শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়েছেন ডিএনসিসির ৮ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার মো. আবুল কাশেম মোল্লা (আকাশ)। তার বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলমান / ছবি- ঢাকা পোস্ট
মাদ্রাসার তহবিল লুটপাট এবং শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাঠগড়ায় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আবুল কাশেম মোল্লা (আকাশ)।
মিরপুরের শাহ আলীতে অবস্থিত মসজিদুল আকবর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার সভাপতি তিনি। ২০১৬ সাল থেকে ওই পদে থেকে প্রতিষ্ঠানের হিসাব থেকে প্রায় ৩২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া রাজধানীর মিরপুর-১-এ নিজ ও স্ত্রীর নামে একাধিক বাড়ি, শাহ আলী মার্কেটে একাধিক দোকান এবং পৈত্রিক বাড়ি মুন্সীগঞ্জে বিলাসবহুল বাড়িসহ অঢেল সম্পদ রয়েছে তার।
এসব অভিযোগের সত্যতা খতিয়ে দেখতে এরই মধ্যে মাদ্রাসার সংশ্লিষ্ট নথিপত্র এবং আবুল কাশেমের ব্যক্তিগত নথিপত্র তলব করে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছে দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপপরিচালক মো. আশিকুর রহমান। এরই মধ্যে কিছু নথি দুদকে পৌঁছেছে বলে সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন একটি সূত্রে জানা গেছে।
মসজিদুল আকবর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আবুল কাশেম মাদ্রাসার সরকারি অ্যাকাউন্ট থেকে ৩২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীদের বেতনসহ সকল সরকারি টাকা এবং মাদ্রাসার আয়ের টাকা বাংলাদেশ মাদ্রাসা গেজেটের ৪৫ (৪) ধারায় নগদ আয়কৃত অর্থ ব্যাংকে জমা না দিয়ে সরাসরি সরকারি আইন লঙ্ঘন করেছেন
যদিও আবুল কাশেম ঢাকা পোস্টের কাছে দাবি করেছেন, মাদ্রাসার চিঠি পেলেও দুদক থেকে পাঠানো চিঠি তিনি পাননি। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা এবং এটি মাদ্রাসার চাকরিচ্যুত শিক্ষকসহ একটি মহলের ষড়যন্ত্রের অংশ বলে দাবি করেন আবুল কাশেম মোল্লা।
তিনি বলেন, কাউন্সিলর হওয়ায় আমার সম্পদ বরং কমেছে। আমি কীভাবে ১০০ কোটি টাকার মালিক হলাম? আমার সম্পদের মিথ্যা অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। আমার আয়কর নথিতে ৭০ লাখ টাকার সম্পদ দেখানো আছে। ঢাকায় আমার কোনো বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট নেই। গাড়ি ছিল, সেটাও নির্বাচনের সময় বিক্রি করতে হয়েছে। মাদ্রাসার ব্যাংক হিসাবের বাইরে কোনো লেনদেন করিনি। এ সংক্রান্ত অভিযোগ সম্পূর্ণ ভুয়া।
‘মূলত অভিভাবক পরিষদের সদস্য মাসুম বিল্লাহ ও মাদ্রাসার চাকরিচ্যুত সুপার মুন্সি দেলোয়ার মূল কলকাঠি নাড়ছেন। দুদকের চিঠি আমি পাইনি। তবে, মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল দুদকের চিঠি পেয়েছেন। তিনি নিয়ম অনুযায়ী চিঠির জবাব দেবেন। আমার বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসারও অভিযোগ আনা হয়েছে। যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এটা আমার শত্রুও স্বীকার করবে না! আমার রাজনৈতিক সততা রয়েছে।’
এ বিষয়ে দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, ‘যে কোনো দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান করা দুদকের একটি চলমান প্রক্রিয়া। অনুসন্ধান কর্মকর্তার অনুসন্ধান শেষ হওয়ার পর প্রকৃত সত্য বের হয়ে আসবে।’
দুদকে দাখিল হওয়া অভিযোগে যা বলা হয়েছে
মসজিদুল আকবর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আবুল কাশেম মাদ্রাসার সরকারি অ্যাকাউন্ট থেকে ৩২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীদের বেতনসহ সকল সরকারি টাকা এবং মাদ্রাসার আয়ের টাকা বাংলাদেশ মাদ্রাসা গেজেটের ৪৫ (৪) ধারায় নগদ আয়কৃত অর্থ ব্যাংকে জমা না দিয়ে সরাসরি সরকারি আইন লঙ্ঘন করেছেন। প্রতিষ্ঠানের আয় করা অর্থ ১৯৮৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মাদ্রাসার অগ্রণী ব্যাংক হিসাবে জমা হতো। কিন্তু মসজিদুল আকবর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার বর্তমান সভাপতি ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৮নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. আবুল কাশেম মোল্লা (আকাশ) কারসাজি করে ২০১৬ সাল থেকে মাদ্রাসা আইনের তোয়াক্কা না করে নিজেদের মতো কিছু টাকা অ্যাকাউন্টে জমা করে বাকি লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শাহ আলী থানার সাধারণ সম্পাদকও বটে।
অভিযোগে আরও উল্লেখ আছে, আবুল কাশেম মোল্লা ক্ষমতার অপব্যবহার করে গত ১০ থেকে ১৫ বছরে ১০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়েছেন। যার কোনো বৈধ উৎস নেই। তিনি ১৫ বছর আগেও ফুটপাতে কাঁচামালের ব্যবসা করতেন এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কাউন্সিলর হওয়ার পর তিনি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন
অভিযোগে আরও উল্লেখ আছে, আবুল কাশেম মোল্লা ক্ষমতার অপব্যবহার করে গত ১০ থেকে ১৫ বছরে ১০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়েছেন। যার কোনো বৈধ উৎস নেই। তিনি ১৫ বছর আগেও ফুটপাতে কাঁচামালের ব্যবসা করতেন এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কাউন্সিলর হওয়ার পর তিনি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন।
সম্পদের বিবরণ
আবুল কাশেম মোল্লার অবৈধ সম্পদের মধ্যে রয়েছে- মিরপুরের রাসেল পার্ক সংলগ্ন প্লটে ২০ কোটি টাকা মূল্যের পাঁচ তলা ভবন (মিরপুর-১, ব্লক-ডি, রোড-২, বাসা নং-১৫); প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যের মিরপুর শাহ আলী মার্কেটের নিচ তলায় একটি এক হাজার বর্গফুটের দোকান; কোটি টাকা মূল্যের মিরপুর-১, ব্লক-ডি, প্লট-১১৩ এর পঞ্চম তলায় ১৬০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট; মিরপুর-১-এ স্ত্রীর নামে ১৫ কোটি টাকা মূল্যের বাড়িসহ পাঁচ কাঠার জমি; প্রায় দুই কোটি টাকার মূল্যের মুন্সীগঞ্জ জেলায় নিজ গ্রামের বাড়িতে অত্যাধুনিক একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি।
এ ছাড়া তিনি সরকারি আট থেকে ১০টি প্লট জোর করে দখলে রেখেছেন বলে অভিযোগ আছে। স্থাবর সম্পদ ছাড়াও স্থানীয় কয়েকটি ব্যাংকে তার কোটি কোটি টাকা জমা আছে। তার কারণেই মাদ্রাসার সাবেক শিক্ষক (সুপার) মো. দেলোয়ার হোসেন মুন্সী ও শিক্ষক (শারীরিক শিক্ষক) আবু হানিফ, জুনিয়র শিক্ষক জিয়াউলকে বেতন-ভাতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
দুদকের চিঠিতে যা বলা হয়েছে
মসজিদুল আকবর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার বর্তমান সভাপতি ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৮নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. আবুল কাশেম মোল্লা (আকাশ) ও অন্যান্যরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসার মাধ্যমে ১০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন।
দুদক যেসব নথি তলব করেছে
গত ১ এপ্রিল প্রথম দফায় দুদক থেকে নথি তলব করে চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে মো. আবুল কাশেম মোল্লার (আকাশ) মাদ্রাসার সরকারি টাকা আত্মসাৎ, ক্ষমতার অপব্যবহার করে চাঁদাবাজি এবং মাদক ব্যবসার মাধ্যমে বর্তমানে শত টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। তলব করা রেকর্ডপত্রের মধ্যে রয়েছে- মসজিদুল আকবর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার নামে পরিচালিত ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ব্যাংকের হিসাব-বিবরণী। ওই একই সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত সকল সভার রেজুলেশনসহ আয়-ব্যয়ের বিবরণী এবং বর্তমান পর্যন্ত ম্যানেজিং কমিটির বিস্তারিত তথ্য।
কাউন্সিলর হওয়ায় আমার সম্পদ বরং কমেছে। আমি কীভাবে ১০০ কোটি টাকার মালিক হলাম? আমার সম্পদের মিথ্যা অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। আমার আয়কর নথিতে ৭০ লাখ টাকার সম্পদ দেখানো আছে। ঢাকায় আমার কোনো বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট নেই। গাড়ি ছিল, সেটাও নির্বাচনের সময় বিক্রি করতে হয়েছে। মাদ্রাসার ব্যাংক হিসাবের বাইরে
মাদ্রাসার শিক্ষক মো. দেলোয়ার হোসেন মুন্সি, আবু হানিফ ও জিয়াউল করিমের ব্যক্তিগত নথি এবং নিয়োগের পর থেকে প্রদত্ত বেতন-ভাতা।
ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আবুল কাশেম মোল্লার (আকাশ) ব্যক্তিগত নথি/তথ্যাদি (বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা, এনআইডি, পাসপোর্ট, ব্যাংক হিসাবের তথ্যাদি, নির্বাচনী হলফনামা, হলফনামায় দাখিল করা আয়কর রিটার্নের কপি ও অন্যান্য রেকর্ডপত্র। একইসঙ্গে সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর হিসেবে যোগদানের পর থেকে তার প্রাপ্ত বেতন, সম্মানী বা প্রাপ্ত ভাতাদি বা প্রাপ্ত অন্যান্য সুবিধার বিবরণ।
কাউন্সিলর কাশেম মোল্লার ব্যাখ্যা
দুদকে দাখিল করা অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা পোস্টের কাছে ব্যাখ্যা দিয়েছেন আবুল কাশেম মোল্লা (আকাশ)। তিনি বলেন, মিরপুরের শাহ আলীতে অবস্থিত মসজিদুল আকবর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার সভাপতি মহিবউল্লাহর নেতৃত্বে একটি পরিচালনা পর্ষদ দায়িত্ব পালন করে। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর মুন্সি দেলোয়ার হোসেন নামের একজন সুপারের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ আসে। তাকে বহিষ্কার করা হয়। একই সঙ্গে মাদ্রাসা থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেখানেও দুর্নীতির প্রমাণ মেলে। পরবর্তীতে মাদ্রাসা বোর্ডের সালিশেও ওই বহিষ্কার আদেশ বহাল রাখা হয়। ওই আদেশ চ্যালেঞ্জ করে দেলোয়ার হোসেন হাইকোর্টে রিট করেন। সেখানেও হেরে যান তিনি। এরপর তিনি আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। যা চলমান রয়েছে বলে জানি।
তিনি আরও বলেন, মহিবউল্লাহ পর সভাপতির দায়িত্ব পান শেখ আবদুল মান্নান। তিনি দায়িত্ব পাওয়ার পর দেলোয়ার হোসেনকে আবার সুপার করেন। কোন প্রক্রিয়ায় তাকে পুনর্বহাল করা হয়েছে, সেটা আমি জানি না। দায়িত্ব পাওয়ার পরও তার বিরুদ্ধে আবারও ক্লাস না করাসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। তার রাজনৈতিক একটা পরিচয়ও আছে। তিনি জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের সহ-সভাপতি। তাকে দায়িত্ব দেওয়ার পর সরকারি বেতনসহ সকল আর্থিক সুবিধা দেওয়া হয়। কোন আদেশ এসব দেওয়া হয়েছে, আমার জানা নেই। আমি বোর্ড কিংবা আদালতের আদেশ পাইনি। ওই সময়ে আবু হানিফ নামের একজন শারীরিক শিক্ষকও নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই নিয়োগও যথাযথ ছিল না বলে মনে করছি।
‘পরবর্তীতে এডিসি শিক্ষা বিভাগ থেকে নিয়োগ বাতিল করা হয়। দেলোয়ার হোসেনকেও মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আবদুল মান্নানের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ২০১৬ সাল থেকে আমি সভাপতির দায়িত্বপালন করছি। দায়িত্ব পাওয়ার পর সহকারী শিক্ষক হেলাল উদ্দিনের নিয়োগ নিয়েও জটিলতা দেখা দেয়। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা বিভাগের এডিসির নেতৃত্ব একটি টিম তদন্ত করে এবং হেলাল উদ্দিনের পক্ষে রায় দেন। পরবর্তীতে আদালতে থেকেও হেলাল দায়িত্ব পান। তিনিই পরবর্তীতে ভারপ্রাপ্ত সুপার হিসাবে দায়িত্ব নেন।’
শিক্ষক জিয়াউলের নিয়োগ নিয়েও জটিলতা ছিল। তার নিয়োগও বাতিল হলে জিয়াউল করিম আদালতে মাদ্রাসার আদেশের বিরুদ্ধে মামলা করেন। বর্তমানে তিনি কোনো বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। আমার ওপরে মুন্সি দেলোয়ার ও অভিভাবক সদস্য মাসুম বিল্লাহ ক্রমাগত চাপ দিয়ে আসছেন। আমি যেন দেলোয়ার ও জিয়াউলকে পুনর্বহাল করি। কিন্তু আমি নিয়মের বাইরে যেতে পারব না। আমি তাদের বলেছি, আপনারা আদালতে গেছেন, আদালত থেকে রায় কিংবা শিক্ষা বোর্ড থেকে আদেশ নিয়ে আসেন। তা না হলে আমি নিয়োগ দিতে পারব না। এসব কারণেই আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে মনে করছি— বলেন আবুল কাশেম মোল্লা (আকাশ)।