গাজীপুর: ১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ দুপুরে হঠাৎ এক বেতার ভাষণে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেন। এ কথা শোনামাত্রই সারা দেশের মানুষ স্বতঃফূর্তভাবে প্রতিবাদ মুখর হয়ে এ ঘোষণার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে। দেশের সর্বত্রই স্লোগান উঠে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা’, ‘পাঞ্জাব না বাংলা,বাংলা-বাংলা’, ‘তোমার আমার ঠিকানা ,পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি-বাঙালি’। এরপর ১৯ মার্চ, মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ হয় গাজীপুরে।
১৯৭১ সালের এই দিনে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে জয়দেবপুরের সংগ্রামী জনতা পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু করেছিলেন। এই বীরত্বকে অমর করে রাখতে ১৯৭২-১৯৭৩ সালে গাজীপুরের চৌরাস্তায় একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ নামের এই ভাস্কর্য মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ভাস্কর্য। দিবসটি পালন উপলক্ষে আজ গাজীপুর সহ সারা জেলায় বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
সেই দিনের ঘটনা প্রসঙ্গে গাজীপুর সর্বদলীয় সংগ্রাাম পরিষদের আহবায়ক ও বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এক নিবন্ধে বলেন, ১৭ মার্চ ১৯৭১ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম দিনে লাখ লাখ জনতার ঢল নেমেছিল ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে। এসময় কুর্মিটোলা (ঢাকা) ক্যান্টনমেন্টে অস্ত্রের মজুদ কমে গেছে অজুহাতে জয়দেবপুরে ২য় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করে ২য় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে রক্ষিত অস্ত্র আনার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্রের সংবাদ বঙ্গবন্ধুকে জানাই। এ অবস্থায় আমাদের কি করণীয় জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তুই একটা আহম্মক, কি শিখিছিস যে আমাকে বলে দিতে হবে’। একটু পায়চারী করে রাগতস্বরে বললেন ‘বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে দেয়া যাবে না। নেতার হুকুম পেয়ে গেলাম।
নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ১৯শে মার্চ আকস্মিকভাবে পাকিস্তান বিগ্রেডিয়ার জাহান জেবের নেতৃত্বে পাকিস্তানি রেজিমেন্ট জয়বেদপুরস্থ (গাজীপুর) ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার জন্য পৌঁছে যায়। তখন বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিক জনতা চারিদিক থেকে লাঠিসোটা, দা, কাতরা, ছেন, দোনালা বন্দুকসহ জয়দেবপুর উপস্থিত হয়। এসময়ই সংঘটিত হয় প্রথম স্বশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। এই যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে জয়দেবপুরে শহীদ হন নেয়ামত ও মনু খলিফা। আহত হন চতরের সন্তোষ, ডাঃ ইউসুফসহ শত শত বীর জনতা। পাক বাহিনী কার্ফু জারি করে এলোপাথারি গুলিবর্ষণ শুরু করলে আমাদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। আমরা পিছু হটলে দীর্ঘ সময় চেষ্টা করে ব্যারিকেড পরিস্কার করে ব্রিগেডিয়ার জাহান জেব চান্দনা চৌরাস্তায় এসে আবার প্রবল বাধার সম্মুখীন হন। নামকরা ফুটবল খেলোয়াড় হুরমত এক পাঞ্জবী সৈন্যেকে পেছন দিয়ে আক্রমণ করেন। আমরা সৈন্যের রাইফেল কেড়ে নেই। কিন্ত পেছনে আরেক পাঞ্জাবী সৈন্য হুরমতের মাথায় গুলি করলে হুরমত সেখানেই শাহাদাৎ বরণ করেন। বর্তমানে সেই স্থানে চৌরাস্তার মোড়ে ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ নামে ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে।
১৯শে মার্চের পর সারা বাংলাদেশে স্লোগান উঠে, ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু কর’। ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ প্রথম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গাজীপুরবাসীর উদ্দেশ্যে এক পত্রে ১৯ মার্চের সশস্ত্র প্রতিরোধের সময় শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং জয়দেবপুরবাসীকে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।
এই দিনের কথা উল্লেখ করে মোজাম্মেল হক লিখেছেন,জয়দেবপুরে (আজকের গাজীপুর ) আমার পরামর্শে ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ রাতে তৎকালীন থানা পশু পালন কর্মকর্তা আহম্মেদ ফজলুর রহমানের সরকারি বাসায় তৎকালীন মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব মোঃ হাবিব উল্ল্যাহ এক সর্বদলীয় সভা আহ্বান করেন। সভায় আমাকে (আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক) আহ্বায়ক করে এবং মেশিন টুলস্ ফ্যাক্টরির শ্রমিক নেতা জনাব নজরুল ইসলাম খানকে কোষাধ্যক্ষ করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট এক সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সদস্য হন সর্বজনাব আয়েশ উদ্দিন, মোঃ নুরুল ইসলাম (ভাওয়াল রতœ), মোঃ আঃ ছাত্তার মিয়া (চৌরাস্তা), থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মরহুম হজরত আলী মাস্টার (চৌরাস্তা), মোঃ শহীদ উল্ল্যাহ বাচ্চু (মরহুম), হারুন-অর-রশিদ ভূঁইয়া (মরহুম), শহিদুল ইসলাম পাঠান জিন্নাহ (মরহুম), শেখ আবুল হোসেন (শ্রমিক লীগ), থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ডাঃ সাঈদ বকস্ ভূঁইয়া (মরহুম)। কমিটির হাই কমান্ড (উপদেষ্টা) হন জনাব মোঃ হাবিব উল্ল্যাহ (মরহুম), শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা এম. এ. মুত্তালিব এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নেতা বাবু মনিন্দ্রনাথ গোস্বামী (স্বর্গীয়)।
২০২৩ সালের ১৯ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী তার প্রবন্ধের শেষে লিখেছেন, ১৯শে মার্চের সশস্ত্র যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক মাইল ফলক। জয়দেবপুরের গৌরবগাঁথা ঊনিশে মার্চ প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ দিবস হিসেবে জাতীয়ভাবে উদযাপন করার দাবিতে গাজীপুরের সর্বস্তরের জনতা আবেদন জানিয়ে আসছে। ঊনিশে মার্চকে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ দিবস হিসেবে দেশব্যাপী জাতীয়ভাবে পালিত হলে, মুক্তিযুদ্ধের সূচনার ইতিহাস যথাযথভাবে সংরক্ষিত হবে বলে আমি মনে করি। ফলে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও ১৯শে মার্চের সশস্ত্র যুদ্ধ এখনো জাতীয়করণ হয়নি।