‘সাগর ৬ বছর যাবৎ পড়ালেখার জন্য বাড়ি ছাড়া। ঈদ কিংবা বিশেষ অনুষ্ঠান ছাড়া সে বাড়ি আসতো না। সে কখনো কোন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। আমি কৃষক মাঠে কাজ করি। আমার ছেলে সব সময় পরিবারের কথা ভাবতো। ছোট বোন এইচএসসি পাস করার পর তাকে ঢাকা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোচিং করাবে বলেছিল। কত স্বপ্ন ছিল সব শেষ হয়ে গেল এক নিমিষেই।’
এভাবেই আর্তনাদ করে কথাগুলো বলছিলেন ঢাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলিতে নিহত মো. সাগর হোসেনের (২১) বাবা মো. তোফাজ্জল হোসেন।
জানা গেছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মিরপুর গোলচত্বরের সংঘটিত সংঘর্ষে গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মো. সাগর হোসেনের মৃত্যু হয়।
নিহত সাগর রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার নারুয়া ইউনিয়নের টাকাপোড়া গ্রামের কৃষক তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে। তিনি মিরপুর সরকারি বাঙালা কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। দুই ভাই-বোনের মধ্যে তিনি বড় ছিলেন। ছোট বোন নারুয়া লিয়াকত আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের এবার এইচএসসি পরিক্ষার্থী।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, নারুয়ার স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিকের গন্ডি পার করে লিয়াকত আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০১৯ সালে মানবিকে এসএসসি পাস করে। পরে রাজবাড়ী সরকারি কলেজে থেকে ২০২১ সালে এইচএসসি পাস করে উচ্চ শিক্ষার জন্য রাজধানীতে চলে যায়। সেখানে সে মিরপুর বাংলা কলেজে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে অনার্সে রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়। পরিবারের অভাব অনটনের জন্য পড়ালেখার পাশাপাশি সে পার্ট-টাইম চাকরি করতো।
নিহত সাগরের বাবা মো. তোফাজ্জেল হোসেন বলেন, সাগর অত্যন্ত মেধাবী ছিল। সে রাজবাড়ী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চেয়েছিল, কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ মিরপুর বাংলা কলেজে ভর্তি হয়। পরিবারের অভাব অনটনের কারণে আমি তার পড়ার খরচ ঠিকমতো দিতে পারতাম না বলে সে টিউশনি করে নিজের খরচ নিজেই চালাতো। সাগরের স্বপ্ন ছিল বিসিএস ক্যাডার হবে, সরকারি চাকরি করবে। সেই স্বপ্ন নিয়েই চাকরির জন্য কোটা আন্দোলনে গিয়েছিল, ফিরল লাশ হয়ে। আমি কাউকে দোষ দেব না। আল্লাহ যা ভালো মনে করছে তাই করেছে। আল্লাহর কাছে শুধু একটা কথাই বলব, আল্লাহ তুমি আমার ধৈর্য দাও।
নিহতের চাচাতো ভাই মো. সাইফুল হোসেন বলেন, আমি আর সাগর একসাথেই থাকতাম। আমি তাকে অনেকবার নিষেধ করার পরেও শুক্রবার সকালে বন্ধুবান্ধবের সাথে মিরপুর-১০ এ কোটা সংস্কার আন্দোলনে চলে যায়। তার যাওয়ার পর থেকে আমি অনেক বার তাকে কল দিয়েছি। ১ ঘণ্টা পর ওর ফোন থেকে কল আসে। কেউ একজন জানায়, সাগরের মাথায় গুলি লেগেছে। সাগর এখন মিরপুর আজমল মেডিকেল হাসপাতালে আছে। আমি সেখানে গিয়ে জানতে পারি সাগর মারা গেছে। পরে তাকে গ্রামের বাড়ি নিয়ে আসি। বিকেল ৪টার পরে টাকাপোড়া ঈদগাঁ ময়দানে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়।