আবারো টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ ও সেন্টমার্টিন সীমান্তে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে। বিকট শব্দে ওই এলাকা কেপে উঠায় স্থানীয়দের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা বিরতির পর আবারো থেমে থেমে গোলাগুলি শুরু করে।
শুক্রবার সকালে মিয়ানমার থেকে মর্টার শেল ও গোলাগুলির ভারি শব্দ শোনা যাওয়ায় এপারে আতঙ্কে রয়েছেন স্থানীয়রা। সীমান্তের এই পরিস্থিতিতে নৌ-রুটে পর্যটকবাহী জাহাজের পাশাপাশি স্থানীয়দের বহনকারী নৌ-যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
শাহপরীরদ্বীপের বাসিন্দা শাহজাহান বলেন, ‘গোলাগুলির শব্দে দুনিয়াদারি তরতরায়। ভয়ে বাসা-বাড়িতে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বসবাস করা দূরহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন ঘটনায় তুমব্রুতে একজন স্থানীয় মহিলাসহ দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। আল্লাহ না করুক এখানেও যদি এমনটি হয় তার দায় কে নেবে? আমরা অত্যন্ত ভয়ের মধ্যে রয়েছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘মিয়ানমারের গুলি এসে পড়েছে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী স্থানীয়দের রান্না ঘরের ডেকসির (পাতিলের) ঢাকনায়।’
২০১৭ সালে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় ১০ লাখ রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নির্যাতনের শিকার হওয়া রোহিঙ্গাদের তখন মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছিল বাংলাদেশ। সেই রোহিঙ্গাদের কারণে এখন নানাবিধ সমস্যায় রয়েছে স্থানীয়রা। সেই সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বার বার সঙ্ঘাত বন্ধ করে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার আবেদন করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু এই ইস্যুতে নিরব ছিল ভারতসহ অনেক মিত্র রাষ্ট্র।
সচেতন মহল মনে করছেন, ‘মিয়ানমারের এবারের পরিস্থিতি ২০১৭ সালের মতো নয়। মিয়ানমারের সঙ্ঘাতের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ। এখন মিয়ানমারের সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরিতে বাংলাদেশকে কাজ করে যেতে হবে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীসহ ৩৩০ জনকে ১১ দিনের মধ্যে কূটনৈতিক তৎপরতায় মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হোক এমনটি প্রত্যাশা করছেন আশ্রিত রোহিঙ্গারা।’
১১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা সোলতান আহমদ বলেন, ‘নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে থাকতে কারো ভালো লাগার কথা নয়। আমরাও মানুষ। আমাদেরও দেশের প্রতি ভালোবাসা আছে। আমরা স্বাধীনভাবে নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিয়ে ফিরে যেতে চায়। সীমান্তের একেক সময় দ্রুত পাল্টাচ্ছে আবার স্বাভাবিক হচ্ছে। বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পুরো অংশ এখন আরাকান আর্মির দখলে। আরাকান আর্মির প্রতিপক্ষ যেমন মিয়ানমার সেনাবাহিনী জান্তা সরকারের। ঠিক তেমনি তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে আছে এখন রোহিঙ্গাভিত্তিক সংগঠনগুলো। তারাও কিন্তু ভয়ে গোলাগুলি করছে এবং মর্টার শেল নিক্ষেপ করার চেষ্টা করছে। ঘুমধুমের পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক।’
তিনি আরো বলেন, ‘সকাল থেকে এখন পর্যন্ত কোনো প্রকার গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়নি। স্থানীয় বাসিন্দারা দোকানপাট খুলেছে। পাশাপাশি তারা ক্ষেত খামারে কৃষি কাজে যাচ্ছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। সীমান্তের পরিস্থিতিতে তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ধানের চারা ও সবজির ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। বাংলাদেশে দু’জন নিহতের ঘটনাও ঘটেছে সব মিলিয়ে এখনো পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের কেউ সরকারিভাবে সাহায্য সহযোগিতা পায়নি। সীমান্তবাসিদের কী দোষ ছিল? মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে কৃষক শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের লোকসানকে পূরণ করে দেবে। ঘুমধুম ইউনিয়নে ২০ হাজারেরও বেশি স্থানীয় বাসিন্দাদের বেশির ভাগই মিয়ানমারের সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মিয়ানমারের ছোড়া মর্টার শেলের গোলা স্থানীয় বাড়ির রান্না ঘরে এসে পড়ে। এতে প্রাণ হারায় দুই সন্তানের জননী হোসনেআরা। এই ক্ষতিপূরণ কে দেবে আর এরই বিচার কে করবে জানা নেই হোসনেআরার অবুঝ দুই সন্তানের। মিয়ানমারের বর্ডার গার্ডকে বিতাড়িত করে এখন সেখানে অবস্থান করছে আরাকান আর্মি।
তুমব্রু সীমান্ত থেকে তাদের চলাফেরা স্পষ্টই দেখা যায়। বাংলাদেশ সীমান্তে কাটাতারের খুব কাছেই তারা অবস্থান করছে। সীমান্ত অঞ্চলে তারা বর্ডার গার্ড পুলিশকে হটিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ কিলোমিটার সীমান্ত পথের প্রায় অর্ধেকেরই বেশি অংশ তারা দখলে রেখে নিয়ন্ত্রণ করছে। ৩৩০ জনকে ফিরিয়ে নেয়ার পর তুমব্রু সীমান্ত পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক। তবে গত বৃহস্পতিবার তাদের ফিরিয়ে নেয়ার কার্যক্রম শুরু হলে সকাল ১০টায় শাহপরীরদ্বীপের অপর প্রান্ত থেকে মিয়ানমারের ওই অংশে ব্যাপক গোলাগুলির শব্দ শুনতে পায় বলে স্থানীয় সীমান্তবাসি জয়নাল আবেদিন জানিয়েছেন।’
৩০০ জনকে ফিরিয়ে নেয়ার পর পুনরায় যদি তাদের ঘাটি দখল করতে চায় তখন কিন্তু আরো বড় ধরণের সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন সীমান্ত এলাকার লোকজন। সীমান্তবাসিদের আশঙ্কায় যেন ঠিক হলো আবারো টেকনাফ সীমান্তে শুক্রবার সকালে প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দে স্থানীয়রা অসহায় হয়ে পড়েছেন।