৭৯২৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ গোপন করেছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক

Slider অর্থ ও বাণিজ্য


বেনামে ঋণ দিয়ে ৭ হাজার ৯২৪ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের পাহাড় গড়েছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল)। দীর্ঘ দিন সেই তথ্য গোপন রেখেছে ব্যাংকটি, আর এ কাজে সহায়তায় করেছে খুদ কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ব্যাংকটি প্রভিশন ঘাটতির ফলে লভ্যাংশও ঘোষণা করতে পারছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গোপন প্রতিবেদনে এমন ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে। গোপন প্রতিবেদনটি ঢাকা পোস্টের কাছে রয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে ব্যাংকটি খেলাপি ঋণ দেখিয়েছে ১৬৪৪ কোটি টাকা। এখানে ৭৯২৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করে এসআইবিএল।
এছাড়া একই সময় নিয়ন্ত্রণ সংস্থার পরিদর্শন টিম ব্যাংকটিতে প্রভিশন ঘাটতি দেখেন ৮১২৭ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকটি প্রতিবেদনে প্রভিশন ঘাটতি দেখিয়েছে ৬৪ কোটি টাকা। এতে প্রভিশন ঘাটতির ৮০৬৩ কোটি টাকা গোপন করে এসআইবিএল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি পরিদর্শন টিম ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে সরেজমিনে প্রধান ৫টি শাখা, অফ-সাইট ভিত্তিতে ১০টি ও ঢাকার বাইরে ৭টি শাখা পর্যবেক্ষণ করে এই তথ্য পায়।

ব্যাংক পরিদর্শন করে আমরা হতবাক হয়ে গেছি। পুকুর নয়, এ যেন সাগর চুরি। যেখানে ৮১২৭ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি, সেখানে তথ্য গোপন করে মাত্র ৬৪ কোটি টাকা ঘাটতি দেখিয়েছে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা

অভিযোগ রয়েছে, বিশাল অংকের খেলাপি ঋণ ও প্রভিশন ঘাটতির এই তথ্য গোপন করতে কাজ করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ডেপুটি গভর্নর। মালিক পক্ষের চাহিদা অনুযায়ী লভ্যাংশ ঘোষণা করতে এ সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পরিদর্শন করে আমরা হতবাক হয়ে গেছি। পুকুর নয় এ যেন সাগর চুরি। যেখানে ৮১২৭ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি, সেখানে তথ্য গোপন করে মাত্র ৬৪ কোটি টাকা ঘাটতি দেখিয়েছে।

তিনি বলেন, আমাদের সংশ্লিষ্ট সুপারভিশন বিভাগের ডিজি (ডেপুটি গভর্নর) মো. খুরশীদ আলম পরিদর্শন টিমকে এমন রিপোর্ট দিতে বলেন যাতে ১০ শতাংশ ডিভিডেন্ড দেওয়ার সুযোগ থাকে। এমন অনিয়মে আমাদের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এডিশনাল ডিরেক্টর, ডিরেক্টর ও ইডি পর্যন্ত রাজি ছিলেন না। খুরশীদ আলম ফোর্স করে আমাদের এমন রিপোর্ট দিতে বাধ্য করেন।

এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম ও তার সহযোগীরা আমানতকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা নামে-বেনামে তুলে পাচার করেছেন। এতে শুধু এসআইবিএল নয়, পুরো আর্থিক খাতই হুমকির মুখে পড়েছে। সাধারণ আমানতকারীরা জমাকৃত অর্থ প্রয়োজন অনুযায়ী তুলতেন পারছেন না

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী জাফর আলমের কাছে এই অনিয়মের বিষয়ে জানতে ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে কোনো উত্তর দেননি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়, ব্যাংকের আর্থিক সুনাম রক্ষার্থে, এলসি মার্জিন ব্যয় কমাতে, বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি, আমদানির জন্য পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা না থাকায় ব্যাংক খাত সংকটময় সময় অতিবাহিত করছে। এছাড়া ব্যাংকিং ক্যাটাগরি অক্ষুণ্ণ রাখা, অন্তর্জাতিকভাবে রেটিং ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ব্যাংকটির সুনাম ও ভবিষতে মজবুত আর্থিক ভিত্তি তৈরিতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংক ব্যবসা করে আমানতকারীদের জমানো অর্থ দিয়ে। ব্যাংক যেসব ঋণ বিতরণ করে, ওই ঋণের গুণমান বিবেচনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) হিসেবে জমা রাখতে হয়। কোনো ব্যাংকের ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দঋণে (খেলাপি) পরিণত হলে পরবর্তীতে যেন আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে, এজন্যই প্রভিশন রাখার বিধান রয়েছে। কোনো ব্যাংকে প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না। এক সময় কোনো ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি থাকলে শুধু সতর্ক ও ঘাটতি মেটাতে দিকনির্দেশনা দিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনে কোনো ব্যাংকে টানা দুবছর ঘাটতি থাকলে তার বড় অঙ্কের জরিমানাসহ লাইসেন্স বাতিলের কথা বলা আছে। এসব কারণে নানা উপায়ে প্রভিশন ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করে ব্যাংকগুলো।

নীতি অনুযায়ী, বর্তমানে অশ্রেণিকৃত ঋণের ধরন অনুযায়ী দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখতে হয়। এর মধ্যে ব্যাংকগুলো তাদের নিয়মিত বা অশ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে পরিচালন মুনাফার ০ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত, ‘সাব স্ট্যান্ডার্ড’ বা নিম্নমানের শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ এবং ‘ডাউটফুল’ সন্দেহজনক শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ আর ‘মন্দ’ মানে শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হয় শতভাগ।

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এস আলম গ্রুপ থেকে মুক্ত করতে মানববন্ধন

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এস আলম গ্রুপ থেকে মুক্ত করতে মানববন্ধন করেছে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান, পরিচালক ও শেয়ারধারীরা। রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনের পর এক সংবাদ সম্মেলনে তারা অভিযোগ করেন, এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম ও তার সহযোগীরা আমানতকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা নামে-বেনামে তুলে পাচার করেছেন। এতে শুধু এসআইবিএল নয়, পুরো আর্থিক খাতই হুমকির মুখে পড়েছে। সাধারণ আমানতকারীরা জমাকৃত অর্থ প্রয়োজন অনুযায়ী তুলতেন পারছেন না।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল হক, সাবেক পরিচালক আনিসুল হক, আসাদুজ্জামান, সুলতান মাহমুদ চৌধুরী, আব্দুর রহমান, আবুল বসর ভূঁইয়াসহ সাধারণ ও উদ্যোক্তা শেয়ারধারীরা।

২০১৭ সালে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মালিকানায় আসে চট্টগ্রাম ভিত্তিক এস আলম গ্রুপ। ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান বেলাল আহমেদ, এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের জামাতা। মালিকানা পরিবর্তনের সময় বাদ পড়েন ব্যাংকটির কয়েকজন উদ্যোক্তা ও পরিচালক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *