তীব্র গরমের পর টানা বৃষ্টি, যেমন হতে পারে বন্যা পরিস্থিতি

Slider সারাদেশ


এপ্রিল ও মে মাসের তীব্র গরমের পর জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হয়েছে বৃষ্টিপাত। টানা গরমের পর বর্ষাকালের এই বৃষ্টিপাতে দেশের বেশ কয়েকটি জেলা বন্যা কবলিত হয়েছে এবং এ ধরনের এলাকার সংখ্যা বাড়ছে।

সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোণা জেলায় চলমান বন্যা পরিস্থিতির সামান্য অবনতি হতে পারে বলে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র পূর্বাভাস দিয়েছে। এছাড়া মৌলভীবাজার জেলার বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। নতুন করে বন্যা কবলিত হয়েছে আরো দু’টি জেলা।

অব্যাহত ভারী বৃষ্টিপাত এবং উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে সিলেটের অভ্যন্তরীণ নদীগুলোর পানি ছয়টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

আবহাওয়া অধিদফতর দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং এ সংলগ্ন উজানে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে।

বন্যা পরিস্থিতির যে অবস্থা
সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, মৌলভীবাজার, শেরপুর এ মুহূর্তে বন্যা কবলিত রয়েছে। তবে মঙ্গলবার বিকেলে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আরো দু’টি জেলায় নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। ফলে নতুন করে বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে হবিগঞ্জ ও ফেনী।

তারা বলছে, মঙ্গলবার সকালে হবিগঞ্জের খোয়াই নদী এবং ফেনীর মুহুরি নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। তবে এই দুটি পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে থাকলেও বন্যা স্বল্পমেয়াদী হবে বলে আশা করছেন তারা।

আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে কয়েকটা পয়েন্টে স্বল্পমেয়াদে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।

এছাড়া দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ফেনী, হালদা, সাঙ্গু ও মাতামুহুরি নদীর পানিও বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

একইসাথে ব্রক্ষপুত্র, যমুনা নদীর পানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে।

আগামী ২৪ ঘণ্টায় গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানিও বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে কেন্দ্র। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীগুলোর পানি সামগ্রিকভাবে বাড়ছে এবং আগামী ২৪ ঘণ্টায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

এছাড়া আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ব্রক্ষপুত্র নদের পানি বেড়ে কয়েকটি পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে বলে জানিয়েছে বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

সিলেটের স্থানীয় একজন সাংবাদিক জানান, শহরের ৪২টি ওয়ার্ডে বন্যার পানি সেভাবে প্রবেশ না করলেও সীমান্তবর্তী এলাকা গোয়াইনঘাট, কোম্পানিগঞ্জ, কানাইঘাট এবং জৈন্তাপুর বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে গেছে।

সিলেটের ৯৭টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা বন্যা কবলিত হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। সাত লাখের বেশি মানুষ বন্যা দুর্গত হয়েছে।

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৬৫০টি আশ্রয়কেন্দ্র বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে আট হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।

সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেন, ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে বেশি বৃষ্টি হলে সিলেটে প্রভাব পড়ে। গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ১৪১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

এই বৃষ্টিপাত যদি ১০০ মিলিমিটারের নিচে নামে, তবে আস্তে আস্তে পানি নেমে যাবে বলে আশা করছেন তারা।

তবে প্রতিদিন গড়ে ২০০ মিলিমিটারের ওপরে বৃষ্টিপাত হলে পানি আবার বেড়ে যাবে। ফলে বন্যা আবার বেড়ে যাবে বলে তারা মনে করছেন।

সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, ‘গত তিন দিনে ৬৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাত হলেই এখানে প্রবলেম হয়। কানাইঘাট পয়েন্টে সুরমার পানি এখনো বিপৎসীমার ওপরে এবং অমলশিদে কুশিয়ারা নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার ওপরে। চেরাপুঞ্জির বৃষ্টিটা যদি আগামী তিন দিনে কমে, তবে পানিটা নামবে নতুবা বন্যা বেড়ে যাবে। ভারী বৃষ্টি হলেই পানি নামতে দেরি হবে। সিলেটে কানাইঘাটের পানি বেড়ে গেলে তা নামতে সাত-আট ঘণ্টা সময় লাগে।’

ফলে বন্যা পরিস্থিতির কোনদিকে যাবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘পরবর্তী তিন দিনের ওপর বন্যা পরিস্থিতি নির্ভর করছে। এ তিন দিনে বৃষ্টিপাত কমলে পানি কমে যাবে। কিন্তু বেড়ে গেলে সিলেটে আবার বন্যা পরিস্থিতি বাড়বে।’

সিলেটে তৃতীয় দফার আকস্মিক বন্যার কথা উল্লেখ করে গোয়াইনঘাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো: তৌহিদুল ইসলাম সাধারণ জনগণকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার আহ্বান করেছেন।

সিলেটের আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ শাহ মো: সজীব হোসাইন জানান, ‘মঙ্গলবার সিলেটে ১৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আগামী ৭২ ঘণ্টায় সিলেটে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ২৯৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এটা অতি ভারী বৃষ্টিপাত।’

সুনামগঞ্জে আগামী দু’দিন ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস নেই বলে জানান জেলা প্রশাসক।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, ‘সুনামগঞ্জ ও চেরাপুঞ্জিতে আগামী দু’দিন ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস নেই। তবে স্বল্প বৃষ্টিপাত হতে পারে। ফলে বন্যার আগের যে পানি সেটা মেঘনা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগর দিয়ে নেমে যেতে পারবে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করছি।’

আবহাওয়া অধিদফতরের পূর্বাভাস যা বলছে
বাংলাদেশের আটটি বিভাগেই আগামী ৪৮ ঘণ্টায় মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। দেশের কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাসও দেয়া হয়েছে।

পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, মৌসুমী বায়ু পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে।

উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত এর বর্ধিতাংশ বিস্তৃত রয়েছে। এই মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে প্রবল অবস্থায় রয়েছে।

আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ‘টানা গরমের পর এখন বর্ষাকালে এই বৃষ্টিপাত স্বাভাবিক। মৌসুমী বায়ুর সক্রিয়তার ওপর এটা নির্ভর করে।’

তিনি বলেন, ‘ঊর্ধ্বাকাশে তিব্বতীয় উচ্চচাপ বলয় এবং আরব সাগরে থাকা মাসকারিয়ান উচ্চচাপ বলয় খুব শক্তিশালী থাকায় মৌসুমী বায়ুর এ সক্রিয়তা থাকে। এ দুই উচ্চচাপ বলয়ের কারণে আরব সাগরে বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয়বাষ্প সমৃদ্ধ বাতাসের ক্রমাগত আগমণ এই বৃষ্টিপাতকে ত্বরান্বিত করেছে।’
সূত্র : বিবিসি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *