অর্থ সঙ্কটের কারণে সরকার বিদ্যুৎ ও সারের ভর্তুকির দায় পরিশোধ করতে পারছে না। এ দায় পরিশোধে ব্যাংকগুলোকে বিশেষ বন্ডের মাধ্যমে সমন্বয় করতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বন্ড ছাড়া হয়েছে। আরো প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার বন্ড ছাড়া হবে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এমনিতেই ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কট চলছে। প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন উপকরণের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে নগদ টাকার জোগান দিচ্ছে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি ২১ হাজার ১০১ কোটি টাকার জোগান দেয়া হয়েছে। এমনি পরিস্থিতিতে বন্ডের মাধ্যমে ভর্তুকির দায় পরিশোধ করলে ব্যাংকের চলমান তারল্য সঙ্কট আরো বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। পাশাপাশি এসব বন্ডের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা সরবরাহ করলে মূল্যস্ফীতিও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বর্তমানে সরকারের টাকার সঙ্কটের কারণেই ভর্তুকির দায় ব্যাংকগুলোকে পরিশোধ করা হচ্ছে বন্ডের মাধ্যমে। এতে সরকারের চলমান আর্থিক চাপ কিছুটা কমবে। কিন্তু ব্যাংকের তারল্য সঙ্কট বেড়ে যাবে। কারণ এমনিতেই ব্যাংকে তারল্য সঙ্কট রয়েছে। ভর্তুকির অর্থ সুবিধাভোগীদেরকে ব্যাংকে নগদেই পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু বন্ডের বিনিয়োগ থেকে অর্থ ব্যাংকগুলো ৪-৫ বছর ধরে পেতে থাকবে। এতে ব্যাংকের চলমান তারল্য সঙ্কট বেড়ে যেতে পারে। তিনি মনে করেন, ভোক্তাদের ওপর বাড়তি চাপ প্রয়োগ না করে ভর্তুকি কিছুটা কমানো যেতে পারে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর এ বিষয়ে গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, বন্ড ছেড়ে দায় পরিশোধ করার মধ্যে আত্মতৃপ্ত হওয়ার কিছু নেই। সরকার ব্যাংকগুলোকে বন্ড দেবে। ব্যাংকগুলো তারল্য সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকে তা বন্ধক রেখে রেপোর মাধ্যমে তারল্য সহায়তা নেবে। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছেপে বাজারে ছাড়লে উল্টো মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বেড়ে যাবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে সার ও বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি বাবদ প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিকভাবে সারে ১০ হাজার ৫০০ কোটি ও বিদ্যুতে ১২ হাজার কোটি টাকা মিলিয়ে ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করতে চায় সরকার। এর মধ্যে সারে ভর্তুকি বাবদ ১০টি ব্যাংক ও বিদ্যুতে ভর্তুকি বাবদ ৩০টি ব্যাংকের অনুকূলে বন্ড ইস্যু করার পরিকল্পনা রয়েছে। বিশেষ বন্ডের মাধ্যমে গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিপিডিবির কাছে থাকা আইপিপিগুলোর পাওনা অর্থ শোধ করা হয়েছে। সরকার গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎ খাতের পাওনা অর্থ বন্ডের মাধ্যমে পরিশোধ করতে চাইছে। এ ক্ষেত্রে আরো দেড়-দুই হাজার কোটি টাকার মতো বন্ড ইস্যু করা হতে পারে। বন্ডের মেয়াদ বিভিন্ন সময়ের জন্য নির্ধারণ করা হবে, যাতে কোনো একক অর্থবছরে সরকারের ওপর একসাথে খুব বেশি পরিমাণে অর্থ পরিশোধের চাপ তৈরি না হয়। বন্ড ইস্যুর ফলে সরকারের ঋণ ও দায় আরো বাড়বে। তবে এ মুহূর্তে অর্থ সঙ্কট থাকায় সরকারের কাছে এর বাইরে আর কোনো বিকল্প নেই বলে জানান তারা।
গত বুধবারও সরকারি-বেসরকারি খাতের ২৪টি ব্যাংকের অনুকূলে ছয় হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করা হয়েছে। ব্যাংকগুলোর ৬০টি গ্রাহক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভর্তুকি বাবদ এ বন্ডগুলো ইস্যু করা হয়েছে। বন্ডের সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদহারের ভিত্তিতে। বর্তমানে এ হার ৮ শতাংশ। এ বন্ডের মেয়াদ ৮-১০ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। যেসব ব্যাংকের অনুকূলে বিশেষ বন্ড ইস্যু করা হয়েছে সেগুলো হলো এবি ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ, ঢাকা ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, মেঘনা ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স (এনসিসি) ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), আল-আরাফাহ্থ ইসলামী ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল), রূপালী ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংক।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ ও সারের জন্য যেসব উদ্যোক্তা ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ নিয়েছিল তাদের অনেকেই ব্যাংকের খাতায় খেলাপি হয়ে গেছে। যেমন বিদ্যুৎ খাতের উদ্যোক্তারা প্রতি মাসে তিন হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পেয়ে থাকে সরকারের কাছ থেকে। কিন্তু প্রায় সাত মাস যাবত তাদের অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে না। এতে সাত মাসে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা বকেয়া পড়ে গেছে। উদ্যোক্তারা সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকির অর্থ না পাওয়ায় ব্যাংকেরও অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না। গত ডিসেম্বরের আগে তারা টাকা পরিশোধ না করেই ঋণ নিয়মিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তা অনুমোদন করা হয়নি। এখন সরকার ভর্তুকির অর্থ বন্ডের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদেরকে পরিশোধ করছে। আর ব্যবসায়ীরা তা ব্যাংকের অর্থ বন্ডের মাধ্যমে সমন্বয় করছে। এতে একদিকে ব্যাংকের ঋণ নিয়মিত হয়ে যাচ্ছে। আর নিয়মিত থাকলে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয় না। ফলে ব্যাংকের বছর শেষে মুনাফা বাড়ার কথা রয়েছে। তবে, সঙ্কট হলো ঋণ আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকের নগদ টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। প্রতি দিনই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ধার করতে হচ্ছে। যেমন, গত ৭ ফেব্রুয়ারি প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা, ৬ ফেব্রুয়ারি প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা এবং ৫ ফেব্রুয়ারি ২১ হাজার ১০১ কোটি টাকা ধার করেছে। এর মধ্যে নগদ অর্থের পরিবর্তে বন্ডের মাধ্যমে দায় সমন্বয় করা হলে নগদ অর্থের সঙ্কট থেকেই যাবে। যদিও বন্ড কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখে রেপো ও বিশেষ রেপোর মাধ্যমে নগদ অর্থের সংস্থান করতে পারবে। তবে, এসব তারল্য সহায়তা নিতে সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশ পর্যন্ত ব্যাংকের সুদ গুনতে হচ্ছে। এটাই বড় সঙ্কটের কারণ।
প্রসঙ্গত, গত মাসেও সার ও বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকির বিপরীতে বিশেষ বন্ড ইস্যু করা হয়। এ ক্ষেত্রে সারে ভর্তুকির বিপরীতে পাঁচ ব্যাংকের অনুকূলে ইস্যু করা হয়েছে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকার বন্ড। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংককে দুই হাজার ৫৫৭ কোটি, জনতা ব্যাংককে এক হাজার ৮৯৬ কোটি, ইসলামী ব্যাংককে দুই হাজার কোটি ও আইএফআইসি ব্যাংককে ৪৫৯ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করা হয়েছে। অন্য দিকে গত মাসে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির বিপরীতে তিন হাজার ১১০ কোটি ৫৭ লাখ টাকার বিশেষ বন্ড ইস্যু করা হয়েছে। এর মধ্যে সিটি ব্যাংকের অনুকূলে এক হাজার ৯৮৩ কোটি, পূবালী ব্যাংকের অনুকূলে ৭৭ কোটি ৫৭ লাখ ও ইস্টার্ন ব্যাংকের অনুকূলে এক হাজার ৫০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির বিপরীতে এ পর্যন্ত ৯ হাজার ৬১০ কোটি ৫৭ লাখ টাকার বন্ড ইস্যু করা হয়েছে।