ঢাকা: ওমরার নামে মানব পাচারের পর এবার সৌদি আরবে হজের নামে ১৫ হাজার মানুষ পাচারের চেষ্টা চলছে। মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, হাব নেতা ও এজেন্সির লোকজনের সমন্বয়ে গঠিত একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এই মানব পাচারে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগে বলা হচ্ছে, মন্ত্রণালয়ের একটি সিন্ডিকেট অতিরিক্ত টাকা নিয়ে ভূয়া ডাটা এন্ট্রি করিয়ে এই ১৫ হাজার বাংলাদেশিকে হজযাত্রী পরিচয়ে সৌদি আরবে পাচারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন।
এর আগে ওমরার নামে ১১ হাজার জনকে পাচারের ঘটনায় বাংলাদেশের ওমরা ভিসা বন্ধ করে দেয় সৌদি আরব। হাব সভাপতিসহ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগও উঠে। আর অভিযোগ তদন্তে কমিটিও গঠন করে সরকার।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর মোট ১ লাখ ১ হাজার ৭৫৮ জন বাংলাদেশি হজে যেতে পারবেন। এর মধ্যে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় যাবে ৯১ হাজার ৭৫৮ জন। সরকারি ব্যবস্থাপনায় যাবে ১০ হাজার।
২০১৫ সালের হজ প্যাকেজ অনুযায়ী, ব্যাংকে মোয়াল্লেম ফি (হজের জন্য সরকার নির্ধারিত টাকা) জমা দিয়ে গত ১ মার্চের মধ্যে এসব হজযাত্রীর নিবন্ধন (ডাটা এন্ট্রি) শেষ করার কথা ছিল। পরে এই সময় বাড়িয়ে করা হয় ২৬ ফেব্রুয়ারি। তবে নিবন্ধনের শেষ সময় পার না হতেই ২২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এক লাখ লোকের নাম নিবদ্ধন হয়ে যায়। আর সে কারণে ওইদিন নিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় মন্ত্রণালয়।
অভিযোগ উঠেছে, ২১ ফেব্রুয়ারি একদিনে কাকতালীয়ভাবে ৩৫ হাজার ব্যক্তি নিবন্ধন করেন। যাদের মধ্যে ১৫ হাজার মোয়াল্লেম ফি জমা না দিয়েই সিন্ডিকেটের সহায়তায় নিবন্ধন করে ফেলেন। আর ব্যাংকে মোয়াল্লেম ফি জমা দিয়েও অনেকে নিবন্ধন করতে পারেননি।
এ নিয়ে অভিযোগ উঠলে নিবন্ধনের পরও মোয়াল্লেম ফি জমা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় বঞ্চিতদের। তবে তাদের মোয়াল্লেম ফিও জমা হয় অতিরিক্ত হজযাত্রীর নামে।
এ অবস্থা দূর করতে সরকারি ব্যবস্থাপনার ১০ হাজারের মধ্যে অপূরণীয় ৭ হাজারের কোটা বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দেওয়া হয়। মোয়াল্লেম ফি জমা নিয়ে সমতার ভিত্তিতে নতুন করে ডাটা এন্ট্রি করারও সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়।
তবে এ ক্ষেত্রেও অভিযোগ রয়েছে শুরু থেকে। আগে কোটা পাওয়া এজেন্সিগুলোকে অতিরিক্ত কোটা দিয়ে হজযাত্রী প্রতি ১০ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে। আর যারা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন তারা কোটা পাননি। বর্তমানে এ অবস্থা আরো ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ভিসার শেষ সময়ে এসে হজযাত্রী প্রতি ২০ হাজার টাকা করে চাওয়া হচ্ছে কোটা বরাদ্দ দেওয়ার জন্য। তবে এ নিয়ে অনেকেই আপত্তি তুলে হজযাত্রী পাঠাতে আপত্তি জানিয়েছে। এজেন্সিগুলোর দাবি, ভূয়া নিবন্ধন বাদ দিয়ে ১০ হাজার হজযাত্রী রিপ্লেসমেন্ট করতে হবে। আর তা এখনও সম্ভব বলে মনে করছেন তারা।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এসব কর্মকাণ্ড ঘটনানো হয়েছে একটি শুক্তশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এই সিন্ডিকেটে ধর্মসচিব চৌধুরী বাবুল হাসান, যুগ্মসচিব (হজ) হাসান জাহাঙ্গীর,ধর্মমন্ত্রীর এপিএস মো. শফিকুল রহমান, সহকারী হজ অফিসার আব্দুল মালেক, কম্পিউটার অপারেটর মো. সোহেলসহ হাবের কতিপয় নেতা ও বিভিন্ন হজ এজেন্সির কিছু লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত।
তবে ধর্মসচিব চৌধুরী বাবুল হাসান বাংলানিউজকে বলেন, হজের নামে মানব পাচারের ঘটনায় আমার এখন যুক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সিন্ডিটেকের সঙ্গে আমার থাকার কোনো কারণ নেই। আমি এগুলো দেখছি না। আশকোনো হজ পরিচালক এখন পুরো বিষয়টি দেখছেন।
এ বিষয়ে আশকোনা হজ ক্যাম্পের পরিচালক ড. আবু সালেহ মো. মোস্তফা কামাল বলেন, নিবন্ধন সম্পন্ন হওয়ার পর গত ১১ মে আমি আশকোনার হজ পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছি। নিবন্ধিত হজযাত্রীদের হজে পাঠানোই আমার দায়িত্ব। আর সংসদীয় কমিটির লোকজন এবং মন্ত্রণালয়ের নির্দেশমত কাজ করছি।
সিন্ডিকেটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিন্ডিকেট করা হয়েছে কিনা বলতে পারবো না।
নিবন্ধিত ৮ হাজার এবং আরো দুই হাজারসহ মোট ১০ হাজার রিপ্লেসমেন্ট করলে মানবপাচার রোধ সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে- এ ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে ধর্মসচিব বলেন, এ ব্যবস্থা নেবেন অতিরিক্ত সচিব শহীদুজ্জামান জামান।
১৫ হাজার ভূয়া নিবন্ধন ও মানপাচারের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ধর্মমন্ত্রীর এপিএস শফিকুর রহমান ১২ থেকে ১৩ হাজার ডাটা এন্ট্রির কথা স্বীকার করেন।
তিনি বলেন, ‘মোয়াল্লেম ফি জমার দেওয়ার আগের দিন মন্ত্রীমহোদয় মিশরে চলে গিয়েছিলেন। তখন একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছিল। সরকারি ১০ হাজারের মধ্যে অপূরণীয় সাত হাজার ডাটা এন্ট্রি হবে। এই সাত হাজার এন্ট্রি হওয়ার আগে আমাদের হজযাত্রী ছিল ৮৮ হাজার। আগের হজ পরিচালক মিজানুর রহমান তখন একটি হিসেব দিলেন, ডাটা এন্ট্রি করেছে কিন্তু মোয়াল্লেম ফি জমা দেয়নি ১২ হাজার। এই নিয়ে এক লাখ ডাটা এন্ট্রি হয়ে যায়।
মন্ত্রীর এপিএস বলেন, মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন- সরকারি সাত হাজার অপূরণীয় আছে সেগুলোরই ডাটা এন্ট্রি করতে হবে। কিন্তু হজ পরিচালক এবং হাবের লোকজন বললেন যেহেতু তারা মোয়াল্লেম ফি দেয়নি, তাই তাদের ডাটা এন্ট্রি বাতিল রাখা হবে। ওই বাতিল রাখার কারণে ১২/১৩ হাজারের মতো ভুয়া ডাটা এন্ট্রি করা হয়েছিল। আমি বুঝেই করি বা না বুঝেই করি দায়িত্ব আমাদের ঘাড়েই পড়ে। আসলে আমি বুঝতে পারিনি।
তবে সিন্ডিকেটের সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিতা নেই দাবি করে তিনি বলেন, তারা যেভাবে বুঝিয়েছেন আমি তাই বুঝেছি। মোয়াল্লেম ফির নামে টাকা দেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই।
এ বছরই ওমরায় ১১ হাজারের ওপরে মানব পাচারের কারণে সৌদি আরব বাংলাদেশের ভিসা বন্ধ করে দেয়। এই ঘটনায় হাব সভাপতি মোহাম্মদ ইব্রাহীম বাহার, মহাসচিব শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, সিনিয়র সহ-সভাপতি হেলাল উদ্দিন, সহ-সভাপতি ফরিদ আহমদ মজুমদারের এজেন্সিসহ ১০৪ এজেন্সির বিরুদ্ধে সরকার একটি কমিটিও গঠন করে।
এই ঘটনার শেষ না হতেই মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানব পাচারের অভিযোগ উঠল।