একজন সৈয়দ মহসিন আলীর বিদায়  

Slider জাতীয়

92664_f3

 

প্রস্তুতি চূড়ান্তই ছিল। অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। দু’একদিনের মধ্যে দেশে ফিরবেন। হজে যাবেন। কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ নিয়তি। সবাইকে অজানার দেশে পাড়ি দিতে হবে। আড্ডা অন্তঃপ্রাণ এই মানুষটিও পাড়ি দিলেন চির অজানার দেশে। গণমুখী রাজনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র সৈয়দ মহসীন আলী। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় দুর্নীতির কলঙ্ক যাকে স্পর্শ করেনি। সিলেটের মৌলভীবাজারে সৈয়দ মহসিন আলী তিন তিনবার পৌর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। ’৭১-এর বীর মুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধুর স্নেহ ছায়ায় রাজনীতির দীর্ঘ পথ হাঁটা সৈয়দ মহসিন আলী দীর্ঘদিন মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। দিনে ১০ প্যাকেটের উপর সিগারেট পান করতেন। দিল্লির বিখ্যাত কার্ডিয়াক হাসপাতাল এস্কটে তার বাইপাস সার্জারির পর কিছুদিন সিগারেট ছেড়েছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ বিরতি দিতে পারেননি। ১০ প্যাকেট থেকে ৬ প্যাকেটে নামিয়ে এনেছিলেন। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে মৌলভীবাজার সদর আসনে সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমানকে হারিয়ে তিনি বিজয়ী হন। ওই নির্বাচনের পর টানা ২১ দিন কোমায় থেকে রীতিমতো পুনঃজীবন নিয়ে ফিরে এলেও ধূমপানের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেননি। বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে সন্তানতুল্য এক কিশোরের জীবনদান তাকে এতটাই ব্যথিত করেছিল যে, সেখান থেকেই ধূমপানের হাতেখড়ি। জীবনের শেষ বেলায় প্রকাশ্যে ধূমপান নিয়ে সমালোচনা ছাড়াও ডাক্তারের নিষেধাজ্ঞা থাকায় পরিবারের সদস্যরা যখন বলতেন এটি না ছাড়লে মন্ত্রিত্ব হারানোর মতো সম্মানহানির ঘটনা ঘটবে। তখন তিনি বলতেন, সাদা কাগজ নিয়ে এসো। পদত্যাগপত্রে সই করে দিচ্ছি। ধূমপানের সঙ্গে বিচ্ছেদ সম্ভব নয়। মৌলভীবাজারের সম্ভ্রান্ত ও বনেদি বিত্তশালী পরিবারের সন্তান মহসিন আলী রাজনীতিতে এসে কখনও দুর্নীতির কলঙ্ক গায়ে মাখেননি। দিনে দিনে হয়েছেন রিক্ত-নিঃস্ব। বঙ্গবন্ধুকে নবীগঞ্জের বিখ্যাত বড় বড় কৈ মাছ খাইয়ে আনন্দ পেতেন। আর মুজিবকন্যা শেখ হাসিনাকে হাকালুকি থেকে সুনামগঞ্জের বরদই বিলের ধরাপড়া সবচেয়ে বড় রুই মাছটি খাইয়ে সুখ পেতেন। মৌলভীবাজারের বাড়িই নয়, ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর মন্ত্রী হিসেবে মিন্টো রোডের ৩৪ নম্বর লাল বাড়িটিতে উঠেও মানুষের জন্য দুয়ার খুলে রাখতেন দিবারাত্রি। মানুষকে আতিথেয়তা করে কতটা আনন্দ পাওয়া যায় সৈয়দ মহসিন আলীর সান্নিধ্যে না গেলে তা জানা যায় না। মিন্টো রোডের বাড়ি থেকে মৌলভীবাজারের বাংলো প্যাটার্নের বাড়িখানি যেন ছিল সরাইখানা। মিন্টো রোডের বাড়িতে ঋণ করে ৬০ লাখ টাকা খরচ করেছিলেন। দু’খানি ঘর বানিয়েছিলেন। প্রান্তিক থেকে আসা অসুস্থ মানুষের থাকার জন্য ব্যবস্থা করেছিলেন। থাকা-খাওয়ার এলাহী আয়োজন ছিল মিন্টো রোডের বাড়িটিতে। ক্যান্সার, হার্ট, কিডনি, ডায়াবেটিস রোগীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য বাইরে পাঠানোর নিয়মিত ব্যবস্থা করতেন তিনি। মানুষের জন্য আশেপাশের আত্মীয়-পরিজনদের পকেটে হাত দিতে কার্পণ্য করতেন না। অথচ বিভিন্ন নির্বাচন করতে গিয়ে পৈতৃক ভিটেমাটি বিক্রি করতে করতে সর্বশেষ পরিবারের কাঁধে দেড় কোটি টাকার ঋণের বোঝা রেখে গেছেন। দেশ ও মানুষকে ভালবেসে জীবন বিলিয়ে দেয়ার এক মডেল ছিলেন সৈয়দ মহসিন আলী। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে গণমুখী রাজনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের চির বিদায় ঘটলো যিনি রাজনীতিতে এসে মানুষের শ্রদ্ধা, ভালবাসা কুড়ালেও বিত্ত-বৈভব হারিয়েছেন। দীলিপ কুমার-মধুবালা কালের সময় থেকে মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশের হিন্দি ও আধুনিক বাংলা গানগুলো ছিল তার মুখস্থ। এক সময় বেতারের শিল্পী ছিলেন। গাইতেনও ভাল। শেষ জীবনে গলায় সুর, তাল, লয় কেটে যায় শরীরের অসুখ বাঁধার কারণে। তবুও মজলিশি আড্ডায়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এমন কি সংসদেও শিশুর সারল্যতা নিয়ে গান গাইতেন। যেখানেই মহসিন আলী সেখানেই রাত নামলে গানের জলসা বসতো। মিন্টো রোডের বাড়িতে রোজ রাতে গানের আসর বসতো। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীরা তো থাকতেনই পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীরাও আসতেন। গ্রামীণ বাউলরাও থাকতেন। দুস্থ শিল্পীদের জন্য তিনি সাহায্যের দু’হাত বাড়িয়েছিলেন। শীতকালে সুনামগঞ্জের হাওরে তার কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে বেড়াতে যেতেন। উচ্চ শিক্ষার সার্টিফিকেট না থাকলেও ফ্যাশনদুরস্ত এই সুপুরুষ যৌবনেই আয়ত্ত করেছিলেন হিন্দি, উর্দু ও ইংরেজি ভাষা। আল্লাহভীরু মানুষটি মাজারে মাজারে ঘুরতেন। মিলাদ দিতেন। তার কাছ থেকে অচেনা মানুষেরাও খালি হাতে ফিরতেন না। শুধু রাজনৈতিক সম্প্রীতিই নয়, একটি অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনা তিনি লালন করতেন। সংস্কৃতি ও খেলাধুলায় পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মানুষের মাঝে থেকেই উপভোগ করেছেন। তার জীবন ছিল খোলা বইয়ের মতো। শেষ দু’টি দিন তার আকুতি ছিল দেশে এসেই হজে যাওয়ার। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই মানুষটিকে জান্নাত দিন। মহসিন ভাইয়ের সঙ্গে আত্মীয়তার বাইরেও আত্মার সম্পর্ক ছিল তিন দশকের। অগ্রজের সঙ্গে অনুজের হৃদয় ছিল সুতোয় বাঁধা। সুতো কখনও ছিঁড়েনি। বন্ধুবৎসল মানুষটিকে হারিয়ে অনেকেই শোকে আচ্ছন্ন। মিন্টো রোডের লাল বাড়িটিতে এতদিন বসেছিল গানের জলসা। গতকাল সকাল থেকেই কোরআন তেলাওয়াতের সুর ভেসে আসছে। আজ মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টায় তার মরদেহ ঢাকায় আসবে, কাল সকাল ১১টায় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় নামাজে জানাজা শেষে হেলিকপ্টারে জন্ম ও রাজনীতির শেষ ঠিকানা মৌলভীবাজারে নিয়ে যাওয়া হবে। গতকাল বিকালে চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে সবকিছু ঠিক করার কথা। ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া, সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ, হুইপ ইকবালুর রহিম গতকাল মরহুমের বাসভবনে তার ভাই ও কন্যাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সৈয়দ মহসিন আলীর চিরবিদায়ের মধ্য দিয়ে একজন রাজনীতিবিদের ধূমপান বিতর্কেরই অবসান ঘটেনি, দেহের চেয়ে বড় হৃদয় দিয়ে মানুষকে ভালবেসে কল্যাণের রাজনীতিতে দীর্ঘ পথ হাঁটা একটি বর্ণাঢ্য ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটলো।
মরদেহ আসছে আজ, দাফন কাল: সমাজকল্যাণমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসিন এমপি আলী আর নেই (ইন্নালিল্লাহি… রাজিউন)। গতকাল সকাল ৮টা ৫৯ মিনিটে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রীর পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, নিউমোনিয়া, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। মন্ত্রী মহসিন আলীর মৃত্যুতে প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মন্ত্রী পরিষদের সদস্যরা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। গতকাল মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠক তাৎক্ষণিক শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, সংসদের বিরোধী নেতা রওশন এরশাদসহ বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের তরফে তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়েছে। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন মানবজমিন-এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। মহসিন আলীর মৃত্যুর খবরে গতকাল দিনভর মিন্টু রোডস্থ মন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা এবং ঢাকায় থাকা স্বজন-শুভানুধ্যায়ীরা ভিড় করেন। সেখানে তারা শোক বইতে মন্তব্য লেখাসহ তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। মন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা মৌলভীবাজারসহ গোটা সিলেটে তার মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসসের রিপোর্টে বলা হয়েছে, মৌলভীবাজার-৩ (সদর-রাজনগর) আসন থেকে ২০০৮ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পুনঃনির্বাচিত হওয়ার পর ওই বছরের ১২ই জানুয়ারি মন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন তিনি। পরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে স্কুলজীবনে ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে যোগ দেন মহসিন আলী। মুক্তিযুদ্ধে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তার।  যুদ্ধকালীন সিলেট বিভাগ সিএনসি স্পেশাল ব্যাচের কমান্ডার হিসেবে সম্মুখযুদ্ধে নিষ্ঠার সঙ্গে নেতৃত্ব প্রদান করেন তিনি। সেখানে আহতও হন তিনি। সৈয়দ মহসিন আলী জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তিনি সিলেট জেলা ও বিভাগীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হিসাবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯৮ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন।  এছাড়া তিনি সেক্টরস কমান্ডার ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নবম সংসদে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মৌলভীবাজার পৌরসভা চেয়ারম্যান হিসেবে তিনবার নির্বাচিত হন। ১৯৯২ সালে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে শ্রেষ্ঠ পৌরসভা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত জেলা রেডক্রিসেন্টের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান, মৌলভীবাজার চেম্বারের সভাপতি এবং মৌলভীবাজার জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ‘আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন স্মৃতি স্বর্ণপদক-২০১৪’ পদক এবং ‘হ্যালো কলকাতা’ নামে কলকাতাভিত্তিক একটি সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান তাকে ‘নেহেরু সাম্য সম্মাননা-২০১৪’ পুরস্কারে ভূষিত করে। সৈয়দ মহসিন আলী এমপি ভারতের কলকাতা থেকে এমবিএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বাংলা, ইংরেজি, উর্দু ও হিন্দি ভাষায় কথা বলা ও লেখায় সুদক্ষ ছিলেন। সৈয়দ মহসিন আলী ১৯৪৮ সালের ১২ই ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল সড়কের ‘দর্জিমহল’-এ এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সৈয়দ আশরাফ আলী এবং মাতা আছকিরুন্নেছা খানম। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি স্ত্রী ও ৩ কন্যা সন্তানের জনক।
মন্ত্রীর মরদেহ সিঙ্গাপুর থেকে আজ দেশে আনা হবে। বাংলাদেশ বিমান কিংবা সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের নিয়মিত ফ্লাইটে মরদেহ ঢাকায় আনা হতে পারে। মন্ত্রীর জানাজা এবং তার দাফনের বিষয়ে গতকাল বিকালে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত মতে, আজ মরদেহ ঢাকায় পৌঁছানোর পর প্রথমে তার মন্ত্রিপাড়ার সরকারি বাসভবনে নেয়া হবে। সেখানে কিছু সময় রাখা হবে। রাতে তার লাশ বারডেমের মরচুয়ারিতে রাখা হবে। পরদিন সকালে তার লাশ শহীদ মিনারে নেয়া হবে। এরপর সাড়ে ১০টার দিকে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় প্রথম জানাজা হবে। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে লাশ নেয়া হবে মৌলভীবাজার। সেখানে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠে তার দ্বিতীয় জানাজা শেষে স্থানীয় শাহ মোস্তফা (রহ.) মাজার সংলগ্ন কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হবে বলে বলে তার ভাই সৈয়দ মোস্তাক আলী মানবজমিনকে জানিয়েছেন।
মৌলভীবাজারে কাঁদছেন তার ভক্ত-সুহৃদরা
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি জানান, এমন জীবন করিবে গঠন, মরিলে হাসিবে তুমি, কাঁদিবে ভুবন- কবিতার এই পঙ্‌ক্তি সৈয়দ মহসিন আলীর বাড়িতে শোক জানাতে এসে শোক বইতে লিখেছেন এক ব্যক্তি। গতকাল সোয়া ১২টায় মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসিন আলীর বাড়ির বারান্দায় যেতেই প্রমাণ মিলল এই কথাগুলোর। এক শীর্ণকায় বৃদ্ধ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। দুই চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে। জিজ্ঞাসার জবাবে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বাইনকা গ্রামের এই বৃদ্ধ কুদরত মিয়া (৬০) নিজের অসুস্থ ছেলেকে দেখিয়ে বললেন, মহসিন আলীর সাহায্যে আমার ও আমার ছেলের চিকিৎসা হয়েছে। এখন আমাদের সুখ-দুখের কথা কে শুনবে। কে আমাদের আপদে-বিপদে সাহায্য করবে। এই সময় আরেক মহিলা এগিয়ে এসে বলেন, রাজনগর উপজেলার আকুয়া গ্রামের ১০/১২ বছরের এক শিশুর হার্টের ছিদ্র ছিল। তার চিকিৎসার জন্য মাদ্রাজ পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন মন্ত্রী। এমন আরও সংবাদ পাওয়া যায় সৈয়দ মহসিন আলীর সমাজসেবার নমুনা হিসাবে। জনদরদী নেতা হিসেবে তার পরিচিতি ছিল মৌলভীবাজারে। একই সময় এককোণে দাঁড়িয়ে আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে দেখা যায় দুই মহিলাকে। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার সীতশ্রী গ্রামের এই মহিলা (মিনা ও রুনু) জানান, মন্ত্রী (সৈয়দ মহসিন আলী) তাদের আত্মীয়। কথা ছিল তাদের গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার। কাজ অনেকদূর এগিয়েও ছিল বলে জানান তারা। কেবল মিনা, রুনু কিংবা বৃদ্ধ কুদরত মিয়াই নন, মন্ত্রীর মৃত্যুত কাঁদছে পুরো মৌলভীবাজার। শোকে স্তব্ধ সবাই। দলীয় কর্মী-আত্মীয়স্বজন ছাড়াও দলে দলে ভক্ত-অনুরাগী ভিড় করেন তার মৌলভীবাজার শহরের শ্রীমঙ্গল সড়কস্থ বাড়িতে। রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে শোক জানাতে উপস্থিত হন নবীন প্রবীণ বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা। শিক্ষক-রাজনীতিক-সাংবাদিক-সাধারণ মানুষ শোক বইতে প্রিয় নেতার মূল্যায়ন করেন নিজের বিবেচনায়। এ বাড়ি এমনিতেই ছিল জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। রাজনীতিতে পোড় খাওয়া এই নেতা সাধারণ মানুষের কাছে ছিলেন খুবই জনপ্রিয়। একজন দানশীল মানুষ হিসেবে তার পরিচয় ছিল। ছিলেন অতিথিপরায়ন। সৈয়দ মহসিন আলী সম্পর্কে তার আপন ছোট ভাই সৈয়দ মোস্তাক আলীর মূল্যায়ন ছিল এরকম- তিনি ভুখা-নাঙ্গা মানুষের প্রিয় নেতা ছিলেন। কিন্তু অসুস্থতার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে মাঝে মধ্যে রেগে যেতেন। রাগারাগি যার সঙ্গে করতেন তাকে আবার পরে আপন করে নিতেন। জেলার বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক এমপি আজিজুর রহমান তার এ অনুজ সম্পর্কে বলেন, ‘মহসিন আপাদমস্তক সরল ও উদার সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। তার রাজনৈতিক জীবনে রাগ-অভিমান থাকলেও হিংসা-বিদ্বেষ ছিল না। বড় মনের মানুষ ছিল সে। তার মৃত্যুতে দল এবং এলাকার অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল।’ মহসিন আলীর মৃত্যুতে মৌলভীবাজার পৌরসভা তিন দিনের শোক ঘোষণা করেছে। পৌরসভার এই সাবেক চেয়ারম্যানের প্রতি সম্মান জানিয়ে গতকাল  অফিস ছুটি দেয়া হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পৌর মেয়র ফজলুল করিম ময়ূন। মন্ত্রীর মৃত্যুতে জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনায় দোয়া করা করা হয়।
পক্ষ-প্রতিপক্ষ সবাই শোকাহত
স্টাফ রিপোর্টার, মৌলভীবাজার থেকে জানান, মন্ত্রী, জনদরদী নেতা সৈয়দ মহসিন আলীর মৃত্যুর খবর জানাজানি হলে পুরো জেলার রাজনৈতিক অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। এ শোকের মিছিলে শামিল ছিলেন তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাও। মানবজমিনের সঙ্গে আলাপে জাতীয় সংসদের হুইপ আলহাজ শাহাবুদ্দিন এমপি, মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহিদ এমপি, সাধারণ সম্পাদক নেছার আহমদ, সাবেক এমপি এম নাসের রহমান, মৌলভীবাজার সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ভিপি মিজানুর রহমান, পৌর মেয়র ফয়জুল করিম ময়ূন, জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি এম এ ফিরুজ, সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুর রহমান বাবুল, মৌলভীবাজার চেম্বার অ্যান্ড কমার্সের সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক  কামাল হোসেন,  জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি সৈয়দ শাহবুদ্দিন আহমদ, জাসদ সভাপতি এম এ হক, প্রেস ক্লাবে সভাপতি এম এ সালাম ও সাধারণ সম্পাদক এসএম উমেদ আলী, ঢাকাস্থ মৌলভীবাজার সমিতির সেক্রেটারি নাসির উদ্দিন মিঠুসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া সংগঠক ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা তার মৃত্যুতে গভীর শোক  ও সমবেদনা জানান।
শোকবার্তায় যে যা বলেছেন: সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলীর মৃত্যুতে প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ শোকবার্তায় বলেন, সাহসী মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসিন আলীর মৃত্যুতে জাতি একজন ত্যাগী রাজনীতিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হারাল। তার মৃত্যুতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। মরহুমের বিহেদী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান প্রেসিডেন্ট।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার শোকবার্তায় বলেন, সৈয়দ মহসিন আলীর মৃত্যুতে জাতি একজন সৎ ও দেশপ্রেমিক নেতাকে হারাল। তিনি গণমানুষের জন্য তার সমগ্র জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে তার শোকাহত  পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান প্রধানমন্ত্রী।
জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, সৈয়দ মহসিন আলীর মৃত্যুতে দেশ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সমাজসেবক, প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও সরলপ্রাণ মানুষকে হারালো। তার মৃত্যু দেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান স্পিকার। অপর শোকবার্তায় ডেপুটি স্পিকার বলেন, সৈয়দ মহসিন আলীর মৃত্যু রাজনৈতিক অঙ্গনের এক অপূরণীয় ক্ষতি। মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন তিনি। বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ শোকবার্তায় বলেন, মরহুম সমাজকল্যাণমন্ত্রী মহান মুক্তিযুদ্ধে যে অবদান রেখেছিলেন জাতি চিরকাল তা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ রাখবে। মরহুমের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান রওশন এরশাদ। জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আ. স. ম ফিরোজ তার শোকবার্তায় বলেন, সৈয়দ মহসিন আলীর মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে ক্ষতি হলো তা কোনভাবেই পূরণ হওয়ার নয়। সমাজকল্যাণমন্ত্রীর মৃত্যুতে মন্ত্রিসভায় শোকপ্রস্তাব গৃহীত হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব এম মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া সাংবাদিকদের জানান, এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মান জানানোর জন্য মন্ত্রিসভায় এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তার শোকবার্তায় বলেন, মহসিন আলী স্বাধীনতা যুদ্ধে একজন অকুতোভয় সৈনিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্বাধীনতা-উত্তর দেশ গঠনে তার অবদান অবিস্মরণীয়। তার মৃত্যুতে জাতির যে ক্ষতি হলো তা পূরণ হওয়ার নয়। মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকাহত  পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান অর্থমন্ত্রী। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন শোকবাণীতে বলেন, তার মৃত্যুতে জাতি একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদকে হারালো। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে মরহুমের অবদান জাতি চিরদিন স্মরণ রাখবে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শোকবাণীতে  বলেন, তার মৃত্যুতে দেশ একজন রাজনীতিবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হারালো। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু প্যারিস থেকে পাঠানো এক শোকবার্তায়  বলেন, সমাজকল্যাণমন্ত্রীর মৃত্যুতে দেশ একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা, নিঃস্বার্থ জনদরদী নেতা ও সংস্কৃতিমনা প্রবীণ রাজনীতিককে হারালো। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান, ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও শোক প্রকাশ করেছেন।
মহসিন আলীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে মানবজমিন-এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, মহসিন আলী আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু ছিলেন। তার মৃত্যুতে আমরা একজন সজ্জন ব্যক্তিকে হারালাম। মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান তিনি।
এদিকে মহসিন আলীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। এক শোকবার্তায় মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান তিনি। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরী, জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সি এম তোফায়েল সামী, ঢাকাস্থ মৌলভীবাজার সমিতির সভাপতি আব্দুল কাদির মাহমুদ, সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন আহমদ মিঠুসহ সংগঠনের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যদের তরফেও মন্ত্রীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *