দেশে দীর্ঘদিন ধরে ডলার সংকট চলছে। নানা উদ্যোগেরও এ সমস্যার যেন সমাধান হচ্ছে না। তার মধ্যে আমদানির দায় মেটাতে গিয়ে বাজারে প্রচুর ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বা রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে পারছে না বাংলাদেশ। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের তৃতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়ের বিষয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।
২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ সর্বোচ্চ উঠেছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার (৪৮ বিলিয়ন)। এখন এ রিজার্ভ ২৪ বিলিয়নের ঘরে নেমেছে। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে খরচযোগ্য রিজার্ভ আরও কম, ১৩ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। রিজার্ভের এমন পরিস্থিতি আইএমএফের ৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ঋণের তৃতীয় কিস্তির ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার পাওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ জুনে রিজার্ভ সংরক্ষণের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু বর্তমান রিজার্ভ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ৫২ বিলিয়ন কম।
এ লক্ষ্য পূরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি বন্ধ করে ডলার কেনাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
অন্যদিকে, আগামী ২৪ জুন আইএমএফের বোর্ড সভায় ঋণ সংক্রান্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। বিপিএম ৬ হিসাবে ১৯ দশমিক ৫২ বিলয়ন। সেখান থেকে চলতি দায় বাবদ ৫ দশমিক ২৪ বিলিয়ন বাদ দিলে ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। যা আইএমএফের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্য ১৪ দশমিক ৮০ বিলিয়ন থেকে প্রায় ১ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার কম।
রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় জড়িত বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আগামী ২৪ জুন আইএমএফের বোর্ডে তৃতীয় কিস্তির বিষয়টি উঠবে। রিজার্ভের লক্ষ্য পূরণ করতে না পারলে এবারের কিস্তি ছাড় নাও হতে পারে। গত ৬ জুন পর্যন্ত রিজার্ভের তথ্য আইএমএফকে সরবরাহ করা হয়েছে। তাদের লক্ষ্যের তুলনায় প্রায় দুই বিলিয়ন ঘাটতি ছিল। এর মধ্যে বিদেশ থেকে ঋণ এসেছে। বিশ্বব্যাংকের ৫০০ মিলিয়নসহ আরও ৯০০ মিলিয়ন ঋণ শিগগিরই আসবে। তাহলে ঘাটতি কমে যাবে। আর চলতি জুনে মাত্র ৪০ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। কারেন্সি সোয়াপের (ডলারের মাধ্যমে টাকা অদল-বদল) মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ডলার কেনায় আইএমএফের আপত্তি থাকায় বাজার থেকে সরাসরি ডলার কেনা চলমান রয়েছে। নতুন করে ঋণের ৯০০ মিলিয়ন যোগ হলে রিজার্ভ ১৪ বিলিয়ন পার হতে পারে। তবুও ঘাটতি পূরণ হবে না। তবে যেকোনো মূল্যে তৃতীয় কিস্তি পেতে রিজার্ভ বাড়াতে বদ্ধপরিকর কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আইএমএফের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্ত হিসেবে চলতি জুনে রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। যা পূরণে ঘাটতি দেড় বিলিয়নের বেশি। সবশেষ ২২ জুনের রিজার্ভের হালনাগাদ তথ্য পাঠাবে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর লক্ষ্য পূরণ না হলে ঋণের তৃতীয় কিস্তি বাবদ ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার ২৪ জুন বোর্ড অনুমোদন পাওয়া নিয়ে ঝামেলা হতে পারে।
এ বিষয় বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, রিজার্ভের নতুন লক্ষ্যমাত্রা ১৪ দশমিক ৮০ বিলিয়ন হলেও তা পূরণ করা কঠিন। কারণ, দেশের রিজার্ভে বৈদেশিক মুদ্রা যেসব উৎস থেকে আসে ও ব্যয় হয় সেখানে ভারসাম্য নেই। ফলে রিজার্ভ ধরে রাখা যাচ্ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে ঋণের তৃতীয় কিস্তি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে আইএমএফের অন্যান্য শর্ত পূরণে অগ্রগতি থাকায় ঋণে ইতিবাচক মনোভাব দেখাতে পারে বোর্ড।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে রিজার্ভ লক্ষ্যমাত্রা ১৪ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার ও ডিসেম্বর শেষে ১৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০২৫ সালের মার্চ শেষে ১৬ দশিক ৬১ বিলিয়ন ডলার এবং একই বছরের জুনে ১৯ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ব্যয়যোগ্য রিজার্ভের লক্ষ্য ছিল ২৬ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের আগস্ট মাসে মোট রিজার্ভের রেকর্ড ছিল ৪৮ দশমিক ০৬ বিলয়ন ডলার। যা কমে মাত্র ৩৪ মাসে এসে নেমেছে ২৪ বিলিয়নের ঘরে। আর ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আইএমএফের বাধা সত্ত্বেও রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরে ৯ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ১৩ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৭ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার। এই তিন অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ৩০ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। অপরদিকে, আইএমএফের আপত্তির মুখে চলতি অর্থবছরে সোয়াপ পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ৪ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানা গেছে, আইএমএফের ৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭৬ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার এসেছে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। আর দ্বিতীয় কিস্তি হিসেবে প্রায় ৬৮১ মিলিয়ন ডলার আসে গত বছরের ডিসেম্বরে। আর তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের বিষয়টি বোর্ডে উঠতে যাচ্ছে ২৪ জুন (সোমবার)।