বনানী সামরিক কবরস্থানের বাম দিকের শেষ সীমানার কবরটি মেজর মোহাম্মদ মুমিনুল ইসলাম সরকারের। আজ(রোববার) সকালে কবরটির সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন বাবা মফিজুল ইসলাম সরকার। প্রথমে চাপা কান্না পরে আর্তনাদ। বাবার এমন অশ্রুর ফোটা গড়িয়ে পড়ছিল সন্তানের কবরে। দীর্ঘ সময় একদৃষ্টিতে কবরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন সন্তানহারা এ পিতা।
গত ১৫ বছর ধরে একটা চাপা কষ্ট, শূন্যতা, সন্তানকে ছুঁয়ে না দেখতে পারার কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছেন বাবা মফিজুল। সেই ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির বহুল আলোচিত পিলখানার নির্মম হত্যাকাণ্ডে ছেলে হারানোর বেদনা প্রতিনিয়ত কাঁদায় বয়সের ভারে নুয়ে পড়া বৃদ্ধ এ বাবাকে।
সেই চাপা কষ্ট, বেদনা নিয়ে আজও তিনি এসেছেন সন্তানের কবরের পাশে। কখনো স্ব-জোড়ে কাঁদছেন, কখনো নীরবে। অন্য স্বজনরা তাকে থামানোর চেষ্টা করেও পারছেন না। এক ফোটা এক ফোটা করে বাবার অশ্রু জলে ভিজছিল সন্তানের কবর। এ সময় সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী মমিনুর নেসা সরকার। তিনিও ছেলের শোকে পাথর হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন কবরের পাশে।
ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাবার কান্না যখন কিছুটা কমে এল, তখনই কথা হয় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে। তখন মফিজুল ইসলাম বলেন, আমার ৮ সন্তানের মধ্যে মুমিনুল ছিল সবচেয়ে মেধাবী। ডিকশনারির প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত সব মুখস্থ ছিল। তার সহকর্মীরা বলতো— স্যার থাকলে ডিকশনারির পাতা উল্টাতে হয় না।
বিচারকার্য সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, জীবিত অবস্থায় বিচারকার্য দেখে যেতে চাই, এটাই শেষ ইচ্ছা আমার।
এ সময় পাশের আরেক কবরের সামনে শোকে মুজ্জমান দেখা যায় এক তরুণীকে। পরে জানা যায়— তিনি পিলখানা হত্যাকাণ্ডে নিহত শহীদ লে.কর্নেল লুৎফর রহমানের মেয়ে। বাবার কবরে শ্রদ্ধা জানাতে এসে আপ্লুত হয়ে পড়েছেন তিনি।
পিতা হত্যার বিচার চেয়ে ফাবিয়া বুশরা বলেন, এই ঘটনায় জড়িত অনেকে গ্রেপ্তার হলেও রায় এখনো কার্যকর করা হয়নি। এখন পর্যন্ত কারো ফাঁসি হয়েছে বলে জানা নেই। এত বড় একটি হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পেছনে অনেক শক্তি থাকার কথা। সেই শক্তিগুলোও আসলে সামনে আসেনি। যারা মাঠে বসে গুলি চালিয়েছে তারা আসলে কারো মদতপুষ্ট হয়ে এই কাজ করেছে। আমরা জানতে চাই তারা কারা? আমরা জানি না— আমাদের জীবদ্দশায় এইটা জানতে পারব কি না? আমি বিচার দেখে যেতে চাই এবং হত্যাকাণ্ডের পেছনের শক্তি কারা, তাও জানতে চাই।
তিনি আরও বলেন, আমরা মনে করি— পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা রয়েছে। কারণ, এই হত্যাকাণ্ডটি অনেক দিনের পরিকল্পনার পর ঘটানো হয়েছে। তবে দুঃখের বিষয় হলো ঘটনার পেছনে কারা ছিল, তা ১৫ বছর পরও জানতে পারিনি। আশা করি প্রকৃত সত্যটা একদিন বের হয়ে আসবে।
এই দিনে যা ঘটেছিল
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির এই দিনে সকাল ৯টা ২৭ মিনিটের দিকে বিডিআরের বার্ষিক দরবার চলাকালে হলে ঢুকে পড়েন একদল বিদ্রোহী সৈনিক। তাদের একজন তৎকালীন মহাপরিচালকের (শাকিল আহমেদ) বুকে বন্দুক তাক করেন। সূচনা হয় ইতিহাসের সেই নৃশংসতম ঘটনার। বিদ্রোহী সৈনিকরা সেনা কর্মকর্তাদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করে পরিবারকে জিম্মি করে ফেলেন জওয়ানরা। পুরো পিলখানায় সৃষ্টি হয় ভীতিকর পরিস্থিতি। চারটি প্রবেশ গেট নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আশপাশের এলাকায় গুলি ছুঁড়তে থাকেন বিদ্রোহীরা।
তারা দরবার হল ও এর আশপাশের এলাকায় সেনা কর্মকর্তাদের ওপর গুলি করতে থাকেন। তাদের গুলিতে একে একে লুটিয়ে পড়তে থাকেন সেনা কর্মকর্তারা। ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা পর এ বিদ্রোহের অবসান হয়। পিলখানা পরিণত হয় এক রক্তাক্ত প্রান্তরে। পরে পিলখানার ভেতরে আবিষ্কৃত হয় গণকবর। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় সেনা কর্মকর্তাদের লাশ। ৩৬ ঘণ্টার এ হত্যাযজ্ঞে ৫৭ সেনা কর্মকর্তা, এক সৈনিক, দুই সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, ৯ বিজিবি সদস্য ও পাঁচ বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হন।
বহুল আলোচিত এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় (পিলখানা হত্যা মামলা) ১৩৯ জনের ফাঁসি, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন এবং ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট।
মামলার বিচারকার্য
আদালত সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে এসব মামলা নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়।
হত্যা মামলায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২৩ বেসামরিক ব্যক্তিসহ প্রথমে ৮২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। পরে সম্পূরক অভিযোগপত্রে আরও ২৬ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করায় আসামির সংখ্যা বেড়ে হয় ৮৫০ জন। এছাড়া বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় ৮০ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় সিআইডি। পরে আরও ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে মোট ৮৩৪ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
রাজধানীর পুরান ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ইতিহাসের কলঙ্কজনক এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন, ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে (তিন বছর থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত) কারাদণ্ড, ২৭৮ জনকে খালাস এবং চার আসামি বিচার চলাকালে মারা যাওয়ায় তারা অব্যাহতি পান।
আদালতের রায় ঘোষণার পর ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে যায়। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে আসামিরা দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল ও জেল আপিল করেন। এর মধ্যে ৬৯ জনকে খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। গুরুত্বপূর্ণ এ মামলার শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্ট বিশেষ উদ্যোগ নেন।
বিচারক সংকটে আটকা হত্যা মামলার আপিল শুনানি, আরেকটি সাক্ষ্যগ্রহণে
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির জন্য বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে দেন। দেশের ইতিহাসে আসামির সংখ্যার দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় এ মামলায় ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে শুনানি শুরু হয়।
মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতরা সবাই বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (তৎকালীন বিডিআর) সদস্য ছিলেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিতদের মধ্যে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীও রয়েছেন। এর মধ্যে নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ২০১৫ সালের ৩ মে রাজশাহী কারাগারে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।