জলবাড়ির গল্প

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি

haor-11

 

 

 

 

মো. মনিরহোসেন:
সপ্তাখানেক আগের কথা। কথা হচ্ছিল হাওড় নিয়ে। হাওরের সৌন্দর্য্য নিয়ে। হাওড়ের জোসনা বিলাস নিয়ে। হাওড়ের হিজল বাগান নিয়ে।যেই হিজল ফুলের গন্ধে মাতাল কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘পিছল পথে কুড়িয়ে পেলাম হিজল ফুলের মালা/ কি করি এ মালা নিয়ে বল চিকন কালা।’ হাওড় বিষয়ে বহুমাত্রিক গল্প শুনে শুনে আমিও হাওড়ে যাওয়ার নেশায় ব্যাকুল হয়ে গেলাম। শুরু করলাম টিম গোছানোর কাজ। আমার মতো ভ্রমন পাগল আরো কয়েকজন পেয়েও গেলাম। তারা হলেন সাংবাদিক রিপন আনসারী, আনিসুজ্জামান শাতিল,মনোয়ার হোসেন, ডা. অরণ্য, জাহিদ বকুল, হাসান,পিরু, শামসুদ্দিন আর বুলবুুল ভাই। সবাই গাজীপুরের বাসিন্দা। যাত্রার বাহন হিসেবে বেছে নিলাম একটি মাইক্রোবাস। ১০সেপ্টেম্বর সকাল ৮ টায় গাজীপুর থেকে রওয়ানা করলাম হাওরের উদ্দেশ্যে। সাড়ে এগারটায় পৌছে গেলাম কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার চামড়া বন্দরে।সেখান থেকে একটি ট্রলার ভাড়া করলাম দুহাজার টাকা দিয়ে সাড়াদিনের জন্য। মাঝির সাথে পাকা কথা বলে নিলাম যে আমরা ইটনা, মিঠামইন, গোপদিঘী যাবো। শুরু হলো হাওড় যাত্রা। চামড়ার ঘাট হাওড় পাড়ি দিয়ে আমরা চলে গেলাম ঘোড়াউৎড়া নদীতে। নদীতে জাহাজ চলছে। মাঝে মাঝে ঘোমটা দেওয়া শুশূক পানির নিচ থেকে উপরে উঠে জানান দিচ্ছে এটা ঘোড়াউৎরা নদী এবং এর গভীরতাও অনেক। বর্ষাকালে বড় হাওড়ে নৌকা ভাসালে মনে হয় অকুল দরিয়া পার হতে হচ্ছে। কুল নাই কিনার নাই, শুধু অশান্ত ঊর্মিমালা উঠানামা করছে বিরামহীনভাবে। সকালে যখন সূর্য উঠছে, তখন এই ঢেউয়ের ছন্দদোলায় মনে হবে রক্তলাল সূর্য একবার পানির নীচে ডুবছে, আবার ভেসে উঠছে। বর্ষাকালে হাওড়ের রূপ অন্যরকম, চারদিকে কেবল জল আর জল, মাঝে মাঝে জলের উপর ভাসমান দ্বীপ গ্রাম। আর ভাসমান গ্রামের ঐ বাড়িগুলোকে আমি নাম দিয়েছি ‘জলবাড়ি’ । বর্ষাকালে হাওড় এলাকায় নৌকায় উঠে যে কোন একদিকে রওনা দিলে তখন মনে হয় অনেকটা আকাশে বিমান নিয়ে ঘোরাফেরার মত।
বর্ষাকালে বাংলাদেশে ভ্রমণের উত্তম জায়গা হাওড়। হাওর ভ্রমণে লাভ শুধু আনন্দেই নয়, এতে শিকড়েরও সন্ধান মিলে। বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানে ‘হাওড়’ অঞ্চলের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। মানুষের দেখা ‘হাওড়’ আর বাইরের লোকের ধারণায় ‘হাওড়’ এক নয়। ‘হাওড়’ হচ্ছে প্রকৃতির সঙ্গমস্থল। বর্ষাকালে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের বিস্তীর্ণ নি¤œাঞ্চলে ‘হাওরের’ সৃষ্টি হয়। ভৈরব-কুলিয়ারচর এলাকায় ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, ধলেশ্বরী ও কালি নদীর মোহনায় জোয়ারের পানির সাথে ভাটি অঞ্চল নেত্রকোনার সুমেশ্বরী, কংস, মগড়া, ধনু, ঘোড়াউৎরা ও সুরমা-কুশিয়ারার পানির সঙ্গম ঘটে। এই জলসঙ্গমে প্রকৃতি তিন মাস লীলা করে। ‘হাওর’ কোনো স্থায়ী জলাশয় বা জলাধার নয়। বর্ষায় যেখানে দিগন্ত বিস্তৃৃত জলরাশি, শুষ্ক মৌসুমে সেখানেই মাইলের পর মাইল চোখ জোড়ানো সবুজ ধানের ক্ষেত। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে, ‘বর্ষায় নাও, শুকনায় পাও, এইডাই উজান-বাডির বাও’। হাওড়ের পরিধি নিয়ে মতান্তর রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ৮০ লাখ হেক্টর ভূমিতে হাওড়ের অবস্থান। আবার অনেকে বলেন, তার চেয়েও বেশি। মতান্তরে কোটি হেক্টর ভূমিতে হাওড় বিস্তৃত। কিশোরগঞ্জে ১২২টি হাওড় রয়েছে । কিশোরগঞ্জের অপরূপ সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহকে ঘিরে এখানে গড়ে উঠতে পারে একটি পর্যটন কেন্দ্র। আর এ হাওড়ের পানির অন্যতম আকর্ষণ হিজল গাছ। মিঠামইন উপজেলার বিভিন্ন হাওড়ে হিজল গাছ বা হিজল গাছের বাগান দেখা যায়।ঘোড়াউৎরা নদী পাড়ি দিতেই আমরা ভাসলাম গোপদিঘী হাওরে। মাঝে মাঝে দ্বীপগ্রাম আর ভাসমান হিজল বাগান মনকে অন্যরকম আনন্দ দিতে শুরু করলো। আর হিজল হচ্ছে মাঝারি আকারের চিরহরিৎ গাছ। বাকল ঘনছাই রঙের ও পুরু। ডালপালার বিস্তার চারদিকে। উচ্চতা ১০ থেকে ১৫ মিটার। জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে এবং বাঁচে দীর্ঘদিন। বাংলাদেশের জলাবদ্ধ এলাকা খাল, বিল, নদী-নালা, হাওর, বাঁওড় ও ডোবার ধারে সর্বত্র হিজল গাছ চোখে পড়বে। হিজলের কাঠ নরম, সাদা বর্ণের, উজ্জ্বল, মসৃণ ও টেকসই। পানিতে নষ্ট হয় না বলে নৌযান তৈরীতে ব্যবহৃত হয়। সস্তা আসবাব তৈরিতেও ব্যবহার করা হয়। জ্বালানি হিসেবেও এর ব্যবহার ব্যাপক। এর বাকল থেকে ট্যানিন পাওয়া যায়। এছাড়া উদ্ভিদটির মেডিসিনাল গুরুত্ব রয়েছে। হিজল ফুল ফোটে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে। গোলাপি রঙের হিজল লম্বা ডাটায় অসংখ্য ফুল ঝুলন্ত অবস্থায় ফোটে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুল ফোটা শুরু হয়। সকালের আলোয় ঝরে যায়। হিজলতলায় সকালে গেলে মনে হবে গোলাপি বিছানা পাতা। রাতে বা ভোরে হিজল তলার সামনে দিয়ে গেলে বা দূর থেকেও এর মাদকতাপূর্ণ মিষ্টি ঘ্রাণে মাতাল হতে হয়। হিজল বাগান দেখতে দেখতে চামড়া ঘাট থেকে রওয়ানা করার এক ঘন্টার মধ্যে আমরা পৌছে গেলাম গোপদিঘী বাজারে। বাজার ঘাটে বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার হাসিবুর রহমান ও তার সহধর্মীনিসহ গোটা বিশেক লোক দাড়িয়ে আছে আমাদের রিসিভ করার জন্য। মধ্যাহ্নভোজ তাদের বাড়িতে করবো বলেই পূর্ব কথা ছিল। মধ্যাহ্নভোজের আয়োজনের মধ্য দিয়েও প্রমাণ করলো তারা হাওরাঞ্চলবাসী। বড় বড় সরপুঁিট ভাজা, ৩ ধরনের চিংড়ি ভোনা, বোয়াল মাছের ভোনা, পাবদা মাছের দোপেয়াজো,আর রাঁজহাসের রেজালা সাথে ডিম। সবাই তৃপ্তি সহকারে খেলাম। আহ! জিভে এখনো স্বাধলেগে আছে। হাসিবুর রহমানের আতিথেয়তা ভ্রমণ টিমের প্রতিটি মানুষ আজীবন মনে রাখবে।

haor-12

 

হাওড় বিষয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, কিশোরগঞ্জের ইতিহাসের একটি আকর্ষণীয় দিক হাওড়। কেবল ভূ-প্রকৃতিগত বৈচিত্রের কারনে নয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে দৃষ্টিকোণ থেকেও হাওড় এক বিরাট স্থান জুড়ে আছে । হাওড় মূলতঃ সাগর শব্দের অপভ্রংশ মাত্র। উচ্চারণ বিকৃতিতে সাগর থেকে সায়র এবং সায়র থেকে হাওড় হয়েছে বলে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। বর্ষাকালে বিশাল হাওড় এলাকায় অথৈ জলরাশি দেখলে সাগরের কথাই মনে করিয়ে দেয়। হাওড় আর কিছু নয়, এটা অপেক্ষাকৃত বড় জলাভূমি। হাওড় প্রকৃতির লীলাভূমি হলেও হাওড় নিয়ে খুব একটা প্রচার নেই। যার ফলে অনেকেই জানেন না, হাওড়ে কী আছে, কী নেই। মধ্যাহ্নভোজ শেষে আমাদের নৌকা ভাসালাম ডুফির হাওড়ে। এই হাওড় পাড়ি দিয়ে গেলাম ঐতিহাসিক কামালপুর গ্রামে। ঐতিহাসিক বলার কারণ, এটাই হচ্ছে আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ এডভোকেটের বাড়ি। বাড়িটা ঘুরে দেখলাম।দেখলাম মহোদয়ের বৈঠকখানা।দেখে যা মনে হলো তিনি খুবই সাধারন জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। আমাদের কথা শুনে রাষ্ট্রপতি মহোদয়ের অনুজ বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হক নুরু চলে আসলেন কলেজ থেকে । তিনি স্থানীয় কলেজের অধ্যক্ষ। আমাদের সাথে চা আড্ডায় মেতে উঠলেন। খুবই আন্তরিক মানুষটি, সদা হাস্যোজ্জলও। তারপর আমরা চলে গেলাম মিঠামইন বাজারে। চাহিদামত চিংড়ি মাছ,বোয়াল মাছ,পাবদা মাছ, বাইম মাছ,সরপুটি মাছ কিনে রাতের হাওড় উপভোগ করতে করতে ফিরতি যাত্রা শুরু করি।

haor-08

 

 

 

 

 

কিভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে দূরে নয়। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের কয়েকটি এলাকা দিয়ে হাওড়ে যাওয়া যায়। তবে বাজিতপুর ও চামড়াবন্দর দিয়ে প্রবেশ খুব সহজ। প্রথমে ঢাকা মহাখালী থেকে উজানভাটি বা জলসিড়ি বাসে চামড়া ঘাট। ভাড়া ২৫০-৩০০ টাকা। সেখান থেকে ট্রলার দিয়ে ইচ্ছেমত হাওড়ে ঘোরাঘুরি। ট্রলার ভাড়া সারাদিনের জন্য ১৮০০-২৫০০ টাকা। একদিনের ভ্রমণের জন্য গ্রুপ করে মাইক্রোবাস বা হায়েস নিয়ে চামড়া ঘাট তারপর সেখান থেকে নৌকায় হাওড় যাত্রা। বর্ষায় হাওড়ে বেড়ানো মানেই যেন সাগরসঙ্গম।
কোথায় থাকবেন: চামড়া ঘাটেজেলা পরিষদ বাংলো এবং বাজিতপুর বাংলো আছে। সারাদিন হাওড় ভ্রমণের পর বাংলোতে থাকতে পারেন। প্রতি রাত ১২০০-২০০০ টাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *