চারিদিকে পশুত্বের জয়জয়াকার!

Slider নারী ও শিশু

87657_rape

পশুর ন্যায় আচরণকে পাশবিক আচরণ বলে। মানুষের মানবিক গুণকে মনুষ্যত্ব আর পাশবিক আচরণকে পশুত্ব হিসেবে ধরা হয়। মনুষ্যত্বই মানুষকে অন্যান্য জীব থেকে আলাদা ও স্বতন্ত্র করেছে। এই গুণের বলে মানুষ অসম্ভবকে সম্ভব করে পশুকেও বশে নিয়ে এসেছে। পশুত্ব যখন মানুষের মধ্যে প্রবেশ করে, তখন মনুষ্যত্ব রূপান্তরিত হয় পশুত্বে। প্রশ্ন হচ্ছে মনুষ্যত্বের ক্ষমতা বেশি না পশুত্বের? আসলে প্রয়োজনের উপর নির্ভর করে কার ক্ষমতা বেশি। তবে বর্তমান সময়ে অনেক ক্ষেত্রে পশুত্বের জয়জয়াকার।
শিশু থেকে বৃদ্ধ সব শ্রেণীর মানুষের কাছে ‘ধর্ষণ’ শব্দটি সর্বাধিক পরিচিত। ধর্ষিতাদের তালিকা শুধু লম্বাই হচ্ছে। বাদ পড়ছেনা ৩-৪ বছরের শিশুও। পশুত্ব এমনভাবে জাগ্রত হয়ে উঠেছে যে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে। নারী-শিশু বাস, ট্রেন, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র সর্বোপরি নিজ গৃহেও নিরাপদ নয়। ধর্ষক নামক হয়েনাটি কোথায় ওৎ পেতে আছে- এই ভয়েই চলতে হয় সারাদিন। ‘ধর্ষণ’ এখন অনেকটা দল বেঁধে সিনেমা দেখার মতো উৎসাহ ব্যঞ্জক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। একই সময়ে একই নারীকে সবার সম্মুখে সদল-বলে ধর্ষণ করা এখন আর বিরল নয়। আধুনিক রাষ্ট্রে থানা-পুলিশ যে কোন মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। অপরাধীর শাস্তি আর নিরাপরাধীর শস্তির জায়গা এটি। হাওয়া পাল্টে গেছে। এখন আর এটি নিরাপদ স্থান নয়। বরং নারীর জন্য ভীতিকর জায়গা। মানুষগুলোও যেন মুখোশ পরা। তবে ধর্ষণকারী যদি পিতা, ভাই বা নিকতাত্মীয় হয় সেটাকে কি বলবো? পশুরও একটা নীতি আছে। এক পশু সমশ্রেণীর অরেক পশুর মাংস ভক্ষণ করেনা, সে যত ক্ষুধার্তই হোক না কেন। কয়েকদিন আগে পিতা কর্তৃক নিজ কন্যাকে ধর্ষণের সংবাদ আমাকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে। এও কি সম্ভব? নারী নিরাপদ কোথায়? পিতা-মাতা সন্তানের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল। তবে আশ্রয়কেন্দ্রের উপরের ছাদটা ছিদ্র আর ভিতরটা বিষাক্ত জীবের বসতি হলে সেটা আর নিরাপদ থাকে না। হয়ে পড়ে গভীর অরণ্যের চেয়েও ভয়ঙ্কর। পিতা যদি হয় ধর্ষক তাহলে বাদ থাকে কে? রাস্তা থেকে তুলে এনে গাড়ীতে  ধর্ষণ করাকে আর অস্বাভাবিক বলার কারণ থাকে না।
ছোট্ট শিশুটিকেও কোন পুরুষের কাছে রাখতে দেয়া আর ‘শেয়ালের কাছে মুরগী বন্ধক রাখা’ একই হয়ে পড়েছে। কখন কোন প্রবৃত্তি জেগে উঠবে কে জানে। মহিলা পরিষদের রিপোর্টে জানানো হয়েছে চলতি বছরের  সাত মাসে ২ হাজার ৪ শত ৪৭ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৫০টি। যার ৯৭ জনই গণধর্ষণের শিকার। ৫৪ হতভাগিনীকে ধর্ষণের পর ধর্ষকদের হাতে হত্যাকান্ডের শিকার হতে হয়েছে। এর মধ্যে জুলাই মাসেই ধর্ষিতা হয়েছে ৮৩ নারী ও শিশু। গণধর্ষণ ১৫। ধর্ষনের পর হত্যা করা হয়েছে ৯ জনকে।
শিশু অধিকার ফোরাম (বিএসএএফ) জানিয়েছে, গত সাত মাসের ২৩০ জন ধর্ষিতাই শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৭ শিশুকে।
শিশু ধর্ষণ করা ধর্ষকদের জন্য অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয় আইসক্রিম, চকলেটের মতো লোভনীয় দ্রব্য। এমন শিশুকেও ধর্ষণ করা হয় যার এখনো বুলি ফোঁটেনি। ধর্ষণের তালিকা থেকে বাদ পড়ে না মানসিক-শারীরিক প্রতিবন্দীরাও। মানসিক প্রতিবন্দীদের গর্ভবতী হওয়ার ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়। মানুষের রূচি কতটা বিকৃত হয়ে গেছে ভাবাই যায় না। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রতিবছর ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। অথচ নারী নির্যাতন প্রতিরোধে যথেষ্ট যুগোপযোগী আইন আমাদের দেশে রয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত-২০০৩)- এর ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে- “যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তবে সে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হবে। একই আইনের ৯(২) ধারায় আছে- “ধর্ষণ বা ধর্ষণ পরবর্তী কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে ধর্ষকের মৃতুদন্ড বা যাবজ্জীবটন কারাদন্ড হবে।” একই সাথে জরিমানার কথাও বলা হয়েছে। সর্বনি¤œ জরিমানা এক লাখ টাকা। ৯(৩) ধারায় বলা হয়েছে- “যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং উক্ত ধর্ষণের ফলে কোন নারী বা শিশু মারা যায় তাহলে প্রত্যেকের যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা মৃত্যুদন্ড, কমপক্ষে ১ লাখ টাকা জরিমানা হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের আইন অন্যান্য দেশ এমনকি পার্শ¦বর্তী দেশ ভারতের চেয়েও শক্তিশালী।
আইন থাকলেও ফাঁকফোকর কম নয়। শতবর্ষ পুরনো প্রমাণ সংক্রান্ত আইনের  (এভিডেন্স অ্যাকট) কারণে ধর্ষণের অভিযোগ থাকার পরও অনেক আসামী খালাস পেয়ে যায়। দেখা যায় ৭৫ শতাংশ আসামী এ ধারার সুবিধা নিচ্ছে। ১৮৭২ সালে প্রমাণ আইনের ১৫৫(৪) ধারায় বলা হয়েছে, “ যখন কোনও পুরুষকে ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় বা তার বিরুদ্ধে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ আনা হয় তখন ভুক্তভোগী নারীকে চরিত্রহীন হিসেবে দেখানো হতে পারে।” যদি প্রমাণ করা যায় ধর্ষণের শিকার নারীর অন্য পুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক রয়েছে তাহলে ওই নারীকে চরিত্রহীন হিসেবে অভিহিত করা হয়। একই সঙ্গে অপরাধীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগও লঘু হয়ে যায়। ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত আসামীদের ৭৫ শতাংশই প্রমাণ সংক্রান্ত আইনের ১৫৫(৪) ধারা অনুযায়ী তথ্য-প্রমাণ হাজির করে। আইনের ফাঁক গলে তারা বেরিয়ে যায়। আর আইনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় ভুক্তভোগী নারী- শিশু ও তার পরিবারের সদস্যরা।
ধর্ষককে মানুষ বলা চলে না। আর অমানুষ কারো আত্মীয়-স্বজন হতে পারে না। ধর্ষিতা আমাদের কারো মা, কারো বোন বা অন্য কোন আত্মীয়। কে বলতে পারে কাল আপনার মা-বোন ধর্ষণের শিকার হবে না? আইন-ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা সর্বোপরি সকলের সচেতনতা-শুভবুদ্ধির উদয়ে ‘ধর্ষণ’ নামক  শব্দটি অভিধান থেকে মুছে যেতে পারে।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *