মনোয়ার হোসেন রনি, ঢাকা: ‘অবিশ্বাসী আমার হাতে কোন কার্পণ্য নেই বিশ্বাস বহনের …! আমি যে সর্বনাশা ঢেউ এর অমোঘ নিয়তিতে জুড়ে বাঁকগুলো চিনি .. কখনো সখনো সবিস্তারে জাদুর জীবন বানিয়ে পাখিদের ডেকে বলি .. আমারে নিয়ে যাও তোমার দহলিজে চলো আজ শুধু অপরাজিত দিগন্তে উড়ি ’ এই আমার ভাবনা, এই আমার কল্পনার বিস্তার, এই আমার মানসিক সমৃদ্ধি। ইটনা- মিঠামইন সর্বোপরি কিশোরগঞ্জের হাওর, হাওরের জলের গান- ঢেউয়ের বাঁক, অপার আকাশ, কাশ বন, সাদা মেঘের ভেলা, জলে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা বিচিত্র সব বৃক্ষ- জলজ উদ্ভিদ না দেখলে, মানুষের জীবন- জীবিকা, হাহাকার, হাওর এলাকার মানুষের মানসিক ঐশ্বর্য, চিত্ত বৈভব না দেখলে, আনন্দ বেদনার কাব্যের পাঠ নেয়া না হলে ঢেউ গুলোকে চিরকালই সর্বনাশা মনে হতো। এখন আর তা হচ্ছেনা। প্রবল আনন্দ নিয়ে আমি এখন ভাবছি সব ঢেউ সর্বনাশা হয়না। অনেক ঢেউ আনন্দের হয়, কল্যাণের হয়; জীবন নদীর নাব্যতা ও অনেক ঢেউয়ের ফসল। নতুন ভাবনার এই চোখ খুলে দিয়েছে গত ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ কিশোরগঞ্জের ইটনা- মিঠা মইন এলাকার হাওর অঞ্চল, হাওরের ভাষা, জলের ও মানুষের সংগিতি বুঝার মধ্য দিয়ে। আমরা যারা সমমনা, চিন্তা- কল্পনা ও যাদের পাশাপাশি বসবাস করে এরকম বারো জন বন্ধু মিলে গাজীপুর থেকে রওনা দেই হায়রের ডাকে, হাওরের নিমন্ত্রণে।
গাজীপুর থেকে কিশোরগঞ্জ- করিম গঞ্জ হয়ে চামড়া বন্দর। সেখান থেকে ট্রলারে কাশবনে চোখ ডুবিয়ে দিয়ে, সাদা মেঘের ভেলায় দৃষ্টি ভাসিয়ে দিয়ে চলে যাই গোপদিঘী আমাদের বিশিষ্ট বন্ধু বীর মুক্তিযুদ্ধা খন্দকার হাসিবুর রহমানের বাড়িতে। ধুমছে হল্লা করে সারি মধ্যাহ্ন ভোজ। তাজা হাওরের মাছের স্বাদ জিহবায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ি জলের বিস্তারে, বিলের বিস্তারে। বিপুল মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়ে হাওরের জলে যতো গাছ দাঁড়িয়ে আছে তা আমাদেরকে বৃক্ষ প্রেমিক করে তুলে। করে তুলে কবি। হাওরের জলে র মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোর নাম করচ …! কারো কারো সাধ হয় , আর কিছু না হোক হাওরের জল ছুঁয়ে থাকা করচ গাছ হয়ে জন্মানোর …! কি সব অদ্ভুত ছেলেমানুষী তে ভরা সব ইচ্ছে !কোন মানে হয় নাকি ! হয় হয়তো মানে। এর চে শুদ্ধতম মানে আর কীসে হতে পারে ভাবি আমরা। আমাদের ভাবনার সঙ্গে আমাদের চোখ ছাপিয়ে দিগন্তে আছড়ে পড়ে হাওরের জল, ঢেউ। আকাশে মাথা ছুঁয়ায়, বৃক্ষ। দূরের ট্রলার- জাহাজ জীবনের গতির কথা যেমন মনে করিয়ে দেয়, তেমনি একটা গভীর বেদনা বুকের বা পাশটায় চিনচিনে ব্যাথা ধরায়। পিচ রঙ্গা নৌকার বাহার- সৌন্দর্য মনে করিয়ে দেয় জীবন নৌকার কথা। একদিন ঘাটে ভিরবে এই নাও। যেখান থেকে ফেরার সুযোগ নেই! তার মানে প্রত্যেক সৌন্দর্যের বিপরীতে হাহাকার ও থাকে? থাকে হয়তো! এখন আমরা হাহাকারে নেই। হাওরের জলের- মানুষের- মননের ঐশ্বর্যে আছি। নীল আকাশে কে ভাসালো সাদা মেঘের ভেলা …! লুকোচুরি খেলা। সাদা মেঘের সঙ্গে আমরাও লুকোচুরি খেলি জলের সঙ্গে। জলের গান কান পেতে শুনি। জলের সৌন্দর্যের বয়ান দেয়ার আগে বলে নেই আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি এ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ সাহেবের ইটনা মিঠামইনের গ্রামের বাড়ির আথিতেয়তা মনে থাকবে বহুদিন। রাষ্ট্রপতি মহোদয়ের ছোট ভাই অধ্যক্ষ আব্দুল হক নুরু আমাদেরকে যে সন্মান দেখিয়েছেন তা ভুলার নয়। কিশোরগঞ্জের ইতিহাসের একটি আকর্ষণীয় দিক হাওর। কেবল ভু-প্রকৃতিগত বৈচিত্রের কারণে নয়। অর্থনৈ্তিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রকৃতিক সৌ্ন্দর্য্যের দৃষ্টিকোণ থেকেও হাওরকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিশোরগঞ্জের প্রাণ শক্তি এই হাওর। হাওর সাগর শব্দের অপভ্রংশ মাত্র। উচ্চারণ বিকৃতিতে সাগর থেকে সায়র এবং সায়র থেকে হাওর হয়েছে বলে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। বর্ষাকালে বিশাল হাওর এলাকায় অথৈ জলরাশি দেখলে সাগরের কথাই মনে করিয়ে দেয়। হাওর আর কিছু নয়,এটা অপেক্ষাকৃত বড় জলাভূমি। শীতকালে যে প্রান্তর ফসলে পূর্ণ বা শুকনো মাঠ কিংবা বালুচর, বর্ষাকালে সেখানে এমন জলধারা যে চারদিক প্লাবিত করতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। শুধু পানির প্রবাহ নয় প্রচন্ড ঢেঊ আর দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি সাগরের বিশালত্বের কথাই মনে করিয়ে দেয় । দ্বীপের মত গ্রামগুলি যেন ভেসে থাকে জলের বুকে। বর্ষাকালে যে হাওরের পাগল করা ঢেউয়ের দোলায় তিন বৈঠার নৌকা পাল উড়িয়ে চলার সময় উল্টিয়ে পড়তে যায়,শুষ্ক মৌসুমে সেখানে পানি থাকেনা এক ফোঁটা। যতোদূর চোখ যায় শুধু ধানের সবুজ শীষ বা সোনারঙা ধানের সুবিপুল সমারোহ ।
কোন বছর অকাল বন্যা হলে আবার এই বোর ফসল নষ্ট হয়ে যায়। এখন আমি আপনাদের বড় হাওর নিয়ে কিছু বলব। এর সীমানা দক্ষিণে অষ্টগ্রাম থানা উওরে মিঠামইন,উওর পূর্বকোণে ইটনা, উওর-পশ্চিমে কটিয়াদী,পশ্চিমে নিকলী এবং পূর্বে হবিগঞ্জ জেলার লাখাই থানা। অষ্টগ্রাম থানার ৭টি ইউনিয়নের ৫৯টি মৌজার ৪৫,৩১০,৩৬ একর, ইটনা থানার ৮টি ইউনিয়নের ৮৪টি মৌজার ৭০,১৬৬,৭৩ একর, মিঠামইন থানার ৫টি ইউনিয়নের ৫৯টি মৌজার ২৮,৯৩৩,৮৩ একর এবং নিকলী থানার ৬টি ইউনিয়নের ৪৬টি মৌজার ৭৬,১৫০,৬৩ একর জমি নিয়ে কিশোরগঞ্জ জেলার বড় হাওরের অবস্হান। এ ছাড়া হবিগঞ্জ জেলায়ও এই বড় হাওরের বিস্তৃতি রয়েছে। বর্ষাকালে বড় হাওরে নৌকা ভাসালে মনে হয় অকুল দরিয়া পার হতে হচ্ছে ।কুল নাই কিনার নাই,শুধু অশান্ত ঊর্মিমালা উঠানামা করছে বিরামহীন ভাবে। প্রত্যুষে যখন সূর্য উঠছে,তখন এই ঢেউয়ের ছন্দদোলায় মনে হবে রক্তলাল সূর্য একবার পানির নীচে ডুবছে, আবার ভেসে উঠছে। শ্রী দীনেশ চন্দ্র দেবনাথের স্মৃতিচারণ হাওর এলাকায় বর্ষাকালে রুপ অন্যরকম,চারদিকে কেবল জল আর জল,মাঝে মাঝে জলের উপর ভাসমান গ্রাম। বর্ষাকালে নৌকায় উঠে যে কোন একদিকে রওনা দিলো তখন মনে হয় অনেকটা আকাশে বিমান নিয়ে ঘোরাফেরার মত। দার্জিলিং পাহাড়ে টাইগার হিলে বসে সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। বইপত্রে এর মনোরম বর্ণনা পড়েছি । বিদ্যুৎ বিহীন জোৎস্না মাখা হাওর এলাকাও অনুপম। এই বর্ষার জোস্নার প্লাবনে বজরা ভাসানোর আননদের সঙ্গে আর কোনো কিছুর তুলনা চলেনা। বড় হাওর ছাড়া কিশোরগঞ্জে আরো অনেক হাওর রয়েছে। যেমন-হুমাইপুর হাওর (বাজিতপুর), সোমাই হাওর (অষ্টগ্রাম), বাড়ির হাওর (মিঠামইন), তল্লার হাওর (বাজিতপুর-নিকলী-অষ্টগ্রাম), মাহমুদপুর হাওর (নিকলী), সুরমা বাউলার হাওর (নিকলী) ইত্যাদি। কিশোরগঞ্জ জেলার একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, এর একটি বিশাল এলাকা বছরের প্রায় ৬ মাস পানিতে ডুবে থাকে। কিশোরগঞ্জের ১৩ টি উপজেলার মধ্যে নিকলী, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও ইটনা অধিক বন্যাপ্রবন হাওর অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। তাছাড়া বাজিতপুর কুলিয়ারচর ও করিমগঞ্জের অংশবিশেষও হাওর এলাকার অন্তর্ভুক্ত। কিশোরগঞ্জ জেলা হাওর এলাকা গেইটওয়ে নামে খ্যাত। সীমানা দক্ষিণে অষ্টগ্রাম থানা, উত্তরে মিঠামইন, উত্তর-পূর্ব কোণে ইটনা, উত্তর-পশ্চিমে কটিয়াদী, পশ্চিমে নিকলী এবং পূর্বে হবিগঞ্জ জেলার লাখাই থানা। নিকলী হাওর ছাড়া কিশোরগঞ্জে আরও অনেক হাওর রয়েছে। যেমন হুমাইপুর হাওর (বাজিতপুর), সোমাই হাওর (অষ্টগ্রাম), বাড়ির হাওর (মিঠামইন), তল্লার হাওর (বাজিতপুর-নিকলী-অষ্টগ্রাম), মাহমুদুর হাওর (নিকলী), সুরমা বাউলার হাওর ইত্যাদি। কিশোরগঞ্জ এলাকার বিশাল হাওর একদিকে যেমন মিঠা পানির বিশাল ভান্ডার তেমনি প্রচুর মৎস সম্পদে ভরপুর। হাজারো জীববৈচিত্রের পাখি জলজ উদ্ভিদ এবং মুক্তাসহ ঝিনুক রয়েছে হাওরের সর্বত্র। হাওর এলাকায় রিজার্ভার নির্মাণসহ পানি বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশাল সুযোগ রয়েছে।
কিভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে দূরে নয়। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের কয়েকটি এলাকা দিয়ে হাওড়ে যাওয়া যায়। তবে বাজিতপুর ও চামড়াবন্দর দিয়ে প্রবেশ খুব সহজ। প্রথমে ঢাকা মহাখালী থেকে উজানভাটি বা জলসিড়ি বাসে চামড়া ঘাট। ভাড়া ২৫০-৩০০ টাকা। সেখান থেকে ট্রলার দিয়ে ইচ্ছেমত হাওড়ে ঘোরাঘুরি। ট্রলার ভাড়া সারাদিনের জন্য ১৮০০-২৫০০ টাকা। একদিনের ভ্রমণের জন্য গ্রুপ করে মাইক্রোবাস বা হায়েস নিয়ে চামড়া ঘাট তারপর সেখান থেকে নৌকায় হাওড় যাত্রা। বর্ষায় হাওড়ে বেড়ানো মানেই যেন সাগরসঙ্গম। কোথায় থাকবেন: চামড়া ঘাটেজেলা পরিষদ বাংলো এবং বাজিতপুর বাংলো আছে। সারাদিন হাওড় ভ্রমণের পর বাংলোতে থাকতে পারেন। প্রতি রাত ১২০০-২০০০ টাকা।