স্কুল ঘেরাওয়ের হুমকি দিচ্ছেন ভিকারুননিসার সেই শিক্ষক

Slider শিক্ষা

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভুয়া জন্ম সনদ ও বোনের কোটায় ভর্তির জন্য কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে নির্বাচিত করার অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া শাখা প্রধান শাহ আলম খান এবার স্কুল ঘেরাওয়ের হুমকি দিচ্ছেন। তাকে চাকরিতে পুনর্বহাল না করলে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের দিয়ে স্কুল ঘেরাওয়ের হুমকি দিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি প্রথম শ্রেণিতে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ভর্তি নেওয়ার অভিযোগে তাকে বরখাস্ত করা হয়।

স্কুলের একটি সূত্র বলছে, গত ৪ জানুয়ারি অবৈধভাবে প্রথম শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগে ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের মূল ক্যাম্পাসের দিবা শাখার প্রধান শাহ আলমকে সাময়িক বরখাস্ত করে অধ্যক্ষের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়। একই সঙ্গে তাকে কেন স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে না— এ মর্মে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেওয়া হয়। পুরো ঘটনা তদন্ত করতে গঠন করা হয় তিন সদস্যের কমিটি। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, এখন পর্যন্ত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়নি।

এর মধ্যেই স্কুলের সব ধরনের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছেন বরখাস্ত শিক্ষক শাহ আলম। এমনকি যারা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, তাদের দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। ভর্তিতে কোনো অনিয়ম হলে ভর্তি কমিটি ও মনিটরিং কমিটির সবাই দায়ী— এমন মন্তব্য করে তাকে কেন বরখাস্ত করা হয়েছে বলেও প্রশ্ন তুলছেন তিনি। পাশাপাশি দ্রুত সময়ের মধ্যে তাকে চাকরিতে পুনর্বহাল না করলে বেইলি রোডের মূল ক্যাম্পাসের নিজ শাখার শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নিয়ে স্কুল ঘেরাও করারও হুমকি দিয়েছেন তিনি। তার এ ধরনের হুমকিতে ভীতসন্তস্ত্র হয়ে পড়ছেন স্কুলের অন্যান্য সহকর্মীরা। বিষয়টি নিয়ে স্কুলের অধ্যক্ষের কাছে মৌখিকভাবে অভিযোগ জানিয়েছেন তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভিকারুননিসা স্কুলের একজন সিনিয়র শিক্ষক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভর্তিতে অনিয়ম নিয়ে যে অভিভাবক ও শিক্ষকরা অভিযোগ করেছেন, তাদেরকে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছেন মূল ক্যাম্পাসের দিবা শাখা প্রধান শাহ আলম। এছাড়া, স্কুলের বিভিন্ন ফেসবুকে গ্রুপে তাদের দেখে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন শিক্ষকরা।

তারা বলছেন, শিক্ষক শাহ আলমের বিরুদ্ধে স্থায়ী ব্যবস্থা না নেওয়া পর্যন্ত তাকে স্কুলে আসা বন্ধ করতে হবে। কারণ তিনি সবাইকে বলে বেড়াচ্ছেন যে, তিনি বীরদর্পণে স্কুলে ফিরে আসবেন এবং যারা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন তাদের দেখে নেবেন। বরখাস্ত হওয়া একজন শিক্ষক শুধু স্কুলে এসে সই করে চলে যেতে পারেন। কিন্তু তিনি স্কুলের সব ধরনের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছেন।

শুক্রবার (৯ ফেব্রুয়ারি) এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষক শাহ আলমকে সাময়িক বরখাস্ত করে তাকে অধ্যক্ষের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী সাময়িক বরখাস্ত হলে তাকে স্কুলে আসতে হবে, সে জন্যই তিনি স্কুলে আসছেন।

শিক্ষক ও সহকর্মীদের হুমকি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ধরনের অভিযোগের বিষয়ে আমার জানা নেই। কাউকে তিনি এ ধরনের হুমকি দিয়ে থাকলে তারা স্কুলের অধ্যক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ জানাতে পারেন।

যেভাবে ভর্তিতে অনিয়ম করা হয়

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভর্তি নীতিমালা অনুযায়ী, লটারি পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। সেই অনুযায়ী, ভিকারুননিসা স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে নির্বাচিতদের প্রথম তালিকা থেকে ভর্তি নেওয়া হয়। তবে লটারিতে নির্বাচিত নয়, এমন শিক্ষার্থীকে ভিকারুননিসার ভর্তি তালিকায় পাওয়া যায়। এছাড়া, জন্ম সনদের গরমিল, অনলাইনে তথ্য নেই, এমনকি বোন না থাকার পরও বোনের কোটায় কোনো কোনো শিক্ষার্থীকে ভর্তি তালিকায় পাওয়া যায়।

লটারির ফল অনুযায়ী, ভিকারুননিসা স্কুলে ভর্তির জন্য নির্বাচিতদের প্রথম তালিকা থেকে ভর্তি নেওয়া হয়। এ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়েও অভিযোগ করেন অভিভাবকরা। পরে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করা হয়। গত ৩ জানুয়ারি ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের মূল দিবা শাখার (বাংলা ভার্সন) প্রথম শ্রেণির সব ফরম গভর্নিং বডির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে নেওয়া হয়। সেখানে সেগুলো পুনরায় যাচাই-বাছাই করে চারজন শিক্ষার্থীকে অবৈধভাবে ভর্তির প্রমাণ পায় কর্তৃপক্ষ।

ভিকারুননিসার দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তিযোগ্য তালিকায় ১২৪ নম্বর ক্রমিকে লাবিনা হোসেন লিয়া নামে এক ছাত্রীর জন্ম সনদের তথ্য অনলাইনে পাওয়া যায়নি। আবেদনের তথ্যের সঙ্গে জন্ম সনদের একটি সংখ্যারও মিল নেই। আবেদনের জন্ম তারিখ ২০১৩ দেওয়া হলেও জমা দেওয়া সনদে লেখা ২০১৭ সাল। এই ছাত্রীর নাম ভর্তির তালিকায় কীভাবে এলো সে বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি শিক্ষক শাহ আলম।

এছাড়া, একই শ্রেণিতে বোনের কোটায় ভর্তিযোগ্য তালিকায় নাম আসে ফায়জা হোসেন আফসিনের। ১২৮ ক্রমিক নম্বরের ওই ছাত্রীর কোনো বোন ভিকারুননিসায় না পড়াশোনা করে না। অথচ তাকে বোন কোটায় ভর্তির জন্য নির্বাচিত করা হয়। লটারিতে নির্বাচিত নয়, এমন শিক্ষার্থীদের নামও প্রথম নির্বাচিত তালিকায় ছিল। পরে তাদের ভর্তি করা হয়েছে। এ ছাড়া, ভুল তথ্য দিয়ে আবেদন করা শিক্ষার্থীদেরও ভর্তি নেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়।

অভিযোগ উঠেছে, শাখা প্রধান শাহ আলমের একক সিদ্ধান্তে এসব শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়েছে। বিশেষ আর্থিক সুবিধা নিয়ে এসব শিক্ষার্থীকে ভর্তির সুযোগ করে দিয়েছেন শাখা প্রধান শাহ আলম।

ভর্তিতে অনিয়মের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি

শুধু লিয়া ও আফসিন নয়, ভর্তিতে এমন অনিয়ম আরও হয়েছে কি না তা তদন্ত করতে তিন সদস্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান করা করা হয়েছে স্কুলের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক রেবেকা ইয়াসমীনকে। এছাড়া, সদস্য হিসেবে আছেন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের একান্ত সচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিব রাহুল চন্দ্র ও গভর্নিং বডির সদস্য গোলাম বেনজীর। স্কুলের ভর্তি কমিটি, অভিযুক্ত শিক্ষক ও কয়েকজন অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেছে এই কমিটি। এ বিষয়ে শিগগিরই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া কথা রয়েছে।

জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রাথমিকভাবে কয়েকজন শিক্ষার্থীর ভর্তিতে অনিয়মের প্রাথমিক তথ্য মিলেছে। তবে সংখ্যাটা বলতে রাজি হননি তিনি। এ অনিয়মের বিষয়ে শিক্ষক শাহ আলমের দায় পাওয়া গেছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে, অভিযোগের বিষয়টি তদন্তনাধীন থাকায় কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *