যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত ইসরাইলি দূতাবাসের সামনে এক ব্যক্তি নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
রোববার স্থানীয় সময় বেলা ১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
খবর পেয়ে উদ্ধারকর্মীরা দ্রুত ঘটনাস্থলে যান এবং তার গায়ের আগুন নেভান।
যুক্তরাষ্ট্রের এয়ার ফোর্সের একজন মুখপাত্রকে উদ্বৃত করে দেশটির গণমাধ্যম বলছে, ওই ব্যক্তি বিমান বাহিনীর একজন কর্মরত সদস্য।
হাসপাতালে নেয়ার আগে উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছে যে আগুনে ওই ব্যক্তির শরীরের অনেকটাই পুড়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বিবিসির পার্টনার প্রতিষ্ঠান সিবিএস নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগুন দেয়া ঘটনাটি একটি চ্যানেলে লাইভ প্রচার করেছিলেন ওই ব্যক্তি। সেখানে তিনি নিজেকে মার্কিন বিমান বাহিনীর একজন সক্রিয় কর্মী হিসাবে পরিচয় দেন।
এরপর তাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি আর কোনো গণহত্যার অপরাধে অংশ নিতে চাই না’ এবং তিনি এর প্রতিবাদে একটি কাজ করতে যাচ্ছেন। গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়ার পর ‘ফিলিস্তিন স্বাধীন করো’ বলতে থাকেন তিনি।
এর কিছুক্ষণ পরে অবশ্য ওই ভিডিও চ্যানেল থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। তবে সিবিএস নিউজের কাছে এর একটি কপি রয়েছে।
ওয়াশিংটন পুলিশ জানিয়েছে যে ওই ব্যক্তির উদ্দেশ্য ঠিক কী ছিল, সেটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইলি কূটনৈতিক মিশনের সামনে এ ধরনের আত্মহত্যার চেষ্টা এবারই প্রথম নয়।
এর আগে গত ডিসেম্বরে আটলান্টায় ইসরাইলি কনস্যুলেটের সামনে আরেকজন ব্যক্তি গায়ে পেট্রোল ঢেলে তাতে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন।
এদিকে এক বিবৃতিতে ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে যে আত্মহত্যার চেষ্টা করা ওই ব্যক্তির সাথে দূতাবাসের কোনো কর্মীর পরিচয় বা সম্পর্ক নেই।
ঘটনার সময় দূতাবাসের কাছেই একটি গাড়ি রাখা ছিল। গাড়িটিতে বোমা থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছিল।
পরে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে গাড়িটিতে তল্লাশি চালায়। যদিও গাড়িতে বিপজ্জনক কোনোকিছুই পাওয়া যায়নি।
ইসরাইলি দূতাবাসের একজন মুখপাত্র মার্কিন গণমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসকে নিশ্চিত করেছে যে এ ঘটনায় তাদের কোনো কর্মী আহত হয়নি।
তবে ঘটনার পর দূতাবাস এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
আগেও ঘটেছে
গাজা-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গত ডিসেম্বরেও যুক্তরাষ্ট্রে একই রকম ঘটনা ঘটেছিল।
তখন ফিলিস্তিনি সমর্থক এক ব্যক্তি জর্জিয়া রাজ্যের ইসরাইলি কনস্যুলেটের সামনে গায়ে পেট্রোল ঢেলে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। তখন তাকেও গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল।
ওই ঘটনাকে ‘রাজনৈতিক প্রতিবাদের উগ্রবাদী পদক্ষেপ’ বলে অভিহিত করেছিল পুলিশ।
ঘটনার পর পুলিশ জানিয়েছিল যে আত্মহত্যার চেষ্টাকারী ওই ব্যক্তির পাশেই একটি পেট্রোলের বোতল এবং একটি ফিলিস্তিনি পতাকা পাওয়া গেছে।
আগুন দেয়ার পর ওই ব্যক্তিকে বাঁচাতে গিয়ে একজন নিরাপত্তারক্ষীও আহত হয়েছিলেন। পরে দু’জনকেই হাসপাতালে নেয়া হয়।
আটলান্টার পুলিশ প্রধান ড্যারিন শিয়েরবাউম তখন বলেছিলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, এটি একটি রাজনৈতিক প্রতিবাদ ছিল। দূতাবাস ভবন নিরাপদ রয়েছে এবং আমরা এখানে কোনো হুমকি দেখছি না।’
অন্যদিকে, ঘটনা জানতে পেরে দুঃখপ্রকাশ করেন দক্ষিণ-পূর্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইলের কনসাল জেনারেল আনত সুলতান-দাদন।
‘এটা দুঃখজনক যে ইসরাইলের প্রতি ঘৃণা এবং উস্কানি এমন ভয়ঙ্করভাবে প্রকাশ করা হয়েছে,’ বলেছিলেন তিনি।
গত ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরাইলে হামাসের হামলার পর গাজায় অভিযান শুরু করে তারা।
হামাসের হামলায় ১২’শ ব্যক্তি নিহত হয়। বন্দী করা হয় ২৪০ জনকে।
পরবর্তীতে গাজায় ইসরাইলি সামরিক অভিযানে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
