একুশের চেতনাকে ধারণ করে প্রতি বছর ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় বাঙালির প্রাণের আয়োজন অমর একুশে বইমেলা। মেলার প্যাভিলিয়ন ও স্টল নির্মাণে একুশের চেতনা ও গ্রামীণ বিষয়বস্তুকে বরাবরই প্রাধান্য দেওয়া হয়।
এবারও স্টলগুলোতে একুশের ছোঁয়া লেগেছে। ২১শে ফেব্রুয়ারি সামনে রেখে মেলাজুড়ে লেখক-পাঠক-দর্শনার্থী সবার সাজগোজেও প্রবলভাবে ফুটে উঠছে একুশের চেতনা। তবে, যেই ভাষা শহীদদের স্মরণে এই মেলা তাদের নিয়ে এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা মেলায় খুবই কম।
মেলায় বেশ কিছু প্যাভিলিয়ন ও স্টলের নির্মাণে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে প্রাধান্য দিতে দেখা গেছে। কিছু প্যাভিলিয়ন ও স্টলে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বর্ণমালা, রিকশাচিত্র, গ্রামীণ পরিবেশ প্রভৃতি।
বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে বিভিন্ন জাতের কাঠ, প্লেইন শিটের মধ্যে কারুকাজ মিশ্রিত কাঠামো দিয়ে গ্রামীণ আদলে গড়া আকাশ প্রকাশনীর প্যাভিলিয়ন বাড়তি নজর কাড়ছে। কাঠ ও টিন দিয়ে তৈরি বাড়ি-ঘরের মতো এই প্যাভিলিয়ন নিয়ে দর্শনার্থীদের আগ্রহ দেখা গেছে বেশ। সেখানে গিয়ে বই কেনার পাশাপাশি ছবিও তুলছেন অনেকে।
আকাশ প্যাভিলিয়নের কর্মী তরিকুল ইসলাম বলেন, এবারের মেলায় আমাদের প্যাভিলিয়ন সবার কাছে বেশ আকর্ষণীয় হয়েছে। যার ফলে, বই কেনার পাশাপাশি অনেকে এখানে ছবি তুলছেন।
এবারও মেলার আরেক ব্যতিক্রমী প্যাভিলিয়ন অন্যপ্রকাশ। দেশের ঐতিহ্যবাহী রিকশা চিত্রের প্রিন্টেড ব্যানার দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই প্যাভিলিয়নটি। ফলে মেলায় আসা বইপ্রেমী ও দর্শনার্থীরা সেখানে গিয়ে বই কেনার পাশাপাশি ছবি তুলে ধরে রাখছেন স্মৃতি। এছাড়া, বর্ণমালা দিয়ে তৈরি করা ক্রিয়েটিভ ঢাকা পাবলিকেশন্স। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের আদলে সাজানো মিজান পাবলিশার্সের প্যাভিলিয়নটি আলাদা নজর কাড়ছে।
ভাষা শহীদ ও ভাষা আন্দোলনের বই কম
প্রকাশকরা বলছেন, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও পাণ্ডুলিপির সংকটের কারণে নতুন বই প্রকাশের সংখ্যা কম থাকে। আবার যারা লেখেন তারাও অনেকে ভাষা আন্দোলনের একপেশে ইতিহাস লেখেন। এসব কারণে অনেক সময় ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস চাপা পড়ে যায়। তাই তরুণ প্রজন্মের কাছে ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস পৌঁছে দিতে হলে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, ভাষা আন্দোলনের মতো ইস্যুতে বেসরকারি প্রকাশনাগুলোর বেশি বিনিয়োগ করা সম্ভব নয়।
এবারের মেলায় আগামী প্রকাশনী থেকে এসেছে ভাষা আন্দোলনের ওপর প্রকাশিত নতুন বই সুজন বড়ুয়ার ‘আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি : আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। এছাড়া এম আবদুল আলীমের গবেষণাধর্মী বই ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন জেলাভিত্তিক ইতিহাস’, ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ছাত্রলীগের ভূমিকা’। এছাড়া, এম আবদুল আলীমের ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে রফিকুল ইসলাম’ এবং হাবীবুল্লা ফাহাদের ‘দুই ভাষা সংগ্রামীর মুখোমুখি- আহমদ রফিক ও রফিকুল ইসলাম’। পাশাপাশি বশীর আল হেলালের ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’, মাযহারুল ইসলামের ‘ভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিব’ নামে আরও দুটি বই এনেছে প্রতিষ্ঠানটি।
এছাড়া, আরও কয়েকটি প্রকাশনীতে ভাষা আন্দোলনের বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো আহমদ রফিকের ‘একুশ থেকে একাত্তর’ (অনিন্দ্য) ও ‘ফিরে দেখা অমর একুশ ও অন্যান্য ভাবনা’ (সময়), গোলাম কুদ্দুছের ‘ভাষার লড়াই, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ (নালন্দা), ‘বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন’ (অন্যপ্রকাশ), ‘ভাষা-আন্দোলনে তাজউদ্দীন আহমদ’ (ঝুমঝুমি প্রকাশনী), ‘ভাষা আন্দোলনের জানা-অজানা ইতিহাস’ (ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ), আহমেদ রশিদের ‘ভাষা শহীদদের কথা’ (ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ), শাহনেওয়াজ চৌধুরীর ‘বঙ্গবন্ধু, একুশ ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ (শোভা প্রকাশ), আখতার হোসেন মল্লিকের ‘ভাষা সংগ্রাম ও বইমেলা’ (জলছবি) ইত্যাদি।
আগামী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ওসমান গণি ঢাকা পোস্টকে বলেন, একুশের চেতনাকে ধারণ করে প্রতি বছর বইমেলা হয়। অনেকে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে জানতে চান। কিন্তু সেই লেখক কোথায়? ভালো বইয়ের জন্য ভালো লেখক দরকার। গবেষণা দরকার। এটা করতে প্রচুর অর্থায়ন দরকার। সেটি বেসরকারি প্রকাশনাগুলোর পক্ষে সম্ভব নয়। তাই এটা করার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। অর্থাৎ বাংলা অ্যাকাডেমিকে নিতে হবে।
ওসমান গণি বলেন, যে ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আমাদের আজকের বাংলাদেশ, সেটি নিয়ে আমরা আসলে কতটুকু কাজ করতে পেরেছি? বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে একটি করে লাইব্রেরি থাকে। সেখানে যদি ভাষা আন্দোলনের বইগুলোকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে বিশ্ববাসী জানতে পারবে আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। কিন্তু সেই জায়গাতে আমরা এখনও পিছিয়ে আছি।
প্যাভিলিয়নে ভিড়, ফাঁকা স্টলগুলো
একুশে ফেব্রুয়ারির আগের দিন অর্থাৎ ২০ ফেব্রুয়ারি মেলায় আসা ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। এসব ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের ভিড় ছিল মেলার বড়-বড় প্যাভিলিয়নকে কেন্দ্র করে। দর্শকের ভিড় থাকলেও মেলার ছোট স্টলগুলো অনেকটাই ক্রেতাশূন্য দেখা গেছে।
স্টলগুলোর বিক্রয় কর্মীরা বলছেন, সাধারণত প্যাভিলিয়নগুলোতে বই বেশি থাকে, অনেক বেশি লেখকের বই থাকে। এসব কারণে সেখানে ক্রেতাদের ভিড় থাকে। অন্যদিকে, ছোট স্টলগুলোতে বড় লেখকের বই যেমন কম থাকে তেমনি বইয়ের সংখ্যাও কম থাকে।
ধ্রুবতারা প্রকাশনীর দায়িত্বে থাকা রনি আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বড় প্রকাশনীগুলোতে যেমন বিভিন্ন ধরনের লেখকের বই থাকে, একইভাবে তাদের বইয়ের সংখ্যাও বেশি থাকে। যার কারণে সেখানে ক্রেতা বেশি থাকে। আমাদের মতো ছোট স্টলগুলোকে কোনো কোনোদিন বিক্রি ছাড়াই বসে থাকতে হয়।
কুঁড়েঘর প্রকাশনীর দায়িত্বে থাকা রিমা আক্তার স্মৃতি বলেন, সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে স্টলগুলোতে ভিড় থাকে। অন্য দিনে প্যাভিলিয়নগুলোতে ক্রেতার সংখ্যা বেশি থাকে। সেখানে বড় লেখকদের বই পাওয়া যায় বেশি। আবার সেখানে সব ধরনের বইও থাকে।