সারাদেশে যোগ্য বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকার পরও (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) এমপিওভুক্ত দেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ফলে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে এ খাতের জন্য বরাদ্দ ২৫০ কোটি টাকা ফেরত যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে ধরে এ খাতে ২৫০ কোটি বরাদ্দ দিলেও আসন্ন অর্থ বছরের বাজেটে সেই টাকা নাও পেতে পারে। ফলে দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষায় থাকা শিক্ষক-কর্মচারীরা আগামী বছরে এমপিওভুক্ত নাও হতে পারেন। এ নিয়ে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, চলতি অর্থ বছরের বাজেটে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। এরমধ্যে নতুন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার জন্য দুই বিভাগের জন্য ২৫০ কোটি বরাদ্দ রাখা হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের জন্য ২০০ কোটি এবং কারিগরি বিভাগের জন্য ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু চলতি অর্থ বছরের সাধারণ ক্যাটাগরিতে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়নি। তবে গেল সংসদ নির্বাচনের আগে মন্ত্রী-এমপিদের নির্বাচনী উপহার হিসেবে বিশেষ বিবেচনায় ৯১টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেশিরভাগ এখনো এমপিওভুক্ত হয়নি। তাই এ খাতের বরাদ্দ হিসেবে ২৫০ টাকা ফেরত যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেট শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, বৃহস্পতিবার (৬ জুন) সংসদে আগামী অর্থ বছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী। আর ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে সেই বাজেট। এরমধ্যে চলতি অর্থ বছরের আয় ব্যয়ের হিসেব কষছেন তারা। সেখানে বিভিন্ন উন্নয়ন খাতের জন্য বরাদ্দের আংশিক বা অর্ধেক টাকা খরচ হলেও এমপিও খাতের জন্য বরাদ্দ টাকা খরচ হয়নি।
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের বাজেট শাখার যুগ্মসচিব মো. নূর-ই আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, চলতি বছরের যেহেতু নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়নি তাই এখাতের জন্য বরাদ্দ টাকা ব্যয় হয়নি। সংগত কারণে এ টাকা ফেরত যাবে। তবে বিশেষ বিবেচনায় ৯১টি এবং গত অর্থ বছরে যে-সব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়েছিল সেব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী চলতি অর্থ বছরে এমপিওভুক্ত হচ্ছে। তাদের বেতন ভাতা বাবদ কিছু টাকা কাটা হতে পারে।
কারিগরি ও মাদ্রাসা শাখার উপসচিব (এমপিও) সাজ্জাদ হোসেন বলেন, এ বিভাগের জন্য নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ ছিল ৫০ কোটি টাকা। চলতি অর্থ বছরে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত না হওয়ায় এ খাতের কোনো টাকা খরচ হয়নি। ফলে এ টাকা ফেরত যাবে।
স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে এমপিও খাতে বরাদ্দ
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমপিও শাখা সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ ২০১০ সালের জুনে ১ হাজার ৬২৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়। এরপর এমপিওভুক্ত বন্ধ রাখে সরকার। এতে কয়েক হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যোগ্য হওয়ার পরও এমপিওভুক্ত হতে পারেনি। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকরা টানা আন্দোলন করেছে। এরপর প্রায় এক যুগ বন্ধ থাকার পর ২০১৮ সালে ২ হাজার ৭৬৮টি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাকে এমপিওভুক্ত করা হয়। এরপর ২০১৯ ও ২০২১ সালে সর্বশেষ এমপিওভুক্তি দেয় সরকার। যদিও এরমধ্যে মন্ত্রী-এমপিদের আধা-সরকারিপত্রের (ডিও লেটার) দুই দফা বিশেষ বিবেচনায় আরও হাজার খানেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়।
বাজেট শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৮ সালে এমপিওভুক্ত ঘোষণার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, যেহেতু দীর্ঘদিন এ প্রক্রিয়া বন্ধ ছিল তাই প্রতিবছর যেন এমপিওভুক্ত করার কাজটি বহাল থাকে। এরপর থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ দিয়ে থাকে।
২০১৮-১৯ অর্থ বছরের পর করোনা মহামারির কারণে বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। কিন্তু পরে ২০২১-২২ অর্থবছরে নতুন এমপিওভুক্তির জন্য ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়। এরমধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের জন্য ২০০ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের জন্য চাওয়া হয় ১০০ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয় দুই বিভাগকে প্রতি অর্থ বছরে ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে আসছে। কিন্তু নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত না হওয়ায় ২০২২-২৩ অর্থ বছরের এ খাতের বরাদ্দ ফেরত যায়। চলতি অর্থ বছর ২০২৩-২৪ এ খাতে টাকা ফেরত যাচ্ছে।
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, চলতি বছর বিশেষ বিবেচনায় ৯১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করায় নতুন করে আবেদন নেওয়া হয়নি। আগামীতে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা যেতে পারে। তাই এবার যেহেতু এমপিওভুক্ত হয়নি তাই এ খাতের টাকা খরচ হয়নি। আগামী বাজেটে এটার সংস্থাপন করা হয়।
সরকার বরাদ্দ দেওয়ার পরও এমপিওখাতে টাকা খরচ করতে না পারায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মাহমুদুন নবী ডলার। তিনি বলেন, এক সময় সরকার বরাদ্দের জন্য এমপিও দিতে পারতো না আর এখন সরকার বরাদ্দ দেয় কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেই বরাদ্দ ব্যবহার করতে পারে না। এটা খুবই দুঃখজনক।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী প্রতি বছর এমপিওভুক্তি খাতে বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি টানা এ খাতের বরাদ্দ ব্যবহার করতে না পারে তাহলে একসময় হয়ত এ বরাদ্দ বন্ধ হয়ে যাবে। তখন চাইলেও এ খাতে বরাদ্দ আনা সম্ভব হবে না।
যেভাবে দেওয়া হয় এমপিওভুক্তি
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এমপিওভুক্ত করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। একটি ‘প্রতিষ্ঠান বাছাই কমিটি’। তারা সর্বশেষ এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী যোগ্য প্রতিষ্ঠান যাচাই-বাছাই করে এমপিওভুক্ত করার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের আবেদনের তথ্যে কোনো অনিয়ম বা অসামঞ্জস্য থাকলে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও সরকারের কাছে সুপারিশ করে কমিটি।
অন্য কমিটি হলো ‘কারিগরি কমিটি’। এ কমিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবেদনপত্র নেওয়া এবং প্রাথমিক যাচাই-বাছাই করে। কমিটির নীতিমালা অনুযায়ী শর্ত পূরণ করে আবেদনপত্র গ্রহণ এবং তা সফটওয়্যারে প্রসেস করে একটি তালিকা প্রস্তুত করবে। সফটওয়্যারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রস্তুত করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরে গ্রেডেশন তালিকা ‘প্রতিষ্ঠান বাছাই কমিটির’ কাছে উপস্থাপন করে।
তিন মানদণ্ডে ১০০ নম্বরে মূল্যায়ন
বিশেষায়িত অটোমেটেড সফটওয়্যারে এমপিওর আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করার পর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিদ্যালয়ের (বুয়েট) তৈরি করা এই বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে সারাদেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির আবেদন যাচাই বাছাই করা হয়। প্রধান তিনটি মানদণ্ডে ১০০ নম্বরে মূল্যায়ন করা হয়। তিন ক্যাটাগরিতে মোট ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে এ গ্রেডিং হবে। মানদণ্ডগুলো হলো- শিক্ষার্থীর সংখ্যা (৩০ নম্বর), পরীক্ষার্থীর সংখ্যা (৩০ নম্বর) এবং পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হার (৪০ নম্বর)।
এমপিও নীতিমালা-২০২১-এ এমপিওভুক্তির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঁচটি স্তর নির্ধারণ করা হয়েছে। স্তরগুলো হলো- নিম্ন মাধ্যমিক (৬ষ্ঠ থেকে ৮ম), মাধ্যমিক (৯ম থেকে ১০ম), উচ্চ মাধ্যমিক (৬ষ্ঠ থেকে ১২তম), কলেজ (১১তম থেকে ১২তম), স্নাতক (পাস) তথা ডিগ্রি কলেজ (১১তম থেকে ১৫তম)।