প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের বাইরে গিয়ে নতুন দল গঠনের চিন্তাভাবনা করছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। মূলত দেশের সব জায়গায় সংস্কার আনতে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী এক মাসের মধ্যে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসতে পারে
ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। কিন্তু শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা এমন দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। কারণ, ১৫ বছরে ১৭ কোটি মানুষকে লোহার খাঁচার মধ্যে রেখে শক্ত হাতে দমন-পীড়ন করেছেন শেখ হাসিনা। গত ১৫ বছরের এমন পুনরাবৃত্তি চান না আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
প্রায় ৩০ জনের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছে রয়টার্স। এর মধ্যে শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দলের নেতাসহ বিশ্লেষক রয়েছেন।
আন্দোলনের সময় ছাত্র আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতাকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর মধ্যে ছিলেন নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ এবং আবু বাকের মজুমদার।
সরকার পতন প্রসঙ্গে বাকের মজুমদার রয়টার্সকে জানান, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা তাকে অন্যায়ভাবে আটক করেছে এবং মারধর করেছে। মুক্ত হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার সময় তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেন— হাসিনাকে এবার যেতে হবে।
বেসরকারি ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ বছর বয়সী সমন্বয়কারী নাঈম আবেদিন বলেন, সেই সপ্তাহে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘটে যাওয়া সহিংসতা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামতে বাধ্য করে। ভাইদের জন্য রাস্তায় নেমে আসা তখন আমাদের দায়িত্ব ছিল।
তিনি বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নেমে আসা টার্নিং পয়েন্টের মতো একটা বিষয় ছিল। অপ্রত্যাশিতভাবে, অনেক অভিভাবকও সেসময় আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।
সেই সপ্তাহের শেষের দিকে অন্তত ১১৪ জন নিহত হয়েছিলেন, আরও কয়েকশো আহত হয়েছিলেন। তখন ক্র্যাকডাউনের মাত্রা আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতনদেরও হতবাক করেছিল।
মূলত জুন মাসে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে রাস্তায় নামেন শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলনে শুরু হয় সরকারি দল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দমন-পীড়ন। পরে তা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়, সর্বশেষ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। যার মধ্যে দিয়ে আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।
এর কয়েকদিনের মাথায় ছাত্র-জনতার চাওয়ার মুখে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রধান উপদেষ্টা হন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার উপদেষ্টা পরিষদে ছাত্র আন্দোলনের দুজন সমন্বয়কও রয়েছেন। এরপর থেকেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। কিন্তু আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও অন্তর্বর্তী সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে যে দাবি জানানো হচ্ছে, তা অন্তর্বর্তী সরকার আমলে নিচ্ছে না।
আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকায় থাকা মাহফুজ আলম নামের এক শিক্ষার্থী রয়টার্সকে বলেন, দুই রাজনৈতিক দলের ওপর দেশের মানুষ ক্লান্ত–বিরক্ত। আমাদের ওপর তাদের আস্থা রয়েছে। এজন্য নতুন রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে আলোচনা করছেন শিক্ষার্থীরা। এক মাসের মধ্যে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠনের আগে সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ করতে চান তারা।
আরেক সমন্বয়ক তাহমিদ চৌধুরী বলেন, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে। এর মূল ভিত্তি হবে অসাম্প্রদায়িকতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা।
ছাত্ররা নতুন দল গঠন প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, রাজনৈতিক ধারা পরিবর্তন হবে। কেননা এতদিন এই রাজনীতি থেকে তরুণদের বাদ রাখা হতো। তবে ছাত্রদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়নি।
‘ক্ষুদ্রঋণ’ ইস্যুতে বিশ্বে বেশ আলোচিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি একজন অর্থনীতিবিদও। তার থিওরি কাজে লাগিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থনীতিতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে, যিনি যা চান তা বাংলাদেশে করতে পারবেন কি না, তা নিয়েও বেশ সংশয় রয়েছে।
নতুন অন্তর্বর্তী সরকার সাংবিধানিক আইন মেনে হয়নি বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, আইনগত ও রাজনৈতিকভাবে আমরা এখন অজানা নদীতে এসে পড়েছি। এই অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা কেমন হবে তাও বলা যাচ্ছে না। কেননা এই সরকার আইন মেনে হয়নি।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সহিংসতায় বাংলাদেশে অন্তত ৩০০ মানুষ মারা যান বলে উল্লেখ করেছে রয়টার্স। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি নিহতের ঘটনা এটি।