দেশব্যাপী উদযাপিত হচ্ছে ঈদুল ফিতর। চারিদিকে খুশির সীমা নেই। ঘরে ঘরে নেমন্তন, সেমাই, খুরমার সুঘ্রাণ। আর অলিতে-গলিতে শুভ্র পাঞ্জাবি, টুপিতে লোকে লোকারণ্য। কাঁধে জায়নামাজ, হাতে তসবি। বাহারি রঙের, ঢঙের টুপি। হাসিমুখে কোলাকুলি, করমর্দনের পর একে অপরকে নিজের বাড়িতে টেনে নিচ্ছে। শিশু-কিশোর তরুণ-তরুণী সুসজ্জিত হয়ে ঘুরছে এদিকে সেদিকে, সব বয়সী সবাই মেতেছে ঈদের খুশিতে। এরই মাঝে এক শ্রেণির মানুষ খুশি আড়াল করে এক বুক কষ্ট নিয়ে পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে আজও আয়ের জন্য রাস্তায় নেমেছেন। নিজের আসল খুশি উৎসর্গ করে ঈদের দিনেও করে যাচ্ছেন কাজ।
ঈদের দিনে সকালে ভাত খেয়েই রিকশা নিয়ে (গ্যারেজ থেকে ভাড়া নেওয়া) বেরিয়ে পড়েছেন সামিউল নামের একজন রিকশা চালক। তার গ্রামের বাড়ি শেরপুর, রাজধানীর শাহজাহানপুরের একটি গ্যারেজেই থাকেন তিনি। গ্যারেজের অধিকাংশ রিকশা চালক ঈদে গ্রামের বাড়িতে চলে গেলেও তিনিসহ আর কয়েকজন থেকে গেছেন। তাই ঈদের দিন বাড়তি কিছু আয়ের আশায় বেরিয়ে পড়েছেন রিকশা নিয়ে।
গুলশান বাড্ডা লিংক রোডে কথা হয় সামিউলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ঈদে বাড়ি যাওয়া হয়নি, পরিবারের সঙ্গে ঈদ করা হচ্ছে না, এটাতে কষ্ট লাগে। কিন্তু কিছু করার নেই, পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে নিজের ঈদের আনন্দ না হয় নাই করলাম। রমজান মাসে রিকশা চালিয়ে যে টাকা আয় হয়েছে সেটা বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। ছেলে, মেয়ে, বউ, মা, বাবা জামা কাপড় কিনেছে, ঈদের জন্য বাজার করেছে। বাড়িতে আজ রান্না হয়েছে। তারা আমাকে বারবার যেতে বললেও যাওয়া হয়নি। কারণ রমজান মাসের যা আয় তা সব বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি, নিজের মেসের থাকা খাওয়ার খরচ দিয়েছি। এখন হাত শূন্য, চলতি মাস তো চলতে হবে তাই আজ ঈদের দিনেও কিছুটা বেশি আয়ের আশায় রিকশা নিয়ে বের হয়েছি। ঈদের দুই-তিন দিন রিকশা চালাবো এরপর বাড়িতে যাব।
ঈদের দিন সবাই আনন্দ করছে, আপনি রিকশা চালাচ্ছেন-খারাপ লাগে না? এমন প্রশ্নের উত্তরে সামিউল বলেন, খারাপ লাগা তো আছেই। কিন্তু কি আর করার, জীবন জীবিকার কারণে এসব খারাপ লাগা আমাদের মেনে নিতে হয়। পরিবারও জানে যে আমি যাইনি আয়ের জন্য।
গুলশান সংলগ্ন ওয়াটার ট্যাক্সি ঘাটে কাঁচা আম, পেয়ারা মাখানো বিক্রি করছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লিয়াকত আলী। তিনি কড়াইল বস্তিতে থাকেন, ঈদে পরিবারের অন্য সদস্যদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেও তিনি ঢাকাতেই থেকে গেছেন। ঈদের দিনে কাঁচা আম, পেয়ারা মাখানো বিক্রি করতে বেরিয়ে পড়েছেন একটু বাড়তি আয়ের আশায়।
ঈদের দিন নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করে তিনি বলেন, এই দিনে পরিবারের সঙ্গে না থেকে ঘুরে ঘুরে এসব বিক্রি করতে খারাপ লাগলেও সংসারের কথা বিবেচনা করে তা আমাকে করতে হচ্ছে। পুরো রমজান মাস আমার ব্যবসা খুবই খারাপ অবস্থার মধ্যে গেছে, কারণ রমজান মাসে এসব কেউ খায় না। যে কারণে আয় রোজগার কম হয়েছে, পরিবারের সদস্যদের অল্প কিছু টাকা দিয়ে ঈদ করতে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমি যেতে পারিনি, কারণ চলতি মাস চলতে হলে তো টাকা লাগবে। ঈদের দিন যেহেতু সবাই ঘোরাফেরা করে তাই আমার একটু বাড়তি আয় হবে বলে আশা করছি।
তিনি আরো বলেন, সবাইকে দেখছি পরিবার, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরছে, এ বাড়ি ওবাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু আমি কাজ করছি এটা আসলেই কষ্ট লাগার। কিন্তু নিজের কষ্ট মেনে নিয়ে পরিবার নিয়ে যেন ভালোভাবে চলতে পারি সে কারণেই আজ কাজে এসেছি। নিজের কষ্টের কথা পরিবারকেও বুঝতে দেই না। মানুষের খুশি আনন্দ দেখেই আর নিজের এসব জিনিস বিক্রি করেই ঈদের দিন কেটে যাচ্ছে আমার।
মহাখালীর রাস্তায় ছোট্ট পান সিগারেটের ভ্রাম্যমাণ দোকান খুলে বসে আছেন আক্কাস আলী নামের একজন। আলাপকালে তিনি বলেন, ঈদের দিন তবুও দোকান খুলে বসা বিষয়টা খারাপ লাগার। কিন্তু কিছুই করার নেই, পরিবারের সদস্যরা ঈদ করলেও জীবিকার তাগিদে আমাকে দোকান খুলে বসতে হয়েছে। আয় না হলে খাব কী? ঈদের খরচ তো আছেই। সেই সঙ্গে যদি আজ দোকান না খুলি তাহলে পরের দিন কী খাব? সে কারণেই অন্যরা ঈদের আনন্দ করলেও আমাকে দোকান খুলতে হয়েছে। পরিবারের যখন আয় করার মানুষ একজনই থাকে, তার ওপরে থাকে অনেক বড় দায়িত্ব। আর সেই দায়িত্ব পালন করতেই আমার ঈদের আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখতে হয়েছে। আমি আয় করলে, নিজে যেমন চলতে পারব, পরিবারকেও চালাতে পারবো। তাইতো ঈদের দিন দোকান খুলেছি বাড়তি কিছু আয়ের আশায়।