৭ জানুয়ারির নির্বাচন পূর্ববর্তী আন্দোলন সফল না হওয়ার পেছনে সাংগঠনিক নাকি নেতৃত্বের ব্যর্থতা ছিল— তা নিয়ে এখনও বিএনপিতে পর্যালোচনা চলছে। পাশাপাশি যুগপৎ আন্দোলনে শরিকদের সঙ্গে নতুন করে বোঝাপড়া বাড়াতে ধারাবাহিক বৈঠক করছে দলটির শীর্ষ নেতারা। এ অবস্থায় সরকারবিরোধী লাগাতার আন্দোলন কর্মসূচিতে নামতে আরো সময় নেবেন তারা। তবে, ইস্যু ও দিবসভিত্তিক নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি চালিয়ে যাবে দলটি।
একাধিক বিএনপিনেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে নিজেদের ভুলত্রুটি কোথায় ছিল, কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত ছিল কি না— দলের স্থায়ী কমিটিতে সেসব বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। ভুল শুধরে দলকে গুছিয়ে কীভাবে আগামী দিনে আন্দোলনের মাঠে নামা যায় তারও পরিকল্পনা শুরু হয়েছে। পাশাপাশি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং বর্তমান সরকারকে বহির্বিশ্ব কীভাবে মূল্যায়ন করছে, সেটার বিশ্লেষণ চালাচ্ছে দলটি।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেক বড় ডিজাস্টারের মধ্যে বিএনপি
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি অনেক বড় ডিজাস্টারের মধ্যে পড়েছে বলে দাবি করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির একাধিক নেতা। তারা বলছেন, দলের সাংগঠনিক অবস্থা যেমন ক্ষতির মুখে পড়েছে তেমনি অনেক নেতাকর্মী কারাগারে গিয়েছেন, হামলা-মামলার শিকারও হয়েছেন। আবার অনেকের পরিবার হামলা-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া নেতাকর্মীদের কারাগার থেকে মুক্ত করা, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সহায়তা করতে গিয়ে দল এই মুহূর্তে আর্থিকভাবে কিছুটা বেকায়দা রয়েছে। এ অবস্থায় বিএনপির পক্ষে বড় ধরনের আন্দোলনে নামার সক্ষমতা কতটুকু, সেটাও বিবেচনাধীন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের কর্মসূচি তো চলমান আছে। দল ও অঙ্গ-সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। তবে সরকারকে টার্গেট করে কবে লাগাতার কর্মসূচি দেওয়া হবে, সেটা দলীয় নীতিনির্ধারকরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। এক্ষেত্রে হয়তো মাসখানেক সময় লাগতে পারে।
তিনি আরো বলেন, এখন দেশে কিছু প্রাকৃতিক সমস্যাও আছে। সারা দেশে চলছে তীব্র দাবদাহ। যার কারণে অনেক কর্মসূচি ঘোষণা করেও পেছাতে বা বাতিল করতে হয়েছে।
এখনো শারীরিক-মানসিক ধকল কাটাতে পারেননি বিএনপির নেতাকর্মীরা
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, সবকিছু গুছিয়ে আনতে আমাদের আরো কিছুদিন সময় লাগবে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত ২৭ থেকে ২৮ হাজার নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। অনেকে এখনও সেই শারীরিক-মানসিক ধকল থেকে মুক্ত হতে পারেননি। স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্যসহ অনেক সিনিয়র নেতা চিকিৎসার জন্য বিদেশে অবস্থান করছেন। তার মধ্যে এখন আবার সারা দেশে চলছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। আন্দোলনে নামার আগে এসব প্রতিবন্ধকতা বিবেচনায় নিতে হবে।
এই নেতা আরো বলেন, এখন নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি চালিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি দলের কেন্দ্রীয় কমিটির শূন্য পদগুলো পূরণ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো গুছিয়ে নেওয়ার কাজ চলবে।
বিএনপির টার্গেট এখন ঢাকা
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশের সব বিভাগীয় শহরে সমাবেশ করে বিএনপি/ কোলাজ
বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, এখন আন্দোলনে নামার আগে বিভিন্ন ফোরাম থেকে আগে সরকারের পদত্যাগ, নতুন নির্বাচনের দাবির বিষয়টি নিয়ে জোরালো আওয়াজ তুলতে হবে। দেশের ‘ভঙ্গুর’ অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য সরকারের যে ভুল নীতি দায়ী, সেটা থেকে বের হওয়ার জন্য দেশে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন প্রয়োজন তা জনগণকে বোঝাতে হবে।
এ প্রসঙ্গে শামসুজ্জামান দুদু বলেন, আমরা তো এই সরকার ও ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে স্বীকার করি না। দেশের জনগণও একটা ভালো নির্বাচনের আশা করে। এখন সেটা মধ্যবর্তী নির্বাচন, কখন এবং কীভাবে হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
বোঝাপড়া বাড়াতে শরিকদের সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছে বিএনপি
হঠাৎ করে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করেছে বিএনপি। যদিও দলটির নেতাদের দাবি, আগামী দিনে এই রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে বিএনপিকে। তাই নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া বাড়াতে শরিকদের সঙ্গে বৈঠক করা হচ্ছে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে তাদের মূল্যায়ন কী, আগামীতে কী ধরনের কর্মসূচি দেওয়া যায়— এসব বিষয়েও তাদের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, গত ১২ মে থেকে যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গীদের সঙ্গে বৈঠক শুরু হয়েছে। ওই দিন বিএনপির লিয়াজোঁ (দুই পক্ষের সংযোগ রক্ষাকারী) কমিটি বৈঠক করে ১২ দলীয় জোট ও এলডিপির সঙ্গে। পরদিন ১৩ মে বৈঠক হয় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও লেবার পার্টির সঙ্গে। আর ১৪ মে বৈঠক হয় নুরুল হকের গণঅধিকার পরিষদ ও গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের সঙ্গে। ১৫ মে বৈঠক হয় গণফোরাম ও গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (১৬ মে) বৈঠক হয় মিয়া মশিউজ্জামানের গণঅধিকার পরিষদ এবং ববি হাজ্জাজের এনডিএমের সঙ্গে।
বৈঠক প্রসঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা বলছেন, আন্দোলনে বিএনপির ব্যর্থতা কোথায় ছিল, ভুল পরিকল্পনা ছিল নাকি কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত ছিল, তা পর্যালোচনা করে বের করা উচিত। তা না হলে আপনি জানতে পারবেন না কেন ব্যর্থ হয়েছেন? এসব বিষয় বৈঠকে তুলে ধরেছি।
আগামীর আন্দোলন-কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হয়েছে : গণতন্ত্র মঞ্চ
গণতন্ত্র মঞ্চের একাধিক নেতা জানান, সরকারের পদত্যাগ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মূল ও প্রধান দাবিটি যেন ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলনে হারিয়ে না যায়, সেটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া আগামী দিনের আন্দোলন-কর্মসূচি কেমন হতে পারে তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। যদিও বিএনপি বলছে, আন্দোলন নিয়ে তারা নিজেরা আবার কথা বলবে। তারপর আবার আমাদের সঙ্গে বসবে।
গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক একটি দলের শীর্ষ নেতা বলেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক আন্দোলনের ব্যর্থতা এবং পরবর্তী পরিস্থিতিসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। জামায়াতের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে বিএনপির কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তারা বলেছে, জামায়াতের সঙ্গে তাদের নতুন করে কোনো কিছু হয়নি। আগের যুগপৎ ধারাই বহাল আছে।
এই নেতা আরো বলেন, ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলন যেন ‘সাপ ছেড়ে দিয়ে দড়ি নিয়ে টানাটানির’ মতো অবস্থা না হয়, সে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। তা না হলে প্রধান ফোকাস অন্যদিকে চলে যাবে। আগামীতে ভারতকে কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে, তাও জানতে চাওয়া হয়েছে। আর যদি সত্যি সত্যি আন্দোলন করার জন্য রাস্তায় নামতে হয়, তাহলে এক ধরনের শক্ত প্রস্তুতি থাকতে হবে।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা ঢাকা পোস্টকে বলেন, নির্বাচনের পর আমাদের সঙ্গে বিএনপির এটাই প্রথম বৈঠক। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকট নিয়ে কথা হয়েছে। এ ছাড়া আগামী দিনের কর্মসূচি নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, শরিকদের সঙ্গে বোঝাপড়া বাড়াতে বৈঠক করা হচ্ছে। সেখানে আগামী দিনের আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে কথা হচ্ছে। সেই পরামর্শগুলো নিয়ে পরবর্তীতে বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হবে। কী ধরনের কর্মসূচি দেওয়া হবে, সেটাও আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।