মানুষ বেড়েছে কমেছে বাস, ‘উদাসীন’ সরকার

ঢাকা

ghari.thumbnailশনিবার বিকাল ৫টা; রাজধানীর বাংলামোটর মোড়ে বাসের অপেক্ষায় শতাধিক মানুষ। মোড়ের দুদিকে কয়েক কিলোমিটারজুড়ে কারওয়ানবাজারমুখী সড়কে গাড়ির সারি, সেগুলোর মধ্যে বাসের সংখ্যা হাতেগোনা। সিগন্যাল ছাড়ার পর একটি/দুটি বাস এলে তাতে উঠার জন্য হুড়োহুড়ি-বাসের দরজায় বাদুরঝোলা হয়ে যেতে দেখা যায় কয়েকজনকে।

সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাংলামোটর মোড়ে বাস সংকটের এ চিত্র রাজধানীতে নিত্যদিনের। কর্মদিবসগুলোতে বাসে উঠতে শাহবাগ, বাংলা মোটর, ফার্ম গেইটসহ রাজধানীর অধিকাংশ বাসস্ট্যান্ডে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় যাত্রীদের।

সকালে অফিস যাওয়ার পালা আর বিকালে অফিস ছুটির পর সে অপেক্ষা সবচেয়ে দীর্ঘ হয়। প্রতিযোগিতা করে বাসে উঠতে গিয়ে ধাক্কা-ধাক্কিতে আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে।

নগরীতে মানুষ বাড়লেও সে তুলনায় গণপরিবহন না বেড়ে বরং কমায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

রাজধানীতে গণপরিবহনের সংকটের জন্য সরকারের ‘উদাসীনতাকে’ দায়ী করেছেন এক নগর পরিকল্পনাবিদ। পরিবহন মালিকদের কণ্ঠেও সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ; কর্তৃপক্ষের ‘উদাসীনতার কারণেই’ নগর পরিবহন খাত ধ্বংস হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের।

তারা বলছেন, সরকারের পরিকল্পনার অভাব, পর্যাপ্ত বাসস্ট্যান্ড না থাকা, যানজট আর যন্ত্রপাতির দাম বাড়ায় অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন।images

বছর দশেক আগে ঢাকার সড়কে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার বাস চলাচল করত বলে বাস মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। এই সময়ে ঢাকায় মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হলেও কমেছে বাসের সংখ্যা।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএ’র ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর ১৬৮টি রুটে চলাচলকারী বাসের সংখ্যা ৫ হাজার ৪০৭টি। এরমধ্যে- মিনিবাস ৩ হাজার ১২৬টি, আর বাস আছে ২ হাজার ২৮১টি।

বিআরটিএ এ হিসাব দিলেও পরিবহন মালিকদের হিসেবে, রাজধানীতে চলাচলকারী বাসের সংখ্যা চার হাজারেরও কম।

ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকা শহরে মানুষের সংখ্যা এক কোটি ৬০ লাখ। আর ২০০৫ সালে এ সংখ্যা ছিল ৭২ লাখ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণপরিবহন সমস্যা নিরসনে সরকারের ‘উল্লেখযোগ্য কোনও উদ্যোগ’ না থাকায় প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।

বছর দশেক আগে ঢাকার সড়কে বেসরকারি উদ্যোগে প্রথম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস সার্ভিস নিয়ে এসেছিল ট্রান্স সিলভা লিমিটেড।index

প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম নিজের পরিবহন ব্যবসার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন ।

১৯৯৪ সালে ভারতের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টাটা থেকে ৯৭টি ডেডিকেটেড সিএনজি বাস আমদানি করে যাত্রা শুরু করে ট্রান্স সিলভা। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির বাসের সংখ্যা ২৫টি।

রেজাউল বলেন, “কাউন্টারের মাধ্যম প্রথম নগর পরিবহন সেবা আমরাই শুরু করেছিলাম। পরে আমাদের দেখে আরও অনেকে এ ধরনের সেবা শুরু করে। সেসময় ঢাকার মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে বাসে উঠত, পাঁচ মিনিট পরপর বাস পাওয়া যেত।

“প্রথম যখন সরকার সিএনজি গ্যাসের দাম বাড়ালো এরপর প্রায় বছর তিনেক বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়নি। এসময়ই মূলত আমাদের ব্যবসার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়। তারপর শুরু হলো কাউন্টারগুলোর বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান। আমাদের সব কাউন্টার তুলে দেয়া হল।”

তিনি বলেন, কাউন্টার না থাকার কারণে যে সুশৃঙ্খল পরিবেশ ছিল তা নষ্ট হয়ে গেলো। এছাড়া বাস এক্সেসরিজের উপরে ট্যাক্স আরোপ করায় এগুলোর দাম অনেকগুণে বেড়ে যায়।

“ঢাকার যাত্রীদের একটি বড় অংশ পুলিশ ও ছাত্র। এরা কখনোই বাসে ভাড়া দিতে চায় না। তাদের দেখা দেখি অনেক অছাত্রও নিজেদের ছাত্র দাবি করে চলাচল করে। এদের কিছু বললেই এরা বাস ভাংচুর করে।”

তাই ক্ষতি এড়াতে এক পর্যায়ে ৬০টি বাস বিক্রি করে দেওয়ার কথা জানান তিনি। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের যে বাসগুলো চলছে, সেগুলোতে নতুন করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র আর লাগানো হয়নি।

“পরে যে বাকি বাসগুলো রয়েছে এগুলো ড্রাইভারদের কাছে লিজ দেওয়া হয়েছে। তারা যত্রটত্র যাত্রী তুলে কিছু দিলে দেয় না দিলে না দেয়।”

এ বিষয়ে এসোসিয়েশন অব বাস কোম্পানিজের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার রফিকুল হোসেন কাজল বলেন, “ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থার আজকের যে নাজুক পরিস্থিতি এটার জন্য একমাত্র দায় সরকারের।

“এ খাতটিকে সরকার যদি আসলেই উন্নত করতে চায় তাহলে মালিকদের কিছু কিছু জায়গায় সাবসিডি দিতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণপরিবহনে সাবসিডি দেওয়া হয়।”

তিনি বলেন, “যানজটের কারণে কোনো বাসই কাঙিক্ষত ট্রিপ মারতে পারে না। ফলে এ ব্যবসায় খুব একটা লাভ নেই।

“আপনি কোটি কোটি টাকা ইনভেস্ট করে রাস্তায় বাস নামাবেন, কিন্তু দেখা যাবে বছর শেষে তেমন একটা লাভ পাচ্ছেন না। তাহলে কি সেই ব্যবসা করবেন? ঠিক একই কারণে মালিকরা নতুন করে বিনিয়োগ করছেন না, যে কয়জন টিকে আছেন তারাও খুব বেশি দিন এ ব্যবসা ধরে রাখতে পারবেন না।”

কাজল বলেন, সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার ছয় থেকে সাতবার যাত্রী পরিবহন করতে পারলেও কর্মব্যস্ত দিনে তিনবারের বেশি তা হয় না।

গণপরিবহন সংকট নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর অঞ্চল ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক সারোয়ার জাহান বলেন, “দেড় কোটির বেশি জনসংখ্যার এ শহরে বাস প্রয়োজন অন্তত ১২ থেকে ১৩ হাজার। এ সংখ্যা বর্তমানে তিন হাজারের মত।

“এর প্রধান কারণ সরকার গণপরিবহন নিয়ে মাথা ঘামায় না। ঢাকায় যানজটের কারণে বাস মালিকরাও কাঙ্ক্ষিত সংখ্যায় ট্রিপ পান না। আর এ কারণে তারাও এ সেবা নিয়ে খুব বেশি উৎসাহী নন।”

সড়কে গণপরিবহন হিসেবে বাসের সংখ্যা কমায় ক্রমশ ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে বলেও মনে করেন এ নগর পরিকল্পনাবিদ।

“এটা খুবই স্বাভাবিক। মানুষ চলাচল করবে কিভাবে? গণপরিবহন না থাকলে প্রাইভেট গাড়ি তো বাড়বেই, এতে রাস্তায় যানজট বাড়বে,” বলেন তিনি।

দুই বছর আগের এক হিসেবে দেখা যায়, মোট যানবাহনের মধ্যে ঢাকায় চলাচলকারী মানুষের মাত্র ছয় শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন। অথচ এই গাড়িগুলোই সড়কের ৮০ শতাংশ জায়গা জুড়ে থাকে।

এসব বিষয়ে সড়ক সচিব এম এ এন সিদ্দিক বলেন, “সরকারিভাবে ৯৮০টি গাড়ি কেনা হয়েছে। আরও ৫০০টির প্রকিউরমেন্ট দেওয়া আছে। আর বেসরকারি উদ্যোক্তারা যতো ইচ্ছা গাড়ি নামাতে পারেন, এ অনুমতি তাদের দেওয়া আছে। এছাড়া গণপরিবহন সমস্যা নিরসনে আমরা মেট্রোরেল করছি।”

বাস মালিকদের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, “এগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। তারা সব সময় এ চেষ্টায় থাকেন যে, এক টাকা ইনভেস্ট করে কিভাবে ১০ টাকা লাভ করবেন। যেহেতু ঢাকায় নজরদারিটা বেশি তাই তারা ঢাকার বাইরে বাস চালায়।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *