ফেনীতে ভুল চিকিৎসায় রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আকিফা সুলতানার মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় ফেনী প্রাইভেট হাসপাতালের মালিক ও ল্যাপারোস্কোপিক সার্জন প্রফেসর ডা. কাইয়্যুমের ভুল সিদ্ধান্তকে দায়ী করছেন আকিফার স্বজনরা।
মঙ্গলবার (২৫ জুন) রাতে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে এমন দাবি করেন ডা. আকিফা সুলতানার চাচা ইকরাম উল্ল্যাহ।
জানা গেছে, গত শুক্রবার (২১ জুন) রাতে ল্যাপারোস্কোপিক সার্জন প্রফেসর ডা. কাইয়্যুমের ব্যক্তি মালিকানাধীন হাসপাতালটিতে ডা. আকিফা সুলতানার ল্যাপারোস্কোপি সার্জারি করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। এতে ডা. আবদুর রহমান নামে ফেনীর বাইরে থেকে আসা একজন এনেস্থেসিওলজিস্ট চিকিৎসক তাকে এনেস্থেসিয়া প্রয়োগ করেন। এরপর থেকে ক্রমেই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। সেখান থেকে একপর্যায়ে রাতে তাকে প্রথমে ফেনী জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে ও শনিবার (২২ জুন) ভোরে অবস্থার আরও অবনতি হওয়ায় চট্টগ্রাম এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেখান থেকে ঢাকায় নেওয়ার পথে ডা. আকিফা সুলতানার মৃত্যু হয়।
এ ব্যাপারে ডা. আকিফা সুলতানার চাচা ইকরাম উল্ল্যাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ভাতিজি ৩৩তম বিসিএসের মাধ্যমে চিকিৎসা পেশায় যোগদান করে। সর্বশেষ মোহাম্মদপুরের বাসায় থেকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে কর্মরত ছিলেন। মূলত তার এক সময়ের রুমমেট ফেনীতে কর্মরত ডা. নিলুফা পলির কথা অনুযায়ী সে ফেনীতে ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি করতে যায়। সেখানে ডা. আকিফা একজন অভিজ্ঞ ও সিনিয়র এনেস্থেসিওলজিস্ট চিকিৎসক চান। পরে প্রতিষ্ঠানের মালিক ল্যাপারোস্কোপিক সার্জন প্রফেসর ডা. কাইয়্যুম ডা. আবদুর রহমান নামে বয়োবৃদ্ধ এক চিকিৎসককে নিয়ে আসেন।
তিনি বলেন, বয়সের ভারে এনেস্থেসিওলজিস্ট ওই চিকিৎসক নিজেই অসুস্থ। তাছাড়া এতো জটিল অবস্থায় এমন রোগীকে এনেস্থেসিয়া প্রয়োগের তার পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতাও ছিল না। তবুও প্রতিষ্ঠানের মালিক প্রফেসর ডা. কাইয়্যুম তাকে নিয়ে এসেছেন। এনেস্থেসিয়া দেওয়ার পরেই আমার ভাতিজির শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। তার (ডা. কাইয়্যুম) এমন ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই ভাতিজির এই পরিণতি হয়েছে।
ইকরাম উল্ল্যাহ আরও বলেন, শুক্রবার রাত ১০টার দিকে ফেনী প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে আমাদের ফোন করে ঢাকা থেকে একটি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ফেনী যেতে বলে। কথা অনুযায়ী রাত ৩টায় আমরা ফেনী জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে ডা. আকিফাকে আইসিইউতে সংকটাপন্ন অবস্থায় চিকিৎসাধীন দেখতে পাই। তখন সেখানে অবস্থান করা হাসপাতালের চারজন চিকিৎসক ডা. আকিফাকে দ্রুত ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। কিন্তু শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় দ্রুততার জন্য চিকিৎসকদের পরামর্শে সেখানের দুইজন চিকিৎসকসহ আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে চট্টগ্রাম এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু এভারকেয়ারের মেডিকেল বোর্ড থেকে আমাদের জানায়, ফেনী প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পর তার শারীরিক অবস্থার আর অবশিষ্ট কিছু নেই। ওই অবস্থায় তাকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আনারও কোনো সুযোগ নেই। পরে ঢাকা নেওয়ার পথে আমার ভাতিজির মৃত্যু হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফেনী জেনারেল হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, সেদিন সারারাত ধরে ফেনী জেনারেল হাসপাতালের বেশ কয়েকজন চিকিৎসক তাকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন তারা।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ফেনী প্রাইভেট হাসপাতালের মালিক ল্যাপারোস্কোপিক সার্জন প্রফেসর ডা. কাইয়্যুম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডা. আকিফা সুলতানাকে এনেস্থেসিয়া দেওয়ার জন্য সিনিয়র ও অভিজ্ঞ এনেস্থেসিওলজিস্ট ডা. আবদুর রহমানকে নিয়ে আসা হয়। চিকিৎসকের বয়স ও অভিজ্ঞতা নিয়ে যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে তা সঠিক নয়। কারণ বয়স বাড়লেই যে অভিজ্ঞতা বা চিকিৎসা ভুলে যান এমন নয়। এনেস্থেসিয়া দেওয়ার জন্য ডা. আবদুর রহমানের সঙ্গে স্থানীয় একজন জুনিয়র চিকিৎসকও উপস্থিত ছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে এনেস্থেসিওলজিস্ট ডা. আবদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও সাড়া মেলেনি।
এদিকে গতকাল রোববার (২৩ জুন) এ ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে ফেনী সিভিল সার্জন কার্যালয়।
কমিটিতে ফেনী জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মো. জালাল হোসেনকে সভাপতি করা হয়েছে। এতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারি) ডা. মো. কামরুজ্জামান, দাগনভূঞা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তৌহিদুল ইসলাম, ফেনী জেনারেল হাসপাতালের জুনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনি) ডা. তাহিরা খাতুন ও জুনিয়র কনসালটেন্ট (এনেস্থেসিয়া) ডা. মো. ইলিয়াছ ভূঞা।
ফেনীর সিভিল সার্জন ডা. শিহাব উদ্দিন বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের নির্দেশনা মোতাবেক সার্জারি করার সময়ে জটিলতার প্রেক্ষিতে রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে পাঁচ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।