রোজার আগেই নিয়ন্ত্রণহীন নিত্যপণ্যের দাম, বাজারে চাপা ক্ষোভ

Slider অর্থ ও বাণিজ্য

দরজায় কড়া নাড়ছে পবিত্র মাহে রমজান। মাসটিকে ঘিরে প্রত্যেক পরিবারেই পুরোদমে চলছে প্রস্তুতি। তবে সাধারণ মানুষের এই প্রস্তুতিকে পুঁজি করে ছোলা, ডাল, চিনিসহ রোজায় ব্যবহৃত প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বিক্রেতারা। যদিও দফায় দফায় সরকারের ঘোষণা ছিল রোজায় নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো পণ্যের দাম বাড়বে না। কিন্তু এসব ঘোষণার কোনো প্রতিফলন বাজারে দেখা যায়নি। বরাবরের মতো এবারও রোজার আগেই বাজারে সক্রিয় হয়েছে অতি মুনাফালোভী চক্র।

রোজা সামনে রেখে আগেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার করে রাখেন মানুষ। বিশেষ করে রমজান মাসের শুরুতে খেজুর, চাল, ডাল, ছোলা, বেসন, চিনি ও পেঁয়াজের ওপর একটু বেশি চাপ পড়ে। রোজা শুরুর এক সপ্তাহ আগে থেকেই বাজার ঘুরে শুরু হয় কেনাকাটা। ক্রেতাদের পূর্ব প্রস্তুতিতে প্রতিবারের মতো এবারও দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বিক্রেতারা।

সরকারের বেঁধে দেওয়া দেশি পেঁয়াজের খুচরা মূল্য প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ৬৫ টাকা হলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকায়। সম্প্রতি ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির খবরে দাম কমতে শুরু করে। এক সপ্তাহ আগে যে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১১০-১২০ টাকা কেজিতে, গত দুদিন সেই পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৮০-৮৫ টাকায়। তবে রোজার আগ মুহূর্তে আজ (শুক্রবার) থেকে আবারও দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকায়।

বিক্রেতারা বলছেন, গতকাল (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত দেশি পেঁয়াজ ৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি করলেও আজ ৯০ টাকা করে বিক্রি করতে হচ্ছে। এই দামে বিক্রি করলেও কোনো লাভ থাকছে না।

রবিউল আলম নামে এক বিক্রেতা বলেন, বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ কম। কারণ মুড়িকাটা পেঁয়াজ একেবারে শেষ দিকে। এ কারণে বাড়তি দাম যাচ্ছিল পেঁয়াজের। প্রধান জাতের পেঁয়াজ অর্থাৎ হালিকাটা পেঁয়াজ বাজারে পর্যাপ্ত এলেই দাম কমে যেত। এর মধ্যে ভারত থেকে পেঁয়াজ আসার খবরে এখনই দাম কমতে শুরু করেছে। আশা করছি ৪-৫ রোজা থেকেই পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি আরও ১০-১৫ টাকা কমে যাবে।

জানা গেছে, দেশে বছরে চিনির চাহিদা ২০ লাখ টন। স্বাভাবিক সময়ে মাসে চাহিদা থাকে দেড় লাখ টন। আর রমজানে চাহিদা ৩ লাখ টন। চট্টগ্রাম কাস্টমস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত আট মাসে (২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) দেশে চিনি আমদানি হয়েছে ১৪ লাখ ১৮ হাজার ৬৩০ টন। আর রোজা ঘিরে শেষ তিন মাসে আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৬০২ টন। এর বাইরে খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে আরও প্রচুর চিনি। তারপরও বাজারে বেড়ে চলেছে পণ্যটির দাম।

এদিকে রমজান মাসকে সামনে রেখে সরকার চিনির আমদানি শুল্ক কমিয়েছে। তবে বাজারে এর কোনো প্রভাব নেই, উল্টো দাম বাড়ার প্রবণতা দেখা গেছে। এর ওপর নতুন করে একটি সুগার মিলের অগ্নিকাণ্ডকে পুঁজি করে বাজারে চিনির কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহ আগেও যেখানে খোলা চিনি কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা পর্যন্ত, সেখানে রোজার আগ মুহূর্তে কেজিপ্রতি চিনির দাম উঠেছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা।

মধ্যবাড্ডা এলাকার রহমতুল্লাহ নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, চিনির দাম পাইকারিতে কিছুটা বেড়েছে। আমাদের যদি বেশি দামে কিনে আনতে হয়, দাম বাড়ানো ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। তবে বাজারে সরবরাহের যেহেতু বড় সংকট নেই, তাই দাম আর বাড়ার আশঙ্কা কম।

রমজান মাসকে ঘিরে অন্যান্য দ্রব্যের ন্যায় লাগামহীন দামের আঁচ পড়ছে ডাল, ছোলা আর বেসনের দামে। ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, গত কয়েকদিনে ডালের দাম কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। একই হারে বেড়েছে বেসনের দাম। ভালো মানের ছোলার দামও নতুন করে কেজিতে ২ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে ছোলার দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে এখন ১০০ টাকা থেকে ১১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বুটের ডালের দামও কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে এখন ১০০ টাকা। কয়েকদিন আগেও ১২০-১৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়া ছোট দানার মসুর ডালের দাম বেড়ে হয়েছে ১৪০-১৪৫ টাকা। মাঝারি দানার মসুর ডালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৩০ টাকায়, যা কিছুদিন আগেও ছিল ১১০-১১৫ টাকা কেজি।

এদিকে ডালের দাম বাড়ায় বেড়েছে বেসনের দামও। বুটের ডালের বেসন বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়, যা কিছুদিন আগে ছিল ১০০ থেকে ১১০ টাকার মধ্যে। আর অ্যাংকর ডালের বেসন বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা কেজিতে, যা কিছুদিন আগে ছিল ৭০ টাকার মধ্যে।

শুল্কমুক্ত ছোলা আমদানি, সুফল পাচ্ছে না ভোক্তারা

রমজানের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় দ্রব্য ছোলা। রমজান উপলক্ষ্যে ভারত থেকে এক সপ্তাহে ১ হাজার ৪০৩ টন ছোলা আমদানি করা হয়েছে। সরকার ব্যবসায়ীদের শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচা ছোলা আমদানির সুযোগ দিলেও তার সুফল পাচ্ছেন না ক্রেতারা।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ছোলা বিক্রি হচ্ছে ১০৫ থেকে ১১০ টাকা কেজি দরে। গত বছর বাজারে এ সময় ছোলার কেজি ছিল ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। সেই হিসাবে এবার কেজিতে দাম বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের দাম বেশি হওয়ায় ছোলা আমদানি করতে হয়েছে বেশি দামে। যে কারণে দামও তুলনামূলক একটু বেশি। তবে রোজা শুরু হলেই আবার দাম কমে আসবে।

বাড়তি দামে কিনতে বাধ্য হলেও আছে চাপা ক্ষোভ

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রমজান মাসকে ঘিরে প্রতিটি পণ্যে বাড়তি দাম থাকলেও প্রত্যেকেই চাহিদা মতো কেনাকাটা করছেন। তবে দাম প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলেই ক্রেতাদের মধ্যে দেখা গেছে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ। ভোক্তাদের ভাষ্য, বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যে কারণে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জনগণের পকেট কাটছে। সরকার খুচরা পর্যায়ে লোক দেখানো কিছু অভিযান পরিচালনা করলেও সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে রাঘব-বোয়ালরা।

রামপুরা কাঁচা বাজারে বাজার করতে আসা শামীম আহমেদ নামে এক ক্রেতা বলেন, রোজার আগমুহূর্তে আজ শেষ শুক্রবার। ছুটির দিন হওয়ায় এসেছিলাম রোজার মাসের বাজার করতে। কিন্তু প্রতিটি পণ্যেরই আজ বাড়তি দাম। গতকাল এবং পরশু ভারতের পেঁয়াজ কিনেছে ৮০ টাকা কেজি, আজ বাজারে এসে দেখি ৯০ টাকা। চিনি-ডালের দামও বাড়তি মনে হয়েছে।

তিনি বলেন, অন্য মুসলিম দেশগুলোতে প্রতিবছর শুনি রোজার মাস আসলে প্রত্যেকটা জিনিসেরই দাম কমিয়ে দেওয়া হয়। আর আমার দেশে যে যত পারে বাড়তি দামে বিক্রি করে। দেশের প্রধানমন্ত্রী যেখানে বারবার বলছেন রোজা উপলক্ষ্যে কোনো জিনিসের দাম বাড়বে না, সেখানে একটা জিনিসও হয়ত বাকি নেই, যার দাম বাড়েনি।

আমিরুল ইসলাম নামে আরেক ক্রেতা বলেন, রোজার আর বাকি হাতেগোনা কয়েকদিন। সবাই এখন রোজার কেনাকাটা করছেন। আমাদের ধারণা সামনে দাম আরও বাড়বে। বাজার নিয়ন্ত্রণে জরুরিভিত্তিতে বাজারগুলোতে ভোক্তা অধিদপ্তরসহ সরকারের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোর মনিটরিং বাড়ানো উচিত।

বাড়তি দামে ক্রেতাদেরও দায় দেখছেন ক্যাব সভাপতি

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, প্রতিবছরই রোজার শুরুতে আমরা এ চিত্র দেখি। রোজার মাসে মানুষ সাধারণত যেসব পণ্য বেশি ব্যবহার করে, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সেগুলোর দাম এক সপ্তাহ আগে থেকেই বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এটা যেন আমাদের সমাজে একটা সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, বাড়তি দামের পেছনে সাধারণ মানুষেরও অনেকটা দায় আছে। প্রত্যেকটা পরিবারেই দেখবেন রোজা আগ মুহূর্তে অন্তত এক সপ্তাহ-দশ দিনের বাজার কিনে জমিয়ে রাখা হয়। যে কারণে ওই সময়টাতে বাজারে পণ্যের চাহিদা অনেকগুণ বেড়ে যায়। আর এ সুযোগটা গ্রহণ করে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা।

ক্যাব সভাপতি বলেন, রোজার আগ মুহূর্তে যদিও জিনিসপত্রের দাম বেশি, দেখবেন দশম রোজা থেকেই আবার সবকিছুর দাম স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এজন্য আমি মনে করি সরকারের মনিটরিং বাড়াতে হবে। এ ছাড়া সাধারণ মানুষকেও আর একটু সচেতন হতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *