পাসপোর্ট অফিসের গেটে অবস্থান করেন কয়েকজন দালাল। অফিসে ঢোকার আগেই পাসপোর্ট করতে আসা সাধারণ মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে টাকার বিনিময়ে কোনো প্রকার ঝামেলা ছাড়া করে দিতে চান পাসপোর্ট। বিভিন্ন উপজেলা ও চরাঞ্চল থেকে আসা বেশির ভাগ মানুষও তাদের কথা বিশ্বাস করে অতিরিক্ত টাকা ব্যয় করে তাদের মাধ্যমে করে নিচ্ছেন পাসপোর্ট। এই চিত্র কুড়িগ্রাম আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের।
জেলা শহরের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকায় অবস্থিত পাসপোর্ট অফিস। গত ৮ মাস থেকে সকল কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এখানে। এর আগে অফিসটির কার্যক্রম চলত শহরের খলিলগঞ্জ এলাকার একটি ভাড়া অফিসে।
সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক কুড়িগ্রাম আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে কয়েক দিন গিয়ে দেখেন, অফিসের গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন বয়সের কয়েকজন লোক। বাইরে থেকে পাসপোর্ট করতে আসা লোকজন গেট দিয়ে প্রবেশ করা মাত্র এগিয়ে আসছেন দুই থেকে তিনজন। পাসপোর্ট করার বিষয়টি নিশ্চিত হতেই তাদের নিয়ে যাচ্ছেন একটু দূরে। তার পর তাকে বোঝানো হচ্ছে পাসপোর্ট করতে নানা ঝামেলা ও দীর্ঘসময় অপেক্ষার কথা। এক্ষেত্রে অফিস নির্ধারিত টাকার চেয়ে সামান্য কিছু টাকা বেশি দিলেই কোনো ঝামেলা ছাড়া পাসপোর্ট করে দেওয়ার আশ্বাস দিচ্ছেন তারা। বিভিন্ন উপজেলা ও চরাঞ্চল থেকে আসা সহজসরল মানুষজনও তাদের কথা বিশ্বাস করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও টাকা তুলে দিচ্ছেন তাদের হাতে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাসপোর্ট অফিসে ১০ বছর মেয়াদি পাসপোর্ট করতে সরকার নির্ধারিত প্রায় ৬ হাজার টাকা খরচ পড়ে। আর দালালের মাধ্যমে করতে গেলে খরচ পড়ে সাড়ে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। আর এই খপ্পরে সবচেয়ে বেশি প্রতারিত হচ্ছেন বিভিন্ন উপজেলা থেকে পাসপোর্ট করতে আসা সাধারণ মানুষজন। অথচ দালালদের ঘেরা টোপ পেরিয়ে সরাসরি পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে আবেদন করলেই নিয়মমাফিক পাওয়া যাচ্ছে পাসপোর্ট। এ অবস্থা দিনের পর দিন চলতে থাকলেও নীরব পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদক পাসপোর্ট করতে গ্রাহক সেজে কুড়িগ্রাম আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে ঢুকতেই মেহেদী নামের এক যুবক সামনে এসে হাজির। তিনি এ প্রতিবেদককে বুঝাচ্ছেন, ‘যদি পাসপোর্ট করেন তাহলে নিজে করতে যাবেন না। পরে এক মাসেও পাসপোর্ট করতে পারবেন না। বিভিন্ন কাগজপত্রের ভুল ধরবে অফিস। ঘুরতে ঘুরতে জীবন শেষ হয়ে যাবে। পরে আমাদের কাছেই আসতে হবে।’
কীভাবে হয়রানি ছাড়া পাসপোর্ট করা যাবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেহেদী নামের ওই যুবক বলেন, ‘আমার মাধ্যমে যদি ১০ বছর মেয়াদি পাসপোর্ট করেন মাত্র ২০ দিনের মধ্যে করে দিতে পারব। শুধু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আর টাকা দেন। সবমিলিয়ে সাড়ে সাত থেকে আট হাজার টাকার মতো খরচ হবে। এতে কোনো হয়রানির শিকার হবেন না। এখানে আমরা ১০-১৫ জন কাজ করি। এর মধ্যে আমরা ৪-৫ জন স্থানীয়। আরও অসংখ্য লোকজন আছে, তারা বাইরের। আমাদের আগে কেউ আপনাকে পাসপোর্ট করে দিতে পারবে না।’
জাতীয় পরিচয়পত্রে নামের ভুল থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে মেহেদী বলেন, নামের একটা ভুল থাকলে এক হাজার টাকা বেশি খরচ পড়বে।
পাসপোর্ট নিয়ে কথা হয় রনি নামের আরও একজনের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আর ৮ হাজার টাকা দিয়ে যান। আমি ২০ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট রেডি করে আপনাকে ডাকব, এসে পাসপোর্ট নিয়ে যাবেন। আর নিজে করতে গেলে টের পাবেন পাসপোর্ট কী জিনিস। আমার কাছে সব কাগজপত্র দেন, কোনো সমস্যা হবে না। আমরা এখানকারই ছেলে, টাকা মেরে খাব না।’
রৌমারী উপজেলার খঞ্জনমারা থেকে পাসপোর্ট নিতে এসেছেন মো. রহমত আলী, রেজাউল ইসলাম ও তোতা মিয়া। তারা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছালাম নামের এক দালালের মাধ্যমে আমরা পাসপোর্ট হাতে পেলাম। ১৫ দিন আগে এসে কাগজপত্র দিয়ে গেছি। আজ এসে তার মাধ্যমে পাসপোর্ট নিলাম। জনপ্রতি আমাদের খরচ হয়েছে সাড়ে ৭ হাজার টাকা।
তারা আরও বলেন, দালাল ধরলে কোনো প্রকার ঝামেলা ছাড়াই পাসপোর্ট করা যায়। তাই আমরা দালালের মাধ্যমেই পাসপোর্ট করলাম।
পাসপোর্ট করতে রৌমারী উপজেলার কুড়ার চর থেকে এসেছেন জিয়াউর রহমান নামের এক ব্যবসায়ী। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাসপোর্ট অফিসের গেট দিয়ে ঢোকামাত্র অনেকে এসে আমাকে ঘিরে ধরেছে। এখানে দালালের অভাব নেই। একজন একদিকে ডাকছে, আরেকজন অন্যদিকে। আমি তাদের বলেছি, আমি আগে অফিসে গিয়ে বিস্তারিত শুনব তারপর নাহয় আপনাদের কাছে আসব।
ভুরুঙ্গামারী উপজেলার বড়খাটামারী থেকে পাসপোর্ট নিতে এসেছেন জাহিদুর হক। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি রাশেদ নামের একজনের মাধ্যমে ১০ বছর মেয়াদি পাসপোর্ট করলাম। খরচ হয়েছে ৮ হাজার টাকা। আমি সৌদি আরব যাব। ২৫ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট হাতে পেলাম। ভেরিফিকেশনের জন্য পুলিশ আমার কাছে থেকে ৫০০ টাকা নিয়েছে।
কুড়িগ্রামের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক ও সিনিয়র সাংবাদিক শ্যামল ভৌমিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাসপোর্ট অফিসে দালাল কোনোভাবেই কাম্য নয়। এই দালাল চক্রকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। তাহলেই বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা মানুষজন প্রতারিত হবে না।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কুড়িগ্রাম আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মো. সফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতি সোমবারই এখানে আমরা গণশুনানি করি। তবে আমরা কাউকে পাচ্ছি না। এ ছাড়া অফিসে একটা রেজিস্ট্রার খাতা রাখা আছে। কারও কোনো অভিযোগ থাকলে এখানে লিখতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, গণশুনানি করার উদ্দেশ্য হচ্ছে কারও কোনো অভিযোগ আছে কি না। এ ছাড়া পাসপোর্ট করতে কী কী কাগজপত্র প্রয়োজন সেটি বলা। তবে এখন পর্যন্ত আমার অফিসের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী কারও সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে এমন অভিযোগ পাইনি।
তবে দালালদের দৌরাত্ম্যের বিষয়ে একাধিকবার প্রশ্ন করা হলেও বিষয়টি এড়িয়ে যান কুড়িগ্রাম আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের এই কর্মকর্তা।
এদিকে ভেরিফিকেশনের বিষয়ে জানতে চাইলে কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা শুধু পাসপোর্ট অফিসের ভেরিফিকেশনটাই করি। কেউ যাতে দুর্নীতির আশ্রয় না নেন সেজন্য গুরুত্বসহকারে সেটি করা হচ্ছে। পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের জন্য আমাদের একটি টিম রয়েছে। দুর্নীতিমুক্তভাবেই এখানে পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন হচ্ছে। আমাদের যে সময় বেঁধে দেওয়া আছে তার মধ্যেই আমরা ভেরিফিকেশন করে রিপোর্ট দিচ্ছি।
সার্বিক বিষয়ে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ সাইদুল আরিফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, কিছুদিন আগে অভিযান চালিয়ে কয়েকজন দালালকে আটক করে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি। আবারও শুনতে পাচ্ছি দালালরা সেখানে কাজ শুরু করেছে। আমরা আইনশৃঙ্খলা ও সংশ্লিষ্ট অফিসে কথা বলে সেখানে আবারও অভিযান পরিচালিত করবো।