গাজার মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক, এক মিলিয়নেরও বেশি বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়েছে রাফাহ শহরে। মিসর সীমান্তবর্তী এই শহরে এর আগে বাস করতো মাত্র দুই লাখ ৫০ হাজার মানুষ।
বাস্তুচ্যুতদের মধ্যে অনেকেই অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে বা তাঁবুতে বসবাস করছে। আশ্রয় শিবিরের ভয়াবহ পানি ও খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভেটো
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির একটি প্রস্তাবে সম্প্রতি ভেটো দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
এ ঘটনায় দেশটিতে বসবাসকারী ফিলিস্তিনি সমর্থকরা ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন বলে জানা যাচ্ছে।
গত মঙ্গলবার নিরাপত্তা পরিষদে ওই খসড়া প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটি হয়েছিল।
তখন ওয়াশিংটন বলেছিল যে আলজেরিয়া প্রস্তাবিত রেজ্যুলেশন যুদ্ধ বন্ধের আলোচনাকে ঝুঁকিতে ফেলবে। তবে এই পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে অনেকেই। মার্কিন মিত্ররা যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে হোয়াইট হাউজের ভেটো দেয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র তার নিজস্ব রেজ্যুলেশনে রাফাহ শহরে আগ্রাসন না করার জন্য এর আগে ইসরাইলকে সতর্কও করেছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর আগে জাতিসঙ্ঘের যুদ্ধের বিষয়ে ভোটের সময় ‘যুদ্ধবিরতি’ শব্দটি এড়িয়ে গেছে। তবে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সাম্প্রতিক এই ইস্যুতে প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেছেন।
পরিষদের ১৫ সদস্য দেশের মধ্যে ১৩টিই আলজেরিয়ার প্রস্তাবিত এই খসড়া প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। ভোটদানে বিরত ছিল আরেক স্থায়ী সদস্য যুক্তরাজ্য।
নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য পাঁচটি। এর মধ্যে রাশিয়া, ফ্রান্স ও চীন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে।
স্থায়ী সদস্য দেশগুলোর এককভাবে কোনো প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করে তা বাতিলের ক্ষমতা রয়েছে।
যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে নতুন খসড়া প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর অর্থ হলো প্রস্তাবটি গৃহীত হবে না।
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খসড়া রেজুলেশনে ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব’ একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হয়েছে।
যেখানে ইসরাইলি বন্দীদের মুক্তি ও গাজায় ত্রাণ পৌঁছানোর বাধাগুলো তুলে নেয়ার আহবান জানানো হয়।
তবে, ওয়াশিংটনের এই প্রস্তাবে নিরাপত্তা পরিষদে ভোট দিবে কি না সেটি এখনো স্পষ্ট নয়।
আলজেরিয়ার যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেয়ার পর জাতিসঙ্ঘে উত্তর আফ্রিকা দেশগুলোর প্রতিনিধি বলেছিলেন, ‘এটি ফিলিস্তিনিদের কাছে একটি শক্তিশালী বার্তা পাঠাবে’ এবং এই সাক্ষ্য দেবে, ‘দুর্ভাগ্যবশত নিরাপত্তা পরিষদ আবারো ব্যর্থ হয়েছে’।
‘নিজের বিবেককে জিজ্ঞাসা করুন, ইতিহাস আপনাকে কিভাবে বিচার করবে’, বলছিলেন অমর বেন্দজামা।
জাতিসঙ্ঘে ফিলিস্তিনি প্রতিনিধি রিয়াদ মনসুর বলেছেন, ‘মার্কিন ভেটো ছিল একদম বেপরোয়া ও বিপজ্জনক’।
ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররাও এর সমালোচনা করেছেন।
ফ্রান্সের প্রতিনিধি নিকোলাস ডি রিভেরি গাজার এমন দুদর্শাগ্রস্ত পরিস্থিতিতে প্রস্তাবটি পাশ না হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
তবে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘আমরা লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের ওপর এমন কোনো চাপ নেই যা আমাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করাতে পারবে।’
ইসরাইল নিরাপত্তা পরিষদের যেকোনো রেজুলেশন মেনে চলতে বাধ্য। কারণ এগুলো আইনত বাধ্যতামূলক। এটিই সাধারণ পরিষদ থেকে নিরাপত্তা পরিষদের মূল পার্থক্যের জায়গা।
তবে যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাবে ভেটো দিলেও, এই প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গাজায় অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির আহবান জানিয়েছে।
সূত্র : বিবিসি