টানা চতুর্থ মেয়াদে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে প্রথম উচ্চ পর্যায়ের সফর ছিল ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগেল ওয়াংচুকের। এ সফরে রাজার সম্মানে দেশটিকে বেশ কিছু উপহার দিয়ে বাংলাদেশ তার কূটনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করার চেষ্টা করেছে। ‘বাংলাদেশ শুধু নেয় না, দেয়ও’– এমন বার্তা দিয়ে নিজেদের সক্ষমতার জানান দিয়েছে ঢাকা।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম দেশ ভুটানের রাজাকে জাতীয় দিবসের মেহমান করে ঢাকায় আনা হয়। দেওয়া হয় নানা উপহারও। সেগুলো মধ্যে রয়েছে– বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজে বৃত্তিতে পড়ার সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা রাজার সম্মানে ২২ থেকে বাড়িয়ে ৩০-এ উন্নীত করা হয়েছে। বাংলাদেশের ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমি ভুটানে একটি ডিপ্লোমেটিক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট খোলার জন্য সহায়তা প্রদান করবে এবং ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে কূটনৈতিক প্রশিক্ষণের জন্য দুটি আসন ভুটানের কূটনীতিকদের জন্য বরাদ্দ রাখা হবে।
এ ছাড়া কৃষি খাতে সহযোগিতার অংশ হিসেবে ৭ থেকে ১০ জন ভুটানের কর্মকর্তাকে কৃষি গবেষণা কাউন্সিলে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। সরকারের সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশে তৈরি কিছু ট্যাব ও ল্যাপটপ উপহার দেওয়া হয়েছে ভুটানকে।
ভুটানের রাজাকে ঢাকায় এনে এত উপহার দেওয়ার বিনিময়ে কী পেল বাংলাদেশ, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে ঢাকা পোস্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের শরণাপন্ন হয়।
জবাবে কূটনীতিকরা বলছেন, বাংলাদেশ সবসময় গ্রহণ করার প্রান্তে থাকত। এই প্রথম আমরা একজন বড় অতিথিকে ডেকে উপহার দিয়েছি। এটার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার সক্ষমতাকে স্থাপন করার সুযোগ পেয়েছে। এখন আমরা বলতে পারি, আমরা শুধু নিচ্ছি না, দিচ্ছিও। এই দেওয়ার মাধ্যমে আমরা জানান দিতে চেয়েছি, আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নিজেদের সক্ষমতা স্থাপন করার চেষ্টা করছে।
মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে যেমন- ভারত, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ঋণ পাই, বৃত্তি পাই। কিন্তু সেই অর্থে আমরা তো কাউকে কিছু দিচ্ছি না। এবার প্রথম একটি দেশের রাজাকে ডেকে আমরা অফার করলাম। দেশটির শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিলাম, তাদের আমলাদের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ট্যাব ও ল্যাপটপ উপহার দিলাম, কৃষিক্ষেত্রে সহযোগিতা করলাম, কূটনীতিকদের প্রশিক্ষণ দেব বাংলাদেশে। এতে কি বোঝা গেল, আমরা প্রতিবেশী দেশের সক্ষমতা বাড়াতে অবদান রাখছি। আমরাও আমাদের প্রতিবেশীকে দিতে পারি।
এ কূটনীতিক বলেন, কুড়িগ্রামে যদি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হয় তখন অপেক্ষাকৃত কম অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞের উত্তরাঞ্চল নতুন একটা দিগন্ত তৈরি করবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলটি ভুটানের গেলেফু শহর থেকে মাত্র ১৯০ কিলোমিটার দূরে। এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে এবং দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বৃহত্তর সমৃদ্ধি বয়ে আনবে। তারপর আমরা ভুটানে বার্ন ইউনিট করে দেব। আমরা এখন অবধি এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নিয়েছি? একটি দেশের সক্ষমতা তৈরি করতে আমরা সহায়তা করছি। এগুলোর কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থাকবে। যখন বিদেশের মাটিতে আমরা একটা কিছু তৈরি করে দেব, ওই দেশে কিন্তু আমাদের একটা গুড উইল তৈরি হবে।
সম্প্রতি ঢাকা সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন রাজা জিগমে খেসার। বৈঠকের পর দুই শীর্ষ নেতার উপস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে তিনটি সমঝোতা চুক্তি ও একটি নবায়ন চুক্তি সই করা হয়েছে। চুক্তিগুলো হলো— থিম্পুতে একটি বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট প্রতিষ্ঠা করবে বাংলাদেশ এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সহযোগিতা দেবে। দ্বিতীয়টি হলো– কুড়িগ্রামে ভুটানের ব্যবসায়ীদের জন্য একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা। তৃতীয়টি হচ্ছে– বাংলাদেশে ডিরেক্টরেট অব ন্যাশনাল কনজুমারস রাইটস প্রটেকশন এবং ভুটানের কম্পিটিশন অ্যান্ড কনজুমারস অ্যাফেয়ার্স অথরিটির মধ্যে সমঝোতা চুক্তি। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ভুটানের রাজার সফরে আমরা অনেক কিছু দিলাম। তাহলে আমরা পাব কী– এটার জবাবে আমি বলতে চাই, আমরা প্রমাণ করার চেষ্টা করছি; আমরা শুধু নিচ্ছি, দিচ্ছি না- এমনটা নয়। আমরাও দিতে পারি। আগে আমরা সবসময় রিসিভিং প্রান্তে থাকতাম। কিন্তু এখন আমরা অফার করেছি। এই যে আমরা এত কিছু দিলাম এটার মানে হলো, আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে আমাদের সক্ষমতাকে স্থাপন করার চেষ্টা করছি। শুধু ভুটান নয়, নেপাল, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কারও কিন্তু আমাদের সার্ভিস সেক্টরের প্রতি আগ্রহ আছে। সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে আমরা প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে কূটনীতির মাধ্যমে আমাদের সার্ভিস সেক্টরগুলোকে স্থাপন করতে পারব।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ভুটান বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দেওয়া দেশ। ভুটানের সঙ্গে আমাদের খুব ভালো সম্পর্ক। ভালো সম্পর্কের কারণে কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা দিবসকে সামনে রেখে তিনি ঢাকায় এসেছেন। এ সফরে কানেক্টিভিটি, ব্যবসা-বাণিজ্য যেমন গুরুত্ব পেয়েছে তেমনি আমরা রাজাকে বেশ কিছু উপহার দিয়ে সম্মানিত করেছি। এতে বোঝা যায় যে বাংলাদেশ প্রতিবেশীর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করে এবং গুরুত্ব দেয়।
রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের আমন্ত্রণে গত ২৫ থেকে ২৮ মার্চ বাংলাদেশ সফর করেছেন ভুটানের রাজা।