েছে।নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করা হবে।
এদিকে রাজবাড়ী জেলা মৎস্য অফিসার না থাকায় সেখানে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছে সদর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোস্তফা আল রাজীব। এছাড়া দীর্ঘদিন গোয়ালন্দ উপজেলাতে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা না থাকায় তিনি একই সঙ্গে গোয়ালন্দ উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। অর্থাৎ রাজবাড়ী জেলা অফিস, রাজবাড়ী সদর ও গোয়ালন্দ উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তার তিনটি পদের দায়িত্ব তিনি একাই পালন করছেন। রাজবাড়ী জেলা পদ্মা বিধৌত হওয়ায় একই সঙ্গে তিনটি দপ্তর দেখভাল করায় তিনি কতটুকু নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারছেন এ বিষয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে রাজবাড়ী জেলা মৎস্য অফিসার ও সদর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোস্তফা আল রাজিব বলেন, আমরা রাজবাড়ী সদর উপজেলার পদ্মা নদীর অংশে শনিবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত অভিযান চালিয়েছি। এ সময় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে অবৈধভাবে ইলিশ শিকারের দায়ে চার জেলেকে ৫ হাজার টাকা করে মোট ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়া তাদের কাছে পাওয়া ৫০ হাজার মিটার কারেন্ট জাল পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয় যার আনুমানিক মূল্য ১০ লাখ টাকা। তাদের কাছে থেকে জব্দকৃত ৬০ কেজি ইলিশ পাঁচটি এতিমখানায় দান করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গোয়ালন্দের দেবগ্রামে ইলিশ শিকার ও বিক্রির বিষয়টি আমি শুনেছি। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা বিভিন্ন স্থানে সাধ্যমতো অভিযান চালাচ্ছি।
রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) সিদ্ধার্থ ভৌমিক বলেন, মাছ বিক্রির বিষয়টি আমি শুনেছি। মৎস্য অফিসারকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। মা ইলিশ রক্ষা করতে আমাদের অভিযান চলছে। আজকেও চারজন জেলেকে ৫ হাজার টাকা করে মোট ২০ হাজার টকা জরিমানা করা হয়েছে এবং ৫০ হাজার মিটার অবৈধ কারেন্ট জাল পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, এ বছর রাজবাড়ীতে মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান-২০২৪ চলছে ঢিলেঢালাভাবে। বিগত বছরগুলোতে লাগাতার অভিযান চালানো হলেও এবার চলছে কচ্ছপ গতিতে। নিষেধাজ্ঞা শুরু হওয়ার পর থেকে নদীতে দিনে ও রাতে অবৈধভাবে ধরা হচ্ছে ইলিশ। জৌকুড়া ঘাট থেকে দৌলতদিয়া পর্যন্ত নদী এলাকায় চলছে এসব ইলিশ বেচাকেনা। বিশেষ ক্ষেত্রে রাজবাড়ী শহরে এনে সেগুলো হোম ডেলিভারিও দেওয়া হচ্ছে।