এস আলমের দখলে ইসলামী ব্যাংকের ৮২ শতাংশ শেয়ার

Slider ফুলজান বিবির বাংলা


ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট দেশত্যাগ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে টানা প্রায় ১৬ বছর আওয়ামী লীগের নজিরবিহীন দুঃশাসন ও স্বেচ্ছাচারিতার অবসান ঘটে। শেখ হাসিনার আমলে দখল, ঋণ কেলেঙ্কারি আর লুটপাটে ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে ব্যাংক খাত। এ সময়ে ব্যাংক লুটপাটের মূল নায়ক এস আলম গ্রুপ। ইসলামী ব্যাংকসহ প্রায় আটটি ব্যাংক গ্রুপটি দখলে নেয়। এসব ব্যাংক দখলে নেওয়ার পর থেকে নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয় এস আলম। শুধু ঋণ নয়, এসব ব্যাংকের মালিকানা নিজেদের কব্জায় রাখতে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে-বেনামে কোম্পানি খুলে শেয়ার ধারণ করেছে প্রভাবশালী গ্রুপটি।

এস আলম গ্রুপের নামে-বেনামে ২৪টি ব্যক্তি ও কোম্পানি ইসলামী ব্যাংকের ৮২ শতাংশ শেয়ার দখল করে রেখেছে। তবে, সরকার পতনের পর শেয়ার বিক্রি করে অর্থ লুট করার পাঁয়তারা করছে গ্রুপটি। এসব অর্থ বের করে নিলে শেয়ারবাজার বড় ধরনের তলানিতে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রভাবশালী গ্রুপটির শেয়ার বিক্রি ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ইসলামী ব্যাংকের বর্তমানে শেয়ার সংখ্যা ১৬০ কোটি ৯৯ লাখ ৯০ হাজার ৬৬৮টি। এসব শেয়ারের মধ্যে এস আলমের নামে-বেনামে ২৪টি কোম্পানির শেয়ার আছে প্রায় ৮২ শতাংশ বা ১৩১ কোটি ৮৯ লাখ ১২ হাজার শেয়ার। এসব শেয়ার বিক্রি করে অর্থ বের করে নেওয়ার চেষ্টা করছে এস আলম গ্রুপ। যার বর্তমান বাজার মূল্য ৫ হাজার ৩৯৯ কোটি ৫৮ লাখ ৬৭ হাজার টাকা।

আইন অনুযায়ী তালিকাভুক্ত একটি কোম্পানির শেয়ার গ্রুপের হাতে রাখতে পারে। তবে, যদি আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো গ্রুপ ৮২ শতাংশ শেয়ার ধারণ করে এবং এর প্রমাণ পায় কমিশন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে বিএসইসি
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম

এস আলম গ্রুপের যেসব ব্যক্তির নামে শেয়ার ধারণের তথ্য পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে অন্যতম ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসানুল আলম। তিনি জিএমজি বিল্ডার্স থেকে মনোনীত পরিচালক। তার নামে ব্যাংকটির ২ দশমিক ০১০ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি ২৩ লাখ ৬০ হাজার ৮১২টি শেয়ার রয়েছে। ব্যাংকটির ভাইস চেয়ারম্যান ইউসুফ আব্দুল্লাহ আল রাজি। তিনি বিটিএ ফাইন্যান্স লিমিটেড থেকে মনোনীত। তার নামে ৪ দশমিক ৯৫৩৬ শতাংশ অর্থাৎ ৭ কোটি ৯৭ লাখ ৫১ হাজার ৭৭৮টি শেয়ার রয়েছে। ব্যাংকটির ভাইস চেয়ারম্যান ড. তানভীর আহমেদ প্যারাডাইস ইন্টারন্যাশনাল থেকে মনোনীত। যার নামে ২ দশমিক ০০৯৯ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি ২৩ লাখ ৬০ হাজার শেয়ার রয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক মো. জয়নাল আবেদীন এবিসি ভেঞ্চারস লিমিটেড থেকে মনোনীত। প্রতিষ্ঠানটির নামে ২ দশমিক ০০৬৩ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি ২৩ লাখ এক হাজার ৩০টি শেয়ার রয়েছে।

এক্সেল ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং থেকে মনোনীত পরিচালক প্রফেসর ড. মো. সিরাজুল করিম। প্রতিষ্ঠানটির নামে ৩ দশমিক ৩৯৭২ শতাংশ অর্থাৎ ৫ কোটি ৪৬ লাখ ৯৩ হাজার ৯১৪টি শেয়ার রয়েছে। প্লাটিনাম এনডের্ভাস লিমিটেড থেকে মনোনীতি পরিচালক প্রফেসর ড. কাজী শহীদুল আলম। প্রতিষ্ঠানটির নামে ২ দশমিক ০০৫৩ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি ২২ লাখ ৮৫ হাজার শেয়ার রয়েছে। এক্সেলশিয়র ইমপেক্স কোম্পানি লিমিটেড থেকে মনোনীতি পরিচালক সৈয়দ আবু আসাদ। প্রতিষ্ঠানটির নামে শেয়ার রয়েছে ২ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি ২২ লাখ ৩৩৪টি। গ্র্যান্ড বিজনেস লিমিটেড থেকে মনোনীতি পরিচালক মো. কামরুল হাসান। প্রতিষ্ঠানটির নামে ২ দশমিক ০২১৬ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি ২৫ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৫টি শেয়ার। লায়ন হেড বিজনেস রিসোর্সেস লিমিটেড থেকে মনোনীতি পরিচালক খুরশীদ উল আলম। প্রতিষ্ঠানটির দখলে রয়েছে ২ দশমিক ০০০২ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি ২২ লাখ ২৯০০টি শেয়ার।

বিএলইউ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড থেকে মনোনীত পরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন। এ প্রতিষ্ঠানের নামে রয়েছে ২ দশমিক ০০৯৯ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি ২৩ লাখ ৬০ হাজার শেয়ার। আর্মাদা স্পিনিং মিলস লিমিটেডের মনোনীত পরিচালক আবু সাঈদ মোহাম্মদ কাশেম। প্রতিষ্ঠানটির নামে ২ দশমিক ০১৩০ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি ২৪ লাখ ৮ হাজার ৩৩৯টি শেয়ার রয়েছে। কিংসওয়ে এনডের্ভাস লিমিটেড থেকে মনোনীত পরিচালক শওকত হোসাইন। প্রতিষ্ঠানটির নামে রয়েছে ৪ দশমিক ৩৯৭৫ শতাংশ অর্থাৎ ৭ কোটি ৭৯ লাখ ৯ হাজার ৮৭০টি শেয়ার। ইউনিগ্লোভ বিজনেস রিসোর্সেস লিমিটেড থেকে মনোনীত পরিচালক জামাল মোস্তফা চৌধুরী। কোম্পানিটির নামে রয়েছে ৪ দশমিক ৬৭১০ শতাংশ অর্থাৎ ৭ কোটি ৫২ লাখ ২ হাজার ১৪০টি শেয়ার।
শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক একটি শক্তিশালী ব্যাংক ছিল। এস আলম দখল করে এটিকে লুটপাট করেছে। নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে ব্যাংকটি দুর্বল করে ফেলেছে। এখন সরকারের প্রথম কাজ হবে ব্যাংকটিকে দখলমুক্ত করা
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ

যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে শেয়ার ধারণ করা হয়েছে সেগুলো হলো- সলিড ওক ইন্স্যুরেন্স পিসিসি লিমিটেডের নামে ৪ দশমিক ৮৮৯৫ শতাংশ অর্থাৎ ৭ কোটি ৮৭ লাখ ২০ হাজার শেয়ার, হলিস্টিক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের নামে ৪ দশমিক ৮৮৮২ শতাংশ অর্থাৎ ৭ কোটি ৮৬ লাখ ৯৮ হাজার ৮৩২টি, হাই ক্লাস বিজনেস এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের নামে ৪ দশমিক ৮৪৪৭ শতাংশ অর্থাৎ ৭ কোটি ৭৯ লাখ ৯৯ হাজার ৯১০টি, ক্যারোলিনা বিজনেস এন্টারপ্রাইজের নামে ৪ দশমিক ৮১৮৩ শতাংশ অর্থাৎ ৭ কোটি ৭৫ লাখ ৭৪ হাজার ৫৯৫টি, ব্রিলিয়ান্ট বিজনেস কোম্পানি লিমিটেডের ৪ দশমিক ৮১৬০ শতাংশ অর্থাৎ ৭ কোটি ৭৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৯৩টি, ব্রডওয়ে ইম্পেক্স কোম্পানি লিমিটেডের নামে ৪ দশমিক ৭৫৬২ শতাংশ অর্থাৎ ৭ কোটি ৬৫ লাখ ৭৪ হাজার ৬৫০টি, পিকস বিজনেস এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের নামে ৪ দশমিক ৫০৫৬ শতাংশ অর্থাৎ ৭ কোটি ২৫ লাখ ৪০ হাজার, এভারগ্রিন শিপিং লিমিটেডের ৪ দশমিক ১৮১২ শতাংশ অর্থাৎ ৬ কোটি ৭৩ লাখ ১৬ হাজার ৪৫৫টি, ম্যারাথন ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের ৩ দশমিক ৯৩৫১ শতাংশ অর্থাৎ ৬ কোটি ৩৩ লাখ ৫৫ হাজার ৪৩৪টি, কিংস্টোন ফ্লাওয়ার মিলস লিমিটেডের নামে ২ দশমিক ৫১২২ শতাংশ অর্থাৎ ৪ কোটি ৪ লাখ ৪৫ হাজার ৯৮৬টি এবং পারসেপ্টা এনডের্ভাস লিমিটেডের নামে ২ দশমিক ২৭৮১ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি ৬৬ লাখ ৭৬ হাজার ৪৫৮টি শেয়ার রয়েছে।

সরকার পতনের পরপরই এস আলম গ্রুপের নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠানগুলো ইসলামী ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের নগদ টাকা চেকের মাধ্যমে উঠিয়ে নিতে গেলে ব্যাংকটির কর্মকর্তারা তা আটকে দেন। ফলে এসব টাকা ওঠানো সম্ভব হয়নি। এখন গ্রুপটি তাদের নামে-বেনামে থাকা শেয়ার বিক্রি করে টাকা বের করে নিয়ে যাওয়ার পাঁয়তারা করছে বলে শেয়ারহোল্ডাররা নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে অভিযোগ করেছেন।

এ বিষয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে ব্যাংকটির শেয়ারধারীদের মধ্যে। তারা নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, ‘শুরু থেকে আমরা ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার, বিগত বছরগুলোতে দেশের ব্যাংকিং খাত এক বিশেষ অবস্থার মধ্য দিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে নিয়েছে। এস আলম গ্রুপ দেশের প্রচলিত আইন-কানুনকে অত্যন্ত সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে বিভিন্ন অবৈধ পন্থা ও প্রভাবের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ বা ঋণ সৃষ্টির মাধ্যমে সেই অর্থ দিয়ে দেশ এবং বিদেশের একাধিক কোম্পানির মাধ্যমে শেয়ার ক্রয় দেখিয়ে ব্যাংকের মালিকানা নিজেদের কাছে নেয়। একই প্রক্রিয়ায় ইসলামী ব্যাংকের দীর্ঘদিনের শেয়ারহোল্ডারদের ধারণ করা শেয়ারগুলো বিক্রি করতে বাধ্য করে এস আলম গ্রুপ। এসব শেয়ার ধারণের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি মতো রাষ্ট্রের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাটেজিক ব্যাংকের মোট শেয়ারের প্রায় ৮২ শতাংশ নিজেদের মধ্যে কুক্ষিগত করে এস আলম।’

চিঠিতে আরও বলা হয়, গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গণবিপ্লবের মাধ্যমে নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। এমতাবস্থায় একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং দেশের অর্থনীতির স্বার্থে বিগত দিনের ফ্যাসিবাদী শাসনের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোতে এস আলম গ্রুপের নামে-বেনামে ধারণ করা তাদের শেয়ারগুলো যাতে তদন্তের আগে বিক্রি করতে না পারে সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএসইসির হস্তক্ষেপ চান শেয়ারহোল্ডাররা। ইসলামী ব্যাংকের লাখ লাখ আমানতকারী ও সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থে দ্রুত ব্যবস্থা নিতেও দাবি জানানো হয় চিঠিতে।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম জানান, আইন অনুযায়ী তালিকাভুক্ত একটি কোম্পানির শেয়ার গ্রুপের হাতে রাখতে পারে। তবে, যদি আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো গ্রুপ ৮২ শতাংশ শেয়ার ধারণ করে এবং এর প্রমাণ পায় কমিশন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে বিএসইসি।

জানা গেছে, প্রভাবশালী এ গ্রুপটিকে ব্যাংক লুটপাট ও শেয়ার কেলেঙ্কারিতে সহায়তা করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ও বিএসইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম। তারা দুজন সরকার পতনের পর পদত্যাগ করলেও তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক একটি শক্তিশালী ব্যাংক ছিল। এস আলম দখল করে এটিকে লুটপাট করেছে। নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে ব্যাংকটি দুর্বল করে ফেলেছে। এখন সরকারের প্রথম কাজ হবে ব্যাংকটিকে দখলমুক্ত করা।

শেয়ার ধারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ব্যাংকটির দখল ধরে রাখতেই তারা শেয়ার কিনেছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে শেয়ারগুলো ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েই কিনেছে। অর্থাৎ ব্যাংকের টাকা দিয়েই ব্যাংকের শেয়ার কিনেছে। আবার এই ব্যাংকের শেয়ার বন্ধক (লিয়েন) রেখে অনেক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। এখন কোনো টাকাই পরিশোধ করছে না। তাই নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলো এসব বিষয় তদন্ত করে তাদের শেয়ারগুলো ঋণের বিপরীতে জব্দ করা উচিত। একই সঙ্গে ব্যাংকটি দখলমুক্ত করতে হলে মালিকানা পরিবর্তন করতে হবে। এজন্য শেয়ার হস্তান্তর বা বিক্রি করতে হবে। এখন আমাদের দেখতে হবে তারা যখন শেয়ার হস্তান্তর বা বিক্রি করছে, শেয়ারগুলো কে কিনছে। এসব ক্রেতারা কি আবার এস আলমের নামে-বেনামে কোম্পানি বা ব্যক্তি কি না, এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

এদিকে, এক দশক আগেও দেশের শীর্ষ ব্যাংক ছিল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। নিয়মনীতি পরিপালন, গ্রাহককে সেবা দেওয়া ও আর্থিক সূচকে অন্য সব ব্যাংককে ছাড়িয়ে গিয়েছিল ব্যাংকটি। গ্রাহকের আস্থার কারণে স্থানীয় আমানত কিংবা বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহে এটি সবচেয়ে এগিয়ে ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে ২০১৭ সাল থেকে। ওই বছর সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ইসলামী ব্যাংককে ‘জামায়াতমুক্ত’ করার উদ্যোগ হিসেবে এর মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণ নেয় সদ্য বিদায় নেওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ এস আলম গ্রুপ। এরপর সাড়ে সাত বছরে নামে-বেনামে ব্যাংকটি থেকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং এর স্বার্থসংশ্লিষ্ট রাজশাহীর নাবিল গ্রুপ। এই অর্থ ব্যাংকটির মোট ঋণের এক-তৃতীয়াংশ। এই টাকা বের করতে কোনো নিয়মকানুন মানা হয়নি। ঋণের যে তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে, ব্যাংক থেকে পাচার করা অর্থের প্রকৃত পরিমাণ তার চেয়ে বেশি বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

তথ্য বলছে, ২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তখন ব্যাংকটিতে এস আলমের তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ ছিল তিন হাজার ছয় কোটি টাকা। চট্টগ্রামে ব্যাংকটির খাতুনগঞ্জ শাখার গ্রাহক ছিল গ্রুপটি। তখন ব্যাংকের মোট ঋণ ছিল ৬১ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা আর আমানত ছিল ৬৮ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। কর্মকর্তা ছিলেন ১০ হাজারের কম। নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর আমানত বাড়ানোর লক্ষ্যে নতুন নতুন শাখা খুলে পটিয়ার লোকদের নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়।

ফলে সারা দেশে ব্যাংকটির শাখা এখন ৩৯৫টি। এর বাইরে রয়েছে ২৫০টি উপশাখা। ২০২৩ সাল শেষে ইসলামী ব্যাংকে আমানত বেড়ে হয় ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা এবং ঋণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৬০ হাজার ২৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ আমানতের চেয়ে বেশি টাকা ঋণ হিসেবে বের করে দিয়েছে ব্যাংকটি। বাড়তি এই টাকা এসেছে মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে।

ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণমূলক মূলধন ১০ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা। ফলে একটি গ্রুপকে ইসলামী ব্যাংক সর্বোচ্চ ফান্ডেড ১ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা ও নন-ফান্ডেড ১ হাজার ৪২ কোটি টাকা ঋণ দিতে পারে। অর্থাৎ সবমিলিয়ে একটি গ্রুপ ঋণ পেতে পারে ২ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ পাচার করতে এস আলম গ্রুপ একাধিক গ্রুপ তৈরি করে এবং ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রতিষ্ঠান খোলে।

প্রাপ্ত নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এস আলম নাম যুক্ত আছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলো ইসলামী ব্যাংক থেকে ১৪ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। আর সাইফুল আলমের মেয়ের স্বামী বেলাল আহমেদের ইউনিটেক্সের ঋণ ৪৫৪ কোটি টাকা। এর বাইরে এস আলমসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ ৩২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। এসব ঋণ ছড়িয়ে আছে চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও রাজধানীর বিভিন্ন শাখায়। এ ছাড়া রাজশাহীর নাবিল গ্রুপের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণ ৩ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা।

সরকার পতনের পর গত ৬ আগস্ট এস আলম গ্রুপ কর্তৃক নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের ব্যাংক থেকে বের করে দেন বিক্ষুব্ধ ব্যাংকাররা। ৭ ও ৮ আগস্ট তাদের বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক দখল হওয়ার পর পদায়ন পাওয়া এক্সিকিউটিভসহ (নির্বাহী কর্মকর্তা) যারা অবৈধভাবে নিয়োগ পেয়েছেন তাদের নিয়োগ বাতিলের দাবি ওঠে। এমন অবস্থায় গত বুধবার এস আলমের আমলে পদোন্নতি পাওয়া অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) কায়সার আলী ব্যাংকে আসলে তাকে জোর করে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।

কর্মকর্তারা ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠনের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে লুটেরাদের বের করে দেওয়ার দাবি জানান। পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুল মাওলা, অ্যাডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর কাউসার আলী, ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর আকিজ উদ্দিন, মিফতাহ উদ্দিনসহ এস আলমের আমলে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের ব্যাংক থেকে বহিষ্কারের দাবি তোলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